পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ এক অপার সম্ভাবনাময় অঞ্চল। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য ‘শান্তিচুক্তি’ অনুযায়ী ক্ষমতায়নের প্রক্রিয়াগুলোকে যথাযথভাবে পর্যালোচনা করা দরকার। উল্লেখ্য, স্বাধীনতা-উত্তর কালে ১৯৭৩ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত পার্বত্য তিন জেলার সংঘাতের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই রাজনৈতিক চুক্তি বাস্তবায়নে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে বর্তমান সরকার বিগত ২২ বছরে শান্তিচুক্তির সর্বমোট ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা সম্পূর্ণভাবে বাস্তবায়নের কাজ সম্পন্ন করেছে। চুক্তির অবশিষ্ট ১৫টি ধারা আংশিক এবং ৯টি ধারা বর্তমানে বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শান্তিচুক্তির আংশিক ও অবাস্তবায়িত ধারা বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য জেলায় শান্তি আনয়নের পাশাপাশি উক্ত এলাকায় ভৌত অবকাঠামো এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি সাধনের মাধ্যমে পার্বত্য জনগোষ্ঠীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক মানোন্নয়নে সরকার প্রাণান্তকর চেষ্টায় নিয়োজিত।
Advertisement
সরকারের রূপকল্প ২০২১, ২০৪১, ডেল্টা প্ল্যান এবং ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় পার্বত্য অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণ ও সার্বিক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনার রূপরেখা দেওয়া আছে। তবে শান্তিচুক্তির আলোকেই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়’ এবং ‘আঞ্চলিক পরিষদ’ গঠন করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এখন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় পদে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্য থেকে প্রতিনিধি নিযুক্ত হয়েছেন। চুক্তি অনুযায়ী পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একজন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাননীয় সংসদ সদস্যকে মন্ত্রীত্ব প্রদান করা হয়েছে। বান্দরবানের এমপি বীর বাহাদুর উশৈসিং বর্তমানে মন্ত্রী। মন্ত্রণালয়কে সহযোগিতার জন্য ১২ সদস্য বিশিষ্ট উপদেষ্টা কমিটি রয়েছে। ৩টি ‘পার্বত্য জেলা পরিষদ’ এবং নিয়ন্ত্রণাধীন ৩৩টি দপ্তর বা সংস্থার মধ্যে রাঙ্গামাটিতে ৩০টি, খাগড়াছড়িতে ৩০টি এবং বান্দরবানে ২৮টি হস্তান্তর করা হয়েছে।
ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নে আমরা দেখতে পাই, শান্তিচুক্তির পর চেয়ারম্যান পরিষদ ২২ জন সদস্য নিয়ে গঠন করার বিধি অনুসরণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে দুই তৃতীয়াংশ সদস্য উপজাতিদের মধ্য থেকে নির্বাচিত। এ পরিষদ ১জন চেয়ারম্যান, ১২ জন উপজাতি সদস্য, ২ জন উপজাতি মহিলা সদস্য, ৬ জন অ-উপজাতি সদস্য, ১ জন অ-উপজাতি মহিলা সদস্য নিয়ে গঠন করা হয়। এরা বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী থেকে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। চেয়ারম্যানের পদ শূন্য হলে তা অন্তর্বর্তীকালীন সময়ের জন্য পরিষদের অন্যান্য উপজাতি সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করা হয়। সদস্যদের পদ শূন্য হলেও উপনির্বাচন করে পূরণ করার বিধান রয়েছে।
শান্তিচুক্তি ভূমি বিরোধ নিরসনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। কারণ ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করতে গঠন করা হয়েছে ‘ভূমি কমিশন’। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন ২০১৬ জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়ে বাংলাদেশ গেজেটে তা প্রকাশিত। ‘ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন বিধিমালা’ প্রণয়নের কাজ সম্পন্ন করতে পারলে ভূমি জটিলতা নিরসনের মাধ্যমে পাহাড়ে অস্থিতিশীলতা ও অরাজকতা অনেকাংশেই কমে যাবে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। আলোচনার মাধ্যমে বাঙালি সেটেলার ও পাহাড়ি উপজাতিদের মধ্যকার জাতিগত ও ধর্মীয় বিভেদ ও শঙ্কার জায়গাটা দূর করতে হবে এবং বাঙালি সেটেলারদের আনুপাতিক হার উপজাতিদের কাছাকাছি হওয়ায় পাহাড়ে রেখেই আলোচনার মাধ্যমে পাহাড়ি উপজাতিদের ভূমি সমস্যা সমাধানের যৌক্তিক পথ খুঁজে বের করা আবশ্যক। বর্তমানে ৮,০২,৪২১ জন উপজাতি এবং ৭,৫৩,৬১৬ জন বাঙালি সেটেলার পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করছে; যার হার উপজাতি ৫১% এবং সেটেলার ৪৯%।
Advertisement
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে একটি পদাতিক ব্রিগেডসহ অসংখ্য সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করার মধ্য দিয়ে। কারণ এখন জনপ্রতিনিধিদের গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেনা-হস্তক্ষেপ ব্যতীত স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতাও অর্জিত হয়েছে। রাঙামাটিতে সেনাবাহিনীর ৭৮টি ক্যাম্পের মধ্যে বর্তমানে কমে হয়েছে ৬০টি, খাগড়াছড়িতে ৬৫টি থেকে ৪১টি এবং বান্দরবানে ৬৯টি থেকে কমে ৩১টি সেনা ক্যাম্প বিদ্যমান। কাজেই আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি সমুন্নত রাখতে শান্তিচুক্তির চতুর্থ খণ্ডের ১৭ ধারা অনুযায়ী অস্থায়ী ক্যাম্পগুলো পর্যায়ক্রমে স্থায়ী নিবাসে ফেরত নেয়া হচ্ছে। তাছাড়া বিজিবি ও আনসারদের অধিকাংশ ক্যাম্পও প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমানে সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন-শৃংখলা রক্ষার ক্ষেত্রে বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তা দিচ্ছে। রাস্তাঘাট নির্মাণ, ঠিকাদার তদারকি, ভূমি ধসে উদ্ধার অভিযানসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নে সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে। সেনাবাহিনী হচ্ছে জনগণের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এজন্য তাদের সকলের দায়িত্ব হচ্ছে সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন।
ক্ষমতায়ন নিজস্ব সংস্কৃতি লালন ছাড়া টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। এজন্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নের পরিপ্রেক্ষিতে সরকার উপজাতিদের নিজস্ব ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান বিল ২০১০’ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট গড়ে উঠেছে। বান্দরবান জেলা সদরে একটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট রয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ভিত্তিক ২টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে। সেখানে প্রায় ১৪০০ উপজাতি শিশু ও ছাত্রছাত্রী শান্তিপূর্ণভাবে অধ্যয়ন করে যাচ্ছে। রাঙ্গামাটি শহরে রাঙ্গামাটি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট নামে একটি সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র রয়েছে। খাগড়াছড়ি জেলায় ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সংস্কৃতি চর্চার পূর্ণ স্বাধীনতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এ ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের সার্বিক সহযোগিতা করে থাকে। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নিজস্ব ধর্মীয় উপাসনালয়ে তাদের নিজস্ব ভাষায় ধর্মশিক্ষা প্রদান করছে।
পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন বিকশিত হওয়ার পথে কিছু বিঘ্নও রয়েছে। শান্তিচুক্তির দ্বিতীয় খণ্ডের এক নম্বর ধারায় উপজাতি শব্দটি বলবৎ থাকবে বলে উল্লেখ আছে। ওই চুক্তির কয়েক স্থানে ‘উপজাতি’ এবং ‘উপজাতীয়’ শব্দটি উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু আদিবাসী কথাটি নেই। চুক্তি স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমারা চুক্তিতে নিজেদের ‘আদিবাসী’ দাবি করেননি। ইতিহাসের কোনো সময়ই, কোনো ব্যক্তি বা লেখক তাদের কখনোই আদিবাসী হিসেবে অভিহিত করেননি। উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের জন্য সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাকুরির ক্ষেত্রে, আর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য কোটা সুবিধার কথা রয়েছে। অথচ এসব সুবিধাভোগীরা প্রতিবছর ‘আদিবাসী ফোরাম’ নামের সংগঠন থেকে ৯ আগস্ট ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালন করে আসছে। ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে আদিবাসী বিষয়ক যে ঘোষণাপত্র গৃহীত হয় সেখানে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত থাকে এবং চারটি দেশ যেমন- অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও নিউজিল্যান্ড প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। কারণ তাদের নৃ-গোষ্ঠী রয়েছে বহুসংখ্যক। ২০০৭ সালের আগ পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো আঞ্চলিক দল বা কোনো নেতাই আদিবাসীর স্বীকৃতি চাননি। জাতিসংঘের ঘোষণা পত্র ২০০৭ অনুসারে আদিবাসীদের বিভিন্ন ধরনের অধিকার এবং সুবিধার কথা লিপিবদ্ধ আছে বিধায় আদিবাসী ইস্যুটি সামনে এসেছে। ফলে ‘শান্তিচুক্তি’ বাস্তবায়নে কিছুটা বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। অপরদিকে রয়েছে চার সশস্ত্র পাহাড়ি সন্ত্রাসী সংগঠন; যাদের আধিপত্য বিস্তারে গত ৬ বছরে খুন হয়েছে ৩২১ জন। তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে বছরের পর বছর ধরে চলছে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। আওয়ামী লীগের অনেক পদধারী নেতাও এসব আঞ্চলিক সংগঠনের হাতে খুন হয়েছেন। তাদের হুমকিতে বিভিন্ন সময়ে ৩৫৫ আওয়ামী লীগ নেতা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। এক পরিসংখ্যান মতে, পাহাড়ে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ২০৭ জন এবং বাঙালি খুন হয়েছেন ১১৪ জন। এভাবে হত্যাসহ চাঁদা আদায় ও বিচ্ছিন্নতাবাদি কার্যক্রমে নিয়োজিত পাহাড়ি জনগোষ্ঠী ‘শান্তিচুক্তি’ বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। ফলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের স্তম্ভ ‘শান্তিচুক্তি’ তার প্রত্যাশিত পথে বাস্তবায়ন কার্যক্রমে অগ্রসর হতে পারছে না।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দপ্তর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।
Advertisement
এইচআর/জেআইএম