পরিবেশ সংরক্ষণ, বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন, জীব বৈচিত্র সংরক্ষণ এবং পাখির অভয় আশ্রম স্থাপনে এক অনন্য মডেল কুমিল্লার অধ্যাপক মতিন সৈকত। কোথাও আটক কিংবা আহত পাখির সন্ধান পেলেই ছুটে যান পাখি প্রেমিক মতিন সৈকত। কৃষকের সঙ্গে ফসলের মাঠে, কিংবা কৃষানীকে নিয়ে ঘরের আঙিনা, কখনো মৎস্য চাষীর সঙ্গে মাছের খামারে। সর্বত্রই রয়েছে তার পদচারণা। পেশায় শিক্ষক হলেও তিনি মাঠের মানুষ হিসেবেই কুমিল্লার দাউদকান্দিসহ আশপাশের এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছেন। এরই মধ্যে পেয়েছেন জাতীয় কৃষিপদক, সরকারিভাবে পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন। সরকারি কোন রকম সহায়তা ছাড়ায় বিগত প্রায় দেড় যুগ যাবত তিনি কৃষি ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। জানা যায়, কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলা প্লাবন ভূমিতে মৎস্য চাষে মডেল। এখানে বোরো ধানের মাঠে ব্যাপক হারে মাছ চাষ করেন স্থানীয় জনগণ। পাখির প্রধান খাদ্য মাছ। মাছের টানে দাউদকান্দির আদমপুরসহ আশেপাশের গ্রামগুলোতে পাখিদের অভয়ারণ্য গড়ে উঠেছে। এখানকার মৎস্য খামারগুলিতে হাজার হাজার পাখির বিচরণ। মৎস্য খামারিরা তাদের চাষের মাছকে নিরাপদ রাখার জন্য পুকুর এবং জলাশয়ের উপর জাল এবং সুতা দিয়ে ফাঁদ পেতে রাখে। আর সেই ফাঁদে আটকে পড়ে অনেক পাখি মারা যায়। অনেক পাখি আহত হয়ে ঝুলে থাকে। ফাঁদে আটকে অনেক সময় চিল, পরিজায়ী, বক, ফিঙ্গে, পানকৌড়িসহ নানা প্রজাতির পাখি আহত হয়। এসব বিলুপ্ত প্রায় পাখিগুলি খুঁজে বের করে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেয়ার কাজটি করেন পরিবেশ কর্মী ও পাখি প্রেমিক মতিন সৈকত। দাউদকান্দি উপজেলার আদমপুর গ্রামের তার বাড়িটি যেন পাখিদের নিরাপদ আবাসস্থল। গাছের মধ্য পাখিদের বাসা তৈরি করার জন্য কলসি ও ঝুঁড়ি বেঁধে দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রজাতির এসব পাখি দেখার জন্য প্রতিদিন লোকজন ভিড় জমায়। মতিন সৈকত জানান, তিনি ২০০৬ সাল থেকে পাখি উদ্ধার অভিযানে নামেন। এই পর্যন্ত শতাধিক চিল, ১৫টি পেঁচা, তিনটি কাক, দুইটি বাঁদুর, চারটি শালিক, একটি মাছরাঙ্গা, ছয়টি ফিঙ্গে, একটি ডাহুক, চারটি পরিজায়ী, একটি পানকৌড়ি, চারটি বক, তিনটি ঘুঘু, একটি চমচিকা, এবং একটি হলদে পাখিসহ বিভিন্ন বিরল প্রজাতির প্রায় দুই শতাধিক পাখি বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার করে মুক্ত করে দেন। এছাড়াও চারটি বন বিড়ালের ছানা, দুইটি বেজি, চারটি গুঁই সাপ অবমুক্ত করেন। এলাকায় কোন পাখি আহত হয়ে বা ফাঁদে বন্দি হয়ে মারা যাওয়ার উপক্রম হলে এখন ডাক পড়ে মতিন সৈকতের। তিনি এসে পাখিগুলিকে নিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করে ছেড়ে দেন। স্থানীয়রা জানান, মতিন সৈকত কৃষি, পরিবেশ, পাখি, প্রকৃতি, জীব বৈচিত্র সংরক্ষণের পাশাপাশি মৌসুমে মাত্র ২০০ টাকা করে বোরো ধানের সেচ প্রদান করেন। নিজের গাছের ডালা কেটে সবার জমিনে পুঁতে দিয়ে পাখি বসার ব্যবস্থা করে দেন, যাতে পাখিরা জমির ফসলের ক্ষতিকর পোকা খেয়ে ফসলকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে পারে। এলাকায় কালবৈশাখী ঝড় বন্যাসহ যেকোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর মাঠে-ঘাটে চষে বেড়ান মতিন সৈকত। আহত কোন পাখি দেখলেই উদ্ধার করে বাড়ি নিয়ে যান। এ বিষয়ে মতিন সৈকত জানান, পরিবেশের জন্য কাজ করা এখন আমার নেশায় পরিণত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, আমরা নিজেরাই পরিবেশ ধ্বংস করছি, পাখি হত্যা করছি, কিন্তু সবাই একটু সচেতন হলেই আমাদের পরিবেশকে আমরাই পারি বাসযোগ্য করে তুলতে, এর জন্য কোন অর্থের প্রয়োজন নেই, দরকার শুধু সচেতনতার। দাউদকান্দি রোটারী ক্লাবের প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মো. নুরুল গনি জানান, মতিন সৈকত কিংবদন্তী একজন সমাজকর্মী। তিনি দীর্ঘ প্রায় ২০ বছর যাবত মাত্র ২০০/- বিঘা প্রতি বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকদের সেচ প্রদান করে অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। যা দেশের কোথাও এ নজির নাই। পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণ নিয়ন্ত্রণে, বিষমুক্ত ফসল, ফলমূল, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে খাল-নদী পুর্নঃখননে তার সংগ্রাম অনুকরণীয়। স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভূঁইয়া জানান, মতিন সৈকত আমাদের গর্ব, দেশের গর্ব। পরিবেশ আন্দোলনে তার প্রচেষ্টা সত্যই প্রশংসনীয়। জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত মতিন সৈকত ইতিমধ্যে দিপ ক্রপ ক্রসেডার, কৃষক বন্ধু এবং এ রিয়েল পোট্রিয়ট ও সেচ কিংবদন্তী শিরোনামে অবহিত হয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের একজন ছাত্র তার কাজের উপর এরই মধ্যে গবেষণা সম্পন্ন করেছেন। কামাল উদ্দিন/এআরএ/পিআর
Advertisement