কামরায় পিনপতন নিস্তব্ধতা। হালকা আলোর রশ্মি ঝুলে আছে কামরায়। গোলাকার বেদি বা চত্বরের মতো কাঠের মেঝের ওপর একে একে এসে দাঁড়াল কয়েকজন। তাদের মাথায় উটের লোমের তৈরি উঁচু টুপি আর উটের গায়ের মতো রং টুপির। পরনে কালো আলখাল্লা। ডানহাত ভাঁজ করে রাখা বাম কাঁধে। বামহাত এমনভাবে ডান কাঁধের ওপর রাখা, যেন এক দেহ এক আল্লাহর কাছে সমর্পণ করল। অবনত মস্তিষ্ক, নত দৃষ্টিপাত। গোল হয়ে তারা দাঁড়িয়ে আছে গোলাকার চত্বরের এক প্রান্তে, পাশাপাশি।
Advertisement
সবাই অপেক্ষা করছে নিশ্বাস আটকে রেখে। ভেসে এলো সুরেলা বাঁশির ধ্বনি, যেন সৃষ্টিকর্তা ঢেলে দিলো প্রাণ। ঠিক যেভাবে আল্লাহ আদমকে (আ.) সৃষ্টির পর তারমধ্যে প্রাণ সঞ্চার করেছিলেন। বাঁশির সুরের সাথে কালো পোশাকে দাঁড়িয়ে থাকা দরবেশদের কালো আলখাল্লা খুলে গেল। বেরিয়ে এলো ধবধবে সাদা আলখাল্লায় মোড়া শরীর, যেন বাঁশির সুরের সাথে সাথে প্রাণের সঞ্চার পেলো। উঁচু টুপি যেন মনুষ্য অহংয়ের সমাধি আর সাদা আলখাল্লা যেন সেই অহংয়ের কাফন। এভাবেই জন্ম হলো সত্যের পথে আর যাত্রা শুরু হলো সেই সত্যের কাছে পৌঁছে যাওয়ার জন্য।
এরপর খুব ধীরে ধীরে সুরের মুর্ছনা বাড়তে থাকলো অন্য বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে। সেইসাথে একে একে দরবেশ দল ঘুরতে শুরু করলো যেন বিশ্বলোকের নক্ষত্রপুঞ্জ ঘুরছে। সুরের মুর্ছনা ছড়িয়ে পড়তে পড়তে ঘুর্ণনের গতি বাড়ছে। ধীরে ধীরে ডানহাত উপরের দিকে উঠছে, যেন স্বর্গের সাথে সেতু বন্ধনের ধাপ হয়ে থাকে। আর বামহাত নিচের দিকে নামছে, যেন মর্ত ছুঁয়ে দিচ্ছে। স্বর্গ থেকে ঈশ্বরের কৃপা এনে যেন তা বিলিয়ে দিচ্ছে মর্তের মানুষের মধ্যে- পারমার্থিক উপহার।
সুরের তীক্ষ্ণতা বাড়ছে, সাথে দরবেশদের ঘুর্ণনের গতি আরও বাড়ছে। মাথা কাতা হয়ে আছে, যেন সমস্ত মানব অহং ঝরে পড়ে আর হারিয়ে যায় টুপির আদলে মর্তের সমাধিতে। তাদের ধবধবে সাদা আলখাল্লা তৈরি করছে ঘুর্ণন বলয়। আত্মহারা হয়ে ওরা ভাসছে, যেন নক্ষত্রপুঞ্জ ভাসছে বিশ্বলোকের মহাশূন্যে। তাদের সমবেত কণ্ঠে ভজন ছড়াচ্ছে- আল্লাহ, আল্লাহ, আল্লাহ। এভাবেই যেন অর্জিত হবে আধ্যাত্মিক পূর্ণাঙ্গ রূপ। এভাবেই নিজের অহং এবং সত্তাকে বিলোপ বা বিনাশ করা হয়, যে আমাদের সৃষ্টি করেছেন; সেই আল্লাহর এককের মধ্যে মিশে যাওয়ার মাধ্যমে। ফানা ফিল্লাহ হচ্ছে এ পদ্ধতির শেষ ধাপ, অর্থাৎ ফানাতে পৌঁছে যাওয়ার চেতনাও যেন অবলুপ্ত হয়ে যায়। যেন অবচেতনের ধাপে পৌঁছে যাওয়ার চেতনা বিলুপ্তি। ফানা ফিল্লাহ মানে নিজের চেতনা হারিয়ে অবচেতন স্তরে পৌঁছে যাওয়া নয় বরং নিজের সত্তাকে সৃষ্টিকর্তার কাছে সমর্পণ করে নিজের বিনাশ করা।
Advertisement
অনেকেই এটাকে দরবেশ নৃত্য বলে চেনেন। কিন্তু এটা তা নয়। এই যে নক্ষত্রপুঞ্জের মতো ঘুরতে ঘুরতে আল্লাহ আল্লাহ আল্লাহ জিকির- এটা একটি শাস্ত্রীয় আচার অনুষ্ঠানের অংশ। যার নাম ‘সামা’। তুর্কি ভাষায় Sema। ‘সামা’ অর্থ শোনা। ১৩ শতকের দিকে তুর্কির কনিয়া শহরের বিখ্যাত তুর্কি কবি, ধর্মীয় নেতা ও মওলানা রুমি বুকের মধ্যে এক শূন্যতা নিয়ে অপেক্ষা করেন, কবে তার এ শূন্যতা পূরণ হবে। দিনের পর দিন তিনি কোরআনের সুরা এবং তার মানে, জীবনে তার ব্যবহারের ওপর কথা বলেন আর তার অগণিত অনুসারীরা সেই বক্তব্য শোনেন।
একজন ধর্মীয় নেতা ও মওলানা হিসেবে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তবুও এক শূন্যতা অনুভব করেন। কোথাও যেন কিছু একটা নেই। অন্যদিকে ফার্সি কবি শামস তাবরিজি, যিনি কোরআনকে আধ্যাত্মিক পদ্ধতিতে বুঝতে চাইতেন আর এভাবেই তিনি লিখেছেন আধ্যাত্মিক কবিতা, যার বেশিরভাগই কোরআনের বিভিন্ন সুরার আধ্যাত্মিক অনুবাদ, তবে কবিতার ছন্দে। পবিত্র কোরআন নিজেই এক দুর্দান্ত ছান্দিক কবিতার সংকলন, যেন আর সেই কবিতাগুলোর একক কবি স্বয়ং আল্লাহ। কোরআনের যেকোনো অংশ নিয়ে পড়া শুরু করলেই কবিতার ছন্দগুলো অনুভব করা যায়। প্রতি আয়াতের শেষ লাইনের সাথে পরের আয়াতের শেষ লাইন মিলে যায় এবং এতো সুন্দর বাক্যবাগীশতা আছে, যা মানুষের পক্ষে তৈরি করা অসম্ভব।
তাবরিজি তার কবিতাগুলো মূলত মৌলিক ভাবনার আকারে লিখে যান। জীবনের একটি সময়ে এসে তিনি কবি রুমির সাথে ৪০ দিন অতিবাহিত করেন। ইতিহাসবিদদের মতে এবং তাবরিজির নিজের লেখা আত্মজীবনী অনুযায়ী, তিনি এ ৪০ দিনে কবি রুমিকে চল্লিশটি আধ্যাত্মিক ছবক বা শিক্ষা দেন। এরপর তিনি উধাও হয়ে যান দামাসকাসের দিকে। অনেকেই বলেন, কবি রুমির ওপর তাবরিজির প্রভাব এতো প্রকট হয়েছিল যে, কবি তার সংসার এবং অন্যান্য সবকিছুকে বিস্মরণ করেছিলেন।
তাবরিজি চলে যাওয়ার পর রুমি কবিতা লেখেন, একের পর এক। তাবরিজি ছিলেন রুমির আধ্যাত্মিক গুরু। তার কাছেই তিনি শিখেছেন আধ্যাত্মিক পদ্ধতিতে চেতনার বিলুপ্তি ঘটিয়ে নিজেকে সৃষ্টিকর্তার কাছে সমর্পণ করা। আর তখন থেকেই রহস্যময় সুফিবাদের পথ চলা শুরু। এখনো নিয়মিত রুমির শহর কনিয়াতে এ আচার অনুষ্ঠান হয়। বিশ্বব্যাপী সুফিদের সংখ্যা অনেক, তারমধ্যে সবচেয়ে বেশি তুর্কিতে।
Advertisement
আমাদের বাংলাদেশে কিছু ফকির (পীর) আছেন, যারা এ সুফিবাদের অনুসারী (সব পীর-ফকির নন)। এছাড়া পাকিস্তান, ভারত এবং অন্যান্য দেশেও সুফিবাদের অনুসারীরা আছেন। তারা আমাদের মতই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, হজ্ব করেন, রোজা রাখেন। এমনকি আমাদের সাথে একই কাতারে মসজিদে নামাজ পড়েন। সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য প্রাপ্তির জন্য তাদের এই আচার-অনুষ্ঠান ছাড়া বাকি সবই আমাদের প্রচলিত অন্যান্য সবকিছুর মতো।
এসইউ/এমকেএইচ