আন্তর্জাতিক

গণহত্যার বিচারে মিয়ানমারের ১৭ বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সমর্থন

রাখাইনে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালানোর অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে বিচার শুরু হয়েছে তাতে সমর্থন দিয়েছে দেশটির ১৭টি বিদ্রোহী গোষ্ঠী। সোমবার যৌথ এক বিবৃতিতে মিয়ানমারের এই নৃশংসতা বন্ধ করতে দেশটির ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।

Advertisement

শান রাজ্যের ১৭টি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর যৌথ ওই বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আনা আন্তর্জাতিক মামলায় শান সম্প্রদায়ের দৃঢ় সমর্থন রয়েছে। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তারা দশকের পর দশক ধরে দেশের নৃগোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে নৃশংসতা চালাচ্ছে।

বিদ্রোহীদের এই বিবৃতি বলছে, আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত গণহত্যার মামলা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও দেশত্যাগের বাধ্য করার তদন্তে তাদের সমর্থন রয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যা ও দেশত্যাগের বাধ্য করার মামলা আর্জেন্টিনায় বিচারাধীন রয়েছে।

‘দেশজুড়ে সেনাবাহিনীর অপরাধ ও নৃশংসতা বন্ধ করার জন্য আমরা মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ আন্তর্জাতিক কঠোর চাপ প্রয়োগ, গৃহযুদ্ধের অবসান, বহুল আকাঙ্ক্ষিত ন্যায়বিচার এবং সবার জন্য সমতা নিশ্চিতের আহ্বান জানাই।’

Advertisement

জাতিসংঘের সর্বোচ্চ বিচারিক সংস্থা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গত নভেম্বরে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করে গাম্বিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আন্তর্জাতিক এ আদালতে গণহত্যার দায়ে তৃতীয় মামলা এটি।

এদিকে, সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারের বিচার শুরু হয়েছে। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টার দিকে এই মামলার শুনানি শুরু হয়ে চলে ৬টা ১০ মিনিট পর্যন্ত।

তিন ঘণ্টার কিছু বেশি সময় ধরে চলা এই শুনানিতে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের কাছে মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘটিত রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংস গণহত্যা, ধর্ষণ, জ্বালাও-পোড়াওয়ের চিত্র তুলে ধরেন মামলার বাদী গাম্বিয়ার আইনজীবীরা। এ সময় প্রোজেক্টরে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের চালানো নৃশংসতার সচিত্র উপস্থাপন করা হয়।

গণহত্যার দায়ে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজেতে দায়েরকৃত মামলার শুনানির শুরুতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের নির্বোধ হত্যাকাণ্ড বন্ধে দেশটির প্রতি আহ্বান জানান গাম্বিয়ার আইন ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামাবাদু। মামলার শুনানির শুরুতে আইসিজের প্রধান বিচারপতি আব্দুল কাই আহমেদ ইউসুফের উদ্দেশে তিনি বলেন, গাম্বিয়া যা বলছে তা হলো আপনি মিয়ানমারকে এই নির্বোধ হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে বলুন।

Advertisement

হেগে রোহিঙ্গা গণহত্যার এ বিচারপ্রক্রিয়ায় দেশের হয়ে আইনি লড়াই চালাতে আদালতে উপস্থিত ছিলেন মিয়ানমারের ডি ফ্যাক্টো নেত্রী অং সান সু চি। আদালতে যুক্তরাষ্ট্রের আইনজীবী তাফাদজ পাসিপান্দো বলেন, রোহিঙ্গা নারীদের ধর্ষণের কথা অস্বীকার করতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি কৌশল অবলম্বন করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ‘ফেক রেপ’ নামে একটি পেজ খোলা হয়; এ পেজের নিয়ন্ত্রণ করছে স্টেট কাউন্সিলরের দফতর।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা নারীদের গণধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু সু চি বলেছেন, সেনাবাহিনী এবং বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর কেউ নোংরা বাঙালি মেয়েদের স্পর্শ করবে না। কারণ তারা আকর্ষণীয় নয়। তার আগে মামলার শুনানির শুরুতে গাম্বিয়ার আইন ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামাবাদু বলেন, বর্বর এবং নৃশংস এসব কাজ; যা আমাদের সবার বিবেককে আঘাত করেছে। এটি এখনও অব্যাহত রয়েছে। মিয়ানমারকে নিজ দেশের মানুষ হত্যা বন্ধ করতে হবে।

আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত গণহত্যার এই মামলার চূড়ান্ত রায় দিতে কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। রোহিঙ্গাদের যাতে আর কোনো ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হয় সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা চায় গাম্বিয়া। হেগের আদালতে এ মামলার শুনানি চলবে আগামী ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। মামলায় গণহত্যার দায় অস্বীকারের পক্ষে সাফাই গাইতে লড়ছেন অং সান সু চি। বুধবার স্থানীয় সময় ১১টায় হেগে মিয়ানমারের পক্ষে সাফাই গাইবেন মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় এই উপদেষ্টা।

গাম্বিয়া ও মিয়ানমার দুই দেশেই ১৯৪৮ সালের জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হিসেবে শুধু গণহত্যা থেকে বিরত থাকা নয় বরং এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধ এবং অপরাধের জন্য দেশগুলো বিচারের মুখোমুখি হতে বাধ্য। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে প্রথম জেনোসাইড কনভেনশন মামলা হয়েছিল সার্বিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালে। এ মামলায় সার্বিয়া বসনিয়া হার্জেগোভিনিয়ায় গণহত্যা প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়েছিল বলে প্রমাণ হয়।

২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে রক্তাক্ত সামরিক অভিযান শুরু করে দেশটির সেনাবাহিনী। সামরিক বাহিনীর জ্বালাও-পোড়াও, খুন, ধর্ষণের মুখে ৭ লাখ ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। জাতিসংঘ মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এই অভিযান গণহত্যার অভিপ্রায়ে পরিচালনা করেছে বলে মন্তব্য করেছে। তবে মিয়ানমার এই অভিযোগ বারবার অস্বীকার করে আসছে।

সূত্র : রয়টার্স, দ্য ইরাবতী।

এসআইএস/জেআইএম