আমরা বাঙালিরা সবকিছুকেই হাল্কাভাবে নিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এমনকি মৃত্যুর মতো ঘটনাও যেন আমাদের কাছে কোন ব্যাপারই না। পরদিনই মৃত্যুশোক ভুলে সবকিছুই আগের মতো চালাতে থাকি। এর পেছনে কারণও থাকে। প্রতিদিন আগুনে পুড়ে, পানিতে পড়ে, সড়ক দুর্ঘটনায় নয়তো ট্রেনে কাটা পড়ে অথবা রাজনীতির পেট্রল বোমায় আমরা মরতে মরতেই চলেছি। আমাদের কাছে যেন মৃত্যুটাই বাস্তব বেঁচে থাকাটাই অস্বাভাবিক। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানরা তাদের জন্য হুমকির বিষয়টি হাল্কাভাবে নেবে কেন?ক্রিকেটি অস্ট্রেলিয়া যখন হুমকির মুখে বাংলাদেশ সফর পিছিয়ে দেয়ার কথা বলছে তখনই কয়েকটি টেলিভিশন টকশোতে সামরিক-বেসামরিক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ শুনলাম। তাদের অনেকেই ‘বাংলাদেশ ক্রিকেট রাজনীতি’র শিকার বলে মনে করলেন। আবার কেউ কেউ বললেন, তারা হেরে যাবার ভয়ে বাংলাদেশ সফরে আসতে চাইছে না। কতোটা হাল্কা আলোচনা হলো টকশোতে!! আমি অবশ্য আশ্চর্য হইনি। আমরাতো সবকিছুতেই হাল্কা মেজাজের।আমিও একটু হাল্কা যুক্তি দেই। ধরুন আপনার বাচ্চার স্কুলে বোমা মারা হবে বলে উড়ো চিঠি পেলেন। যার কোনো ভিত্তি নেই। তারপরেও কী আপনি ওইদিন আপনার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাবেন? নাকি আপনি ওই হুমকি সম্পর্কে খোঁজ খবর নেবেন, হুমকির মাত্রা কতটুকু, বা আদৌ হুমকি দেয়ার মতো বাস্তবতা আছে কিনা, হুমকি দাতাদের ক্যাপাসিটি কতটুকু এই সব বিশ্লেষণ শুরু করবেন। বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানো না পাঠানোর সিদ্ধান্ত আপনার। আমি পাঠাবো না।অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব ফরেন অ্যাফেয়ার্স এন্ড ট্রেড ডিপার্টমেন্ট থেকে জারি করা সিকিউরিটি এলার্টে এক সতর্কবার্তায় ৯টি বিষয় উল্লেখ করে অস্ট্রেলিয় নাগরিকদের বাংলাদেশ সফর না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তারই সূত্র ধরে পরদিন টেস্ট দলের বাংলাদেশ সফর শুরুর সময় পিছিয়ে দেয় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া। ওই সতর্ক বার্তায় পশ্চিমা নাগরিকরা জঙ্গিদের লক্ষ্য বস্তুতে পরিণত হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ার পর যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র তাদের নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করছে। গত সপ্তাহে তারা মালয়েশিয়ায় এই ধরনের হুমকি পেয়েছে। এরপর মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়াসহ ১০টি দেশে তারা ওই সতর্কবার্তা জারি করেছে। কারণ ইন্দোনেশিয়ায় একাধিকবার তারা হামলার শিকারও হয়েছে। তাদের অনেক নাগরিকের প্রাণহানি ঘটেছে ওই দেশে। তারাতো সতর্ক হবেই।আমাদের বিশ্লেষকরাই শুধু নন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও বিষয়টি ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। এবার আসুন দেখে নেই অস্ট্রেলিয়ানরা এই তথ্য পেল কোথায় যে তাদের ওপর হামলা হবে। গোয়েন্দা নিয়ম অনুযায়ী খুবই গোপনীয় এইসব তথ্যের উৎস তারা জানাবে না। কিন্তু তথ্যগুলো তারা শেয়ার করবে এটাই প্রথা। আমরা জানি এদেশে অস্ট্রেলিয়ান কোনো গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক নেই। তারা বৃটেন বা আমেরিকার কাছ থেকে তথ্য নেয়। সেটাও আনুষ্ঠানিক চুক্তির মাধ্যমে। ফাইভ আই’স বা পঞ্চচোখ বলে একটা ফোরাম আছে যার আওতায় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড এই পাঁচটি দেশ নিজেদের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য আদান প্রদান করে। আমরা এও জানি এদেশে মার্কিন গোয়েন্দা উপস্থিতি খুবই শক্তিশালী। বৃটেনের গোয়েন্দাদের আনাগোনাও আছে এই দেশে। এটা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না অস্ট্রেলিয়া এই পঞ্চচক্ষুর দেয়া তথ্য পেয়েই বাংলাদেশ সফরে পিছিয়ে দিতে বলেছে। আর ওই তথ্যের ভিত্তিতেই পরবর্তীসময়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র এদেশে ভ্রমণ সতর্কতা জারি করেছে।এখন আসা যাক পৃথিবীতে এতো দেশ থাকতে অস্ট্রেলিয়ানদের ওপর জঙ্গি হামলার হুমকি আসলো কেন? আমাদের ভুলে গেলে চলবে না অতি সম্প্রতি সিরিয়ায় আইএসএর বিরুদ্ধে অভিযানে অস্ট্রেলিয়াও শামিল হয়েছে। এছাড়া অস্ট্রেলিয়া থেকেও ১২৫ জনের মতো নাগরিক আইএস এর হয়ে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে। যখন থেকে অস্ট্রেলিয়া আইএস এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে তখন থেকেই এই দেশটি হুমকির মধ্যে পড়বে সেটা খুবই সহজ সমীকরণ। আর আইএস এর ভক্ত অথবা আইএসএর হয়ে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে বা অংশ নিতে চায় এমন নর-নারীর উপস্থিতি বাংলাদেশেও রয়েছে। বাংলাদেশের গোয়েন্দারা গত এক বছরে এমন ৩০ জনের মতো ব্যক্তিকে আটক করেছে। তাদের মধ্যে আইএস এর বাংলাদেশ সমন্বয়কারীও রয়েছেন। ঢাকা মেট্রপলিটন পুলিশের মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে এটাও বলেছেন- বেশ কয়েকজন নারীও প্রশিক্ষণ নিয়ে সিরিয়ায় গিয়ে আইএসএর হয়ে যুদ্ধে যেতে চাইছেন- এমন তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। এখন ওই জঙ্গিরা বাংলাদেশ, অস্ট্রেলিয়া বা পশ্চিমা স্বার্থের বিরুদ্ধে আঘাত হানার পরিকল্পনা করতেই পারে। তাই বলছি ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া বাংলাদেশ সফর পিছিয়ে দিয়েছে ভয়ে বা অমূলক কারণে এমন হাল্কা কথাবার্তা না বলে সমস্যার গভীরে গিয়ে এর সমাধান খোঁজা উচিত রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের জনগণের স্বার্থে।এইচআর
Advertisement