জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন সর্বসম্মতিক্রমে পর্যবেক্ষণসহ খারিজ করে দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
Advertisement
পর্যবেক্ষণে আপিল বিভাগ বলেছেন, যদি আবেদনকারী (খালেদা জিয়া) প্রয়োজনীয় সম্মতি দেন, তাহলে মেডিকেল বোর্ড দ্রুত তার অ্যাডভান্স ট্রিটমেন্টের (বায়োলজিক এজেন্ট) জন্য পদক্ষেপ নেবে, যা বোর্ড সুপারিশ করেছে।
আদালতের বাইরে বিএনপিপন্থী ও সরকার সমর্থক আইনজীবীদের পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভ আর কড়া নিরাপত্তার মধ্যে বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুরে খালেদার জামিন শুনানি শেষে আপিল বিভাগ জামিন আবেদনটি নিষ্পত্তি করে দেন।
খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদনের ওপর এবং তার জামিন আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে দুপুরে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
Advertisement
বেঞ্চের অন্য বিচারপতিরা হলেন-বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি জিনাত আরা, বিচারপতি আবু বকর সিদ্দিকী ও বিচারপতি নুরুজ্জামান।
আদালতে আজ রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান। খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ও জয়নুল আবেদীন।
এসময় রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, মো, মোমতাজ উদ্দিন ফকির, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিত দেবনাথ, এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক, ড. মো. বশির উল্লাহ, আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। আরও উপস্থিত ছিলেন ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন, সাবেক মন্ত্রী সাহারা খাতুন, আব্দুল মতিন খসরু, কামরুল ইসলাম, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম আমিন উদ্দিন মানিক, আজহারুল্লাহ ভূঁইয়া।
খালেদার পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী, নিতাই রায় চৌধুরী, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, বদরুদ্দোজা বাদল, রুহুল কুদ্দুস কাজল, মো. কামরুল ইসলাম সজল, মোহাম্মদ আলী, সৈয়দা আসিফা আশরাফি পাপিয়া, নীলুফার চৌধুরী মনি, মীর্জা আল মাহমুদ, ব্যারিস্টার রাগিব রউফ চৌধুরী, সুমা, এহসানুর রহমান, ফায়াজ জিবরান, শায়রুল হক ও গোলাম আক্তার জাকিরসহ শতাধিক আইনজীবী।
Advertisement
খালেদার জামিন প্রশ্নে সকাল ১০টার পর শুনানি শুরু হয়। ১১টা থেকে ৩০ মিনিট বিরতির পর দুপুর ১টা পর্যন্ত টানা শুনানি চলে। দুপুর ১টার পর প্রধান বিচারপতি বলেন, আমরা পরামর্শ করে আসি, জাজমেন্ট দেব। এরপর এজলাস ছেড়ে উঠে যান বিচারপতিরা। ছয় বিচারপতি মিলে ভেতরে ১৫ মিনিট পরামর্শ করে আবার ফিরে আসেন। এর পরপরই খালেদার জামিন খারিজ করে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। এসময় পিনপতন নীরবতা ছিল এজলাস কক্ষে।
শুনানি শুরু হওয়ার আগে সকাল ১০টা ১০ মিনিটের দিকে আদালতের কাছে খালেদা জিয়ার সর্বশেষ স্বাস্থ্যগত অবস্থা সম্পর্কিত মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন জমা দেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আলী আকবর। এরপর ১০টা ১৩ মিনিটের দিকে শুনানি শুরু হয়।
প্রথমে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন নিয়ে কথা বলেন। পরে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন তার বক্তব্য দেয়া শুরু করেন।
শুনানিতে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘এই আদালতের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আমরা মানবিক কারণে খালেদা জিয়ার জামিন চাইছি। খালেদা জিয়া সুস্থ মানুষ ছিলেন। কিন্তু আমরা দেখলাম, তার অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে।’
আদালতকে জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘খালেদা জিয়ার অবস্থা এমন যে, তিনি পঙ্গু অবস্থায় চলে গেছেন। হয়তো ছয় মাস পর তার অবস্থা আরও খারাপ হবে। এজন্য মানবিক কারণে খালেদা জিয়াকে জামিন দেয়া হোক।’
বেলা ১১টার পর আদালত বিরতিতে যান। বিরতির পর আবার শুনানি গ্রহণ করেন। এ পর্যায়ে জয়নুল আবেদীনের পর খালেদা জিয়ার অপর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন শুনানিতে অংশ নেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও দুদকের পক্ষে আইনজীবী খুরশীদ আলম খান শুনানি করেন। দুপুর ১টার দিকে শুনানি শেষ হয়। সোয়া ১টার দিকে আদেশ দেন আপিল বিভাগ।
খালেদার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন শুনানিতে বলেন, ‘খালেদা জিয়ার আত্মীয়-স্বজন তার সঙ্গে দেখা করেছে। আমরা তো আর পারি না। আমাদের দেখা করতে দেয় না। আত্মীয়-স্বজন দেখা করে এসে বলেছে, তার অবস্থা খারাপের দিকে। তিনি ভালো মানুষ জেলে গেলেন।’
‘এখন তার অবস্থা খারাপের দিকে। খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা দরকার। এজন্য মানবিক দিক বিবেচনা করে তার জামিন আবেদন করেছি।’
তিনি বলেন, ‘তারা (মেডিকেল বোর্ড) তো বলেনি, খালেদা জিয়া হাঁটাচলা করতে পারে। স্টেজ ক্রিপলে (পঙ্গুত্ব) আছেন। ছয় মাসেও তার অবস্থার উন্নতি হয়নি। হয়তো পরের ছয় মাসে আরও খারাপ হবে। অবস্থা তো আর এমন না যে, তিনি (খালেদা জিয়া) জামিন পেলে পালিয়ে যাবেন।’
শুনানিতে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, ‘তার (খালেদা জিয়া) এক মামলায় ১০ বছরের সাজা হয়েছে। অন্য মামলায় সাত বছর হয়েছে। তারা (খালেদার আইনজীবীরা) আবেদনে বলেছেন, ১৯৯৭ সালে একবার ও ২০০২ সালে একবার হাঁটু প্রতিস্থাপন করেছেন তিনি (খালেদা জিয়া)। তাহলে তো ন্যাচারালি তার হাঁটা রেস্টিকটেড হবে। (জিয়া) অরফানেজ মামলায় যেমন দ্রুত আপিল শুনানি করতে নির্দেশ দিয়েছেন, এটাতেও দিতে পারেন।’
খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘আবেদনকারীর পক্ষে কয়েকটি মামলার উদাহরণ দেয়া হয়েছে। কিন্তু তাদের হচ্ছে অবৈধ সম্পত্তির মামলা। আর এটা (জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট) হলো ক্ষমতার অপব্যবহারের। তিনি প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হয়ে চ্যারিটির নামে টাকা আত্মসাত করেছেন। হাইকোর্ট অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনা করে জামিন দেননি।’
তিনি আরও বলেন, ‘মেডিকেল বোর্ড যদি উনার (খালেদা জিয়া) সম্মতি না পান, তাহলে চিকিৎসায় বোর্ড আর ডাক্তারের কী করার আছে? উনি তো সহযোগিতা করছেন না। এটাতে উনার একটা সমস্যা আছে। ডাক্তাররা উনাকে টাইম টু টাইম সব কিছু অবহিত করছেন। কিন্তু উনি তাতে সম্মতি দিচ্ছেন না।’ সব দিক বিবেচনা করে তার জামিন আবেদন খারিজের আরজি জানান খুরশীদ আলম খান।
গত ২৮ নভেম্বর খালেদা জিয়ার জামিনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা থাকলেও সেদিন তার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা জানতে মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন চান সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। ৫ ডিসেম্বরের মধ্যে তা আদালতে আসার কথা ছিল।
নির্ধারিত দিনে সেটি আদালতে না আসায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদার জামিন প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত এক সপ্তাহ পিছিয়ে যায়। প্রধান বিচারপতি সেদিন ১২ ডিসেম্বর শুনানির পরবর্তী তারিখ রেখে তার আগেই প্রতিবেদন জমা দেয়ার নির্দেশ দেন। প্রতিবেদন দাখিল না হওয়া নিয়ে সেদিন আদালতে ব্যাপক হইচই করেন বিএনপিপন্থী আইনজীবীরা।
আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক বুধবার (১১ ডিসেম্বর) বিকেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদন সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছায়।
এজলাসে ৩০ জন করে ৬০ আইনজীবী থাকা না থাকা
সকাল ৯টা ৩৫ মিনিটের দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও খালেদা জিয়ার পক্ষের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনকে উদ্দেশ করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেন, ‘আজকের খালেদার জামিন শুনানিতে উভয় পক্ষের ৩০ জন করে আইনজীবী থাকবেন।’
কিন্তু শুনানি শুরু হলে দেখা যায়, উভয় পক্ষের কেউই আপিল বিভাগের ওই কথা শোনেননি। সেই প্রসঙ্গেই প্রধান বিচারপতি উভয় পক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা কেউ কথা শোনেননি।’ বিশেষ করে অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘আপনাদেরও কেউ কথা রাখেনি।’
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় দণ্ডিত বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিন আবেদনের ওপর আজ সকাল ১০টা ১০ মিনিটের দিকে আপিল বিভাগে শুনানি শুরু হয়। এরপর সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল খালেদা জিয়ার মেডিকেল বোর্ডের প্রতিবেদন আদালতে জমা দেন। সবার সামনে সেই খাম খোলা হয়। পরে আদালত তা দেখেন। দেখতে দেওয়া হয় খালেদার আইনজীবীদেরও।
এর আগে সকাল ১০টা ৬ মিনিটের দিকে এজলাসে আসেন প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরা। এসময় আদালত খালেদা জিয়া ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা কেউ কথা শোনেননি।’
কড়া নিরাপত্তা
খালেদার জামিন শুনানির আগের দিন, অর্থাৎ বুধবার (১১ ডিসেম্বর) বিকেলে সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় তিনটি মোটরসাইকেলে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। আজ সুপ্রিম কোর্ট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তোলে। সকাল থেকেই যারা আদালতে ঢুকেছেন, তাদের প্রত্যেককে তল্লাশি করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের প্রবেশ করার সবকটি গেটে বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন।
জামিন খারিজের ‘রিজন’ বলা হয়নি, করণীয় ঠিক করবেন সিনিয়র আইনজীবীরা
খালেদার জামিন আপিল বিভাগে খারিজ হওয়ার বিষয়ে পরবর্তী করণীয় সিনিয়র আইনজীবীরা ঠিক করবেন বলে জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন।
এক ব্রিফিংয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘এখন আদালত যে আদেশ দিয়েছেন, সেখানে কোনো রিজন (কারণ) উল্লেখ করা হয়নি। দেখব, কী কারণে আমাদের আবেদন খারিজ করা হয়েছে। সে বিষয় দেখে আমাদের একটা সিনিয়র আইনজীবী প্যানেল আছে, ওই প্যানেলের আইনজীবীরা বসে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করবেন।’
এফএইচ/এনএফ/এসআর/জেআইএম