ফিচার

নারীদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখাতে চান আয়েশা

আয়েশা সিদ্দিকা আঁখি চাঁদপুর জেলার মতলব দক্ষিণ উপজেলার উত্তর বহড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার বড়। তার ৪ বছরের একটি কন্যাসন্তান আছে। ১৯৮৭ সালে জন্ম নেওয়া এ অগ্নিকন্যা এখন দেশ ও দশের সম্মান বাড়াতে কাজ করে যাচ্ছেন। বাবা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, মা গৃহিণী ও কবি। তার সফলতায় মা ও বোনের অবদান সবচেয়ে বেশি।

Advertisement

আয়েশা সিদ্দিকা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্লাক বেল্টপ্রাপ্ত ক্রিড়াবীদ। পাঁচটি জাতীয় ও তিনটি আন্তর্জাতিক স্বর্ণপদক জিতেছেন। রৌপ্য ও ব্রোঞ্জও আছে তার ঝুলিতে। বর্তমানে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক তায়কোয়ান-দো অ্যাসোসিয়েশনের সহকারী প্রশিক্ষক। তার লক্ষ্য সারাদেশের নারীদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো। ইতোমধ্যে বরিশালে কাজও শুরু করেছেন। অদ্রম্য এ স্বপ্নবাজ নারী কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রিফাত কান্তি সেন–

আপনার ছোটবেলার স্বপ্ন কী ছিল?আয়েশা সিদ্দিকা: ছোটবেলায় তো অনেক স্বপ্ন ছিল। কখনো ট্রাক ড্রাইভার হবো, ট্রেন চালাবো, কখনো ইলেকট্রিশিয়ান আবার কখনো উড়োজাহাজ চালাবো। কিন্তু সবকিছুর ঊর্ধ্বে একটাই চাওয়া ছিলো, তাহলো খেলাধুলা নিয়ে থাকা।

খেলাধুলার জগতে কীভাবে এলেন?আয়েশা সিদ্দিকা: ৫ বছর ৭ মাস বয়সে প্রাইমারি স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা দিয়ে শুরু। স্কুল ও কলেজ ভিত্তিক জাতীয় পর্যায়ে হ্যান্ডবল, কাবাডি, ব্যাডমিন্টন খেলতাম। আজ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খেলছি। এরপর মার্শাল আর্টের দিকে ঝুঁকে পড়ি। ২০০৭ সাল থেকে তায়কোয়ানদোকে (কোরিয়ান মার্শাল আর্ট) নিয়ে পথ চলছি।

Advertisement

শুরুর দিকে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছিল?আয়েশা সিদ্দিকা: যখন খেলাধুলা শুরু করেছি; তখন বাধা না পাইনি। তবে খেলাকে যখন ক্যারিয়ার হিসেবে নেওয়ার চেষ্টা শুরু করেছি; তখন থেকেই পারিবারিক ও সামাজিকভাবে বাধার পাহাড় সামনে এসে দাঁড়ায়। এটা তো এমনিতেই বোঝা যায়, নারী যেটাই করতে যায়। সেখানেই তাকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।

এত ইভেন্ট থাকতে ‘মার্শাল আর্ট’ কেন বেছে নিলেন?আয়েশা সিদ্দিকা: বাস্তব জীবনের একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মার্শাল আর্টকে বেছে নেওয়া। ২০০০ সালে চোখের সামনে একটি মেয়েকে খুবই ভয়ংকর পরিস্থিতিতে দেখি। তাকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেও আঘাত পাই। এ ঘটনা থেকেই মার্শাল আর্টকে বেছে নেই।

সবচেয়ে আনন্দময় অভিজ্ঞতাটা শুনতে চাই–আয়েশা সিদ্দিকা: যখন মেয়ে থেকে আরও একটি মেয়ের মা হয়েছি। জোবাইদা সিদ্দিকা জ্যোতি (৪) আমার মেয়ে। বর্তমানে সে-ই আমার পথ চলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। ওকে সাথে নিয়েই তো পথ চলছি। এটাই যে আমার কাছে চরম আনন্দময় অভিজ্ঞতা।

কষ্টের অভিজ্ঞতাটা বলবেন কি?আয়েশা সিদ্দিকা: কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা একটু জানাতে চাই। বুলগেরিয়ায় ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপে অংশগ্রহণের জন্য অনেকের সাথে যোগাযোগ করেছি, আর্থিক সহোযোগিতা চেয়েছি। আর্থিক সহযোগিতা না পেলেও কিছু কথা পেয়েছি। একজন বলেছেন, ‘আরে আপা বয়স হয়েছে। মেয়ে আছে একটা। তারপরও এই লাফঝাপ দিয়ে কী হবে? মারামারি করে কি ভাত জুটবে? তারচেয়ে ক্রিকেট বা ফুটবল খেললে কিছু হতো। আপনাকে টাকা দিয়ে লাভ কি?’ একজন খেলোয়াড়ের জন্য এটি কষ্টকর এবং অপমানজনক। সবার কাছে অনুরোধ, কোনো খেলোয়াড়কে সাহায্য করতে না চান তো করবেন না, কোনো খেলোয়াড়কে ছোট করার চেষ্টা করবেন না দয়াকরে। তবে সমাজে ব্যতিক্রম মানুষও থাকে। যেমন কাজী ফার্মসের এমডি কাজী জাহেদ হাসান স্যার। তিনি বুলগেরিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য ২১তম ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশীপে অংশগ্রহণ করতে আমাকে ১ লাখ টাকা দিয়েছেন।

Advertisement

এদেশে নারীদের মার্শাল আর্ট শেখা কতটা জরুরি বলে মনে করেন?আয়েশা সিদ্দিকা: অবশ্যই, বাংলাদেশে নারীদের মার্শাল আর্ট শেখা খুবই জরুরি। কেননা বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে নারীদের আরও নিরাপদ হওয়া দরকার। নিজেদের বিভিন্ন সহিংসতা থেকে রক্ষা করতে মার্শাল আর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দেশে ধর্ষণের হার কমাতে মার্শাল আর্ট প্রশিক্ষণ অপরিসীম ভূমিকা পালন করবে। তবে ধর্ষণ তখনই নির্মূল হবে; যখন পুরুষের মানসিকতা পরিবর্তন হবে।

শুনলাম নতুন একটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছেন। সে সম্পর্কে কিছু বলুন–আয়েশা সিদ্দিকা: এটা তো আমার যাত্রার শুরু মাত্র। ছোট পরিসর থেকেই বড় কিছুর জন্য কাজ শুরু করতে হয়। আপাতত হাজার নারীকে নিয়ে শুরু করছি। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ৬৪টি জেলায় একজন করে মার্শাল আর্ট ট্রেইনার তৈরি করতে চাই। তবে এর জন্য পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। যেহেতু আমার পরিকল্পনা পুরো বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে। সেক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে কাজটি আরও সহজ ও ভালোভাবে করতে পারবো।

আপনার এই সংগ্রামে কী কী প্রত্যাশা রয়েছে?আয়েশা সিদ্দিকা: শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমার প্রত্যাশাগুলো পৌঁছাতে চাই। সেগুলো হলো- শিক্ষা গেজেটে শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের ক্লাসের পরিবর্তে সেলফ ডিফেন্স বা মার্শাল আর্টের শিক্ষা দেওয়া। যাতে নারীর অধিকার, উন্নয়ন ও নিরাপত্তার জায়গা নিশ্চিত করা যায়। এটি পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হলে ছেলে-মেয়েরা এর সাথে খুব সহজেই যুক্ত হতে পারবে। এটাকে পেশা হিসেবে না হোক, অন্তত আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে শিখে রাখা খুব দরকার।

ভবিষ্যতের জন্য আর কী স্বপ্ন দেখেন?আয়েশা সিদ্দিকা: ক্রীড়ার মাধ্যমে নারী ও শিশু উন্নয়ন নিয়ে কাজ করতে চাই। এছাড়া একটি ক্রীড়া স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চাই।

এসইউ/জেআইএম