ব্রেক্সিট নিয়ে মহাসংকটে পড়েছে ব্রিটেন। বহু প্রচেষ্টার পরও দীর্ঘ সময়ক্ষেপণ করে ব্রেক্সিট নিয়ে কোনো সম্মত চুক্তির খসড়া নিয়ে হাউস অব কমন্স ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেনি। যে কারণে পার্লামেন্টের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার আগেই আড়াই বছরের মাথায় পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগামী ১২ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। হাউস অব কমন্সের ৬৫০টি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য ৩২৬ আসন প্রয়োজন।
Advertisement
ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টি, বিরোধী লেবার পার্টি, লিবারেল ডেমোক্রেটস, স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপ ফর চেঞ্জ, গ্রিন পার্টি, ব্রেক্সিট পার্টি ইত্যাদি নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। চুক্তি সম্পাদন করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার পক্ষে রয়েছে কনজারভেটিভ পার্টি। নাইজেল ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টি কোনো রকম চুক্তি ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করার পক্ষের একজন বলিষ্ঠ নেতা। ২০১৬ সালের গণভোটে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগের পক্ষে রায় হলে নাইজেল অবসরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ব্রেক্সিট চূড়ান্ত না হওয়ায় তিনি আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হয়েছেন। পার্টির নাম পরিবর্তন করে নির্বাচনী মাঠে কঠিনভাবে অবস্থান নিয়েছে এখন ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টি। এর আগে তিনি ছিলেন ইউকে ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টি বা ইউকিপের নেতা।
গত এপ্রিলে ব্রেক্সিট পার্টি গঠনের কয়েক সপ্তাহ পরে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টি একক দল হিসেবে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে চমক সৃষ্টি করে। ফারাজের ব্রেক্সিট পার্টির অনুরূপ উত্থানে বরিস জনসনের কনজারভেটিভ পার্টি শঙ্কিত, কারণ ভোট ভাগাভাগিতে একটা নির্বাচনী বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া অসম্ভব কিছু নয়। এবার দল দুটির জোট বেঁধে নির্বাচন করার কথা শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত ব্রেক্সিট পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন প্রধানমন্ত্রী এবং কনজারভেটিভ প্রধান বরিস জনসন।
প্রথাগতভাবে ব্রিটেনের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় সাধারণত কনজারভেটিভ পার্টি আর লেবার পার্টির মধ্যে। লেবার পার্টি নেতা জেরেমি করবিন বামপন্থী। তাকে লেবার পার্টি কখনো মন্ত্রিসভায় নেয়নি, এমনকি কখনো ছায়া মন্ত্রিসভায় পর্যন্ত তার স্থান হয়নি- শুধু তার কট্টর বামপন্থী আদর্শের জন্য। অথচ তিনি ছয়বার পার্লামেন্টে নির্বাচিত হয়েছেন। এত সাধারণ জীবনযাপন করেন যে সাইকেলে করে পার্লামেন্ট ভবনে আসেন, বাজার করেন। তিনি যখন মিলিব্যান্ডের পর লেবার পার্টির নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন ডেইলি টেলিগ্রাফ, টাইমস, সানডে টাইমস পত্রিকা নিন্দায় মুখর হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে করবিন ধনতান্ত্রিক বিশ্বে আতঙ্কের প্রতীক হয়ে ওঠেন।
Advertisement
ব্রিটেন এবং আমেরিকার বড় মিডিয়াগুলো করবিনকে টেরোরিস্টদের বন্ধু, রাশিয়ার চর, তিনি ক্ষমতায় এলে অর্থনীতি ধসে যাবে ইত্যাদি প্রচার করে। যারা ব্রিটেনে মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করেন তারা পালিয়ে যাবেন এমন কথাও প্রচারিত হয়। এবারের নির্বাচনীযুদ্ধেও এমন প্রচারণা আরও ব্যাপকভাবে চালানো হচ্ছে। কিন্তু সৌভাগ্যের কথা যে বৃটেনের তরুণসমাজের বিরাট একটি অংশ এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলো সমর্থনের ওপর করবিন এখনও টিকে আছেন। না হয় নিজ দল লেবার পার্টির টনি ব্লেয়ারপন্থীরাসহ কনজারভেটিভ পার্টি করবিনের কবর রচনা করত। টোরি পার্টির বরিস জনসনও করবিনের কঠোর সমালোচনা করে জনসভায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন যে, নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে তিনি করবিন বিহীন ক্রিসমাস ডে উদযাপন করবেন।
বৃটেনের দুইজন নেতা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে খুবই প্রিয়। একজন কনজারভেটিভ পার্টির নেতা বরিস জনসন, অন্যজন হচ্ছেন ব্রেক্সিট পার্টির নেতা নাইজেল ফারাজ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বৃটেনের বিচ্ছেদ ঘটানো নাইজেল ফারাজের প্রধান লক্ষ্য। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বরিস জনসন এবং নাইজেল ফারাজকে আসন সমঝোতা করে নির্বাচন করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। অন্য দেশের নির্বাচন নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলা ভোটাররা ভালো মনে করবেন না নিশ্চয়। কিন্তু এমন কর্মকাণ্ড থেকে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে বিরত রাখা সম্ভব নয়। অবশ্য ন্যাটোর ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বর্তমানে লন্ডন সফররত মার্কিন প্রেসিডেন্ট এও বলেছেন যে, তিনি ব্রেক্সিটের পক্ষের লোক হলেও ব্রিটেনের আগামী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কাজ করতে তার সমস্যা নেই, সেটি যে দলের প্রধানমন্ত্রী হোক।
কনজারভেটিভ পার্টির নেতা বরিস জনসনকে অনেকে বৃটেনের ট্রাম্প বলে অভিহিত করেন আর বিষয়টা নিয়ে ট্রাম্প গর্ববোধ করে থাকেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট লেবার পার্টির নেতা করবিনকে মোটেই পছন্দ করেন না। আমেরিকা কোন নেতাকে পছন্দ করে আর কোন নেতাকে পছন্দ করে না- তাও ব্রিটেনের নির্বাচনে ভোটারদের বিবেচনার বিষয়। কারণ ১৯৪৫ সাল থেকে আমেরিকার উপগ্রহ হিসেবে বৃটেনের অবস্থান- ভোটারদের স্বাধীন-সার্বভৌম চিন্তার জায়গাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্রিটিশ ভোটাররা আমেরিকা কাকে সমর্থন করছে তার দিকে চেয়ে থাকে। সেসব কারণে জনমত জরিপে কনজারভেটিভ পার্টির বিজয়ের কথা উঠে আসছে।
বরিস জনসনও ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির মতো ব্রেক্সিটের সমর্থনে অতি জাতীয়তার তাস খেলতে শুরু করেছেন। তিনি বলেছেন নির্বাচনে জিতে তিনি ৩১ জানুয়ারির মধ্যে ব্রেক্সিট কার্যকর করবেন। ট্রাম্প যেমন বহিরাগত বিরোধী হয়ে ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ বলে সাদাদের ইমোশনকে নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করছেন, এখন ব্রিটেনের নির্বাচনে বরিস জনসন সেই পথে হাঁটছেন। তিনিও অভিবাসীদের বিরুদ্ধে। এই কারণে বহিরাগতরা যদি কোনো একটি বিশেষ পার্টির প্রতি সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত দেয় তাহলে বরিসের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়া বিচিত্র নয়।
Advertisement
লেবার পার্টি বলেছে, তারা সরকার গঠন করার মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলাপ-আলোচনাও চালাবে এবং ব্রেক্সিট প্রশ্নে ছয় মাসের মধ্যে আরেকটা গণভোটের আয়োজন করবে। করবিন অবশ্য এই ঘোষণাও দিয়েছেন গণভোটে তখন তিনি নিরপেক্ষ অবস্থান নেবেন। লিবারেল ডেমোক্রেটও আরেকটা গণভোটের পক্ষে। আর স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি তো আগেই ঘোষণা দিয়েছে ব্রিটেন যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করে তবে তারা বৃটেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং ইউনিয়ন ত্যাগ করবে না।
সুতরাং সার্বিক পরিস্থিতিতে এটা বোঝা যায় যে, ব্রিটেন কত বড় সংকটের মধ্যে রয়েছে। ভোটের পরও ব্রেক্সিট জটিলতা কাটবে গ্যারান্টি নেই। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৯ সদস্যরাষ্ট্রের মধ্যে কাজের সন্ধানে এক দেশের লোক অন্য দেশে যেতে কোনো বাধা নেই। সেই সুবাদে ব্রিটেনে পূর্ব ইউরোপের কিছু লোক এসে বসতি স্থাপন করেছে। পূর্ব ইউরোপের কালচারের সঙ্গে বৃটেনের কালচারের কোনো মিল নেই। বৃটেনের লোক মনে করে পূর্ব ইউরোপের লোকদের আগমনের কারণে তাদের ছেলেমেয়েরা আনকালচার্ড হয়ে যাচ্ছে।
তাই তাদের কিছু লোক বলছে যে, ইউনিয়ন পরিত্যাগ করা উচিত। আর ২০১৬ সালের ২৩ জুন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন গণভোটের আয়োজন করেন। ইইউতে যুক্তরাজ্যের থাকার বিপক্ষে ৫২ শতাংশ ও পক্ষে ৪৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এই গণভোটে ব্যাপক হারে ভোট দিয়েছিল ভোটাররা। এমনকি ব্রিটেনের ২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনেও এত ভোট পড়েনি। গণভোটে ইইউয়ের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের বিচ্ছেদের রায় পাওয়ার পর একই বছরের ২৪ জুন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দেন ডেভিড ক্যামেরন। তিনি ব্রিটেনের ইউনিয়নের সঙ্গে থাকার পক্ষে ছিলেন। ক্যামেরনের পদত্যাগের পর যুক্তরাজ্যের ৭৬তম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন টেরেসা মে। ব্রেক্সিট জটিলতায় তাকেও গত ৭ জুন পদত্যাগ করতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী ক্যামেরন গণভোট দিয়ে ব্রেক্সিটের এই যন্ত্রণার সৃষ্টি করেছেন। বৃটেনের মানুষের বোঝা উচিত তাদের এখন আর আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত উপনিবেশ নেই। তাদের আর্থিক অবস্থাও এখন আর আগের মতো নেই। আর্থিক কারণে তাদের ইউনিয়নে থাকাই উত্তম ছিল। জিব্রাল্টারের কর্তৃত্ব ছাড়া এখন আর কিইবা আছে বৃটেনের।
দেখা যাক ১২ ডিসেম্বরের নির্বাচনে কী রায় দেয় দেশবাসী।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com
এইচআর/বিএ/জেআইএম