গোলাপী বল। দিনরাতের আলো। এটাই কি টেস্ট ক্রিকেটের ভবিষৎ? এই প্রশ্নের উত্তরে ভিন্নতা আছে ক্রিকেট সার্কিটে। সাবেক ক্রিকেটার, ক্রিকেট বিশ্লেষক সাবি একমত হয়ে বলছেন, হ্যাঁ, এটাই ভবিষৎ। তার অর্থ এই নয় যে তারা সবাই রক্ষণশীল। পুরোনোকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকার পক্ষে। আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম ‘স্মার্ট বিজ্ঞাপন’ বিরাট কোহিলও নিশ্চিত নন, গোলাপী বল আর দিনরাতের ম্যাচ টেস্টের শেষকথা কিনা!
Advertisement
তবে উপমহাদেশের প্রথম গোলাপী বলের টেস্ট নিয়ে দর্শক উন্মাদনা তুঙ্গে ছিল। যদিও সেই উন্মাদনা শেষ হতে দুদিনও লাগেনি। তার জন্য শুধু বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ব্যর্থতাকেই দায়ী করা যাচ্ছে না। গোলাপী বলও কিছু ভূমিকা রেখেছে। যদিও গোলাপী বলে ডেভিড ওয়ার্নের মতো ব্যাটসম্যানরা ট্রিপল সেঞ্চুরি করছেন। স্যার ডনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছেন স্মিথ-ওয়ার্নার। তা দেখে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, দিনরাতের টেস্টই ভবিষ্যৎ।
সত্যি কি তাই। তাহলে লাল বলে ব্যাটসম্যান-বোলারদের এত দিনের লড়াই কি ফিকে হয়ে যাবে? গোলাপী বল আর দিনরাতের টেস্টের চিন্তার আমদানি হয়েছিলম এই শতাব্দীতে যখন ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টির দাপাদাপিতে দর্শক হারাচ্ছিল টেস্ট। ২০১৫ সালের নভেম্বরে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ম্যাচ দিয়ে ডনের শেষ দিনগুলো যেখানে কেটেছিল সেই অ্যাডিলেডে শুরু গোলাপী টেস্ট। তারপর এক ডজন টেস্ট হয়ে গেছে, ক্রিকেট বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। তাতে খুব বেশি বাড়তি কিছু পেয়েছে ক্রিকেট তাও কি?
লাল বলের টেস্টের মাঝে অন্যরকম এক সৌন্দর্যও লুকিয়ে আছে। যা দর্শকদের অন্তরে টেস্ট নিয়ে ভিন্ন অনুভূতি, ভিন্ন রোমাঞ্চ জাগায়। সকালের এক ঘণ্টায় বোলার ও ব্যাটসম্যানের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখনও তাদের কাছে টেস্টের অন্যতম আকর্ষণ। গোলাপী বলে ব্যাটসম্যান, কিপার, স্পিনার, ফিল্ডার কাউকে খুব স্বস্তিতে রাখছে না। বলের চওড়া সিম, অতিরিক্ত পালিশ সব মিলিয়ে বল একটু বেশি নড়াচড়া করে। ব্যাটসম্যানদের বল দেখতে সমস্যা হয়। বিশেষ করে রাতের আলো জ্বলে উঠতেই প্রথম দিকে সমস্যা বেড়ে যায়। পেসাররা অবশ্য বাড়তি কিছু সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু কিপারকে বল কিপ করতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। ফিল্ডারদের বল ধরতেও সমস্যা হয়। আর স্পিনার? তারা গোলাপী বলে শুধুই রান আটকানোর যন্ত্র হয়ে উঠছেন। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের এক চল্লিশ বছরের ইতিহাসে স্পিন বিবেচিত হয়ে আসছে অন্যরকম এক শিল্প হিসেবে। সেই আর্ট টেস্ট ক্রিকেটে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার শঙ্কা দেখেছেন অনেকে। হারিয়ে যেতে পারে স্পিন নামে শিল্প। যা ক্রিকেটের ঐতিহ্যের পক্ষে খুব একটা সুখবর হতে পারে না। তাই গোলাপী রঙ-কে টেস্ট ক্রিকেটের জন্য অনেকে অশনিসংকেত ভাবতে শুরু করছেন। গোলাপী বল। দিনরাতের ম্যাচ। টেস্ট ক্রিকেটের একমাত্র বিকল্প হতে পারে না।
Advertisement
দিনরাতের টেস্ট সমর্থকদের বিনোদনের জন্য আয়োজন করা যেতেই পারে। তবে তার মাঝেই টেস্টের ভবিষৎ না খোঁজাই ভালো। কারণ টেস্টে বিনোদন লুকিয়ে আছে বোলার-ব্যাটসম্যানের তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে। কোনো টেস্টের সকালের এক ঘণ্টা বোলারের বিরুদ্ধে কীভাবে একজন ব্যাটসম্যান লড়াই করেন, ক্রিজ আঁকড়ে পড়ে থাকেন। তার ওপর নির্ভর করে টেস্টের মাহাত্ম্য। তা দেখে যদি সমর্থকরা মাঠে আসতে না চান, তা হলে তাদের শুধু মাঠে আনতেই গোলাপী রঙ ছিটানো ঠিক হবে কিনা সেটা নিয়ে ভাবার দরকার। অন্য পরিকল্পনা করা যেতে পারে। সেটা চিন্তা করতে হবে ক্রিকেট মহলকে।
আর নৈশালোকে গোলাপী বলের টেস্ট খেলতে হলে শিশিরের সঙ্গে লড়াই করতে হবে ব্যাটসম্যান। ফিল্ডার সবাইকে। তাই হুট করে গোলাপী বলে টেস্ট খেলতে নামলে কী পরিণতি হয়, সেটা সব থেকে ভালো টের পেয়েছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। এত উন্মাদনা-উত্তেজনার ইডেন টেস্ট শেষ পর্যন্ত বিবর্ণ হয়ে গেল। সব রঙ হারিয়ে গেল। ধূসর এক স্মৃতি হয়ে থাকল বাংলাদেশের প্রথম ‘পিংক টেস্ট’!
লেখক: সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।
এইচআর/বিএ/এমএস
Advertisement