২০১৬ সালের সালের ১ জুলাই বাংলাদেশে একটি অন্যরকম রাত এসেছিল। রাতটি ছিল ভয়ঙ্কর, আতঙ্কের। কয়েকজন সশস্ত্র তরুণের অপরিণামদর্শী অভিযান এক রাতেই বদলে দিয়েছিল বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক চিত্র। বাংলাদেশের ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকা, যেখান বিদেশি কূটনীতিকদের সবচেয়ে বেশি বসবাস বলে নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল জোরদার, সেখানেই ঘটেছিল ভয়াবহ ও নিন্দনীয় জঙ্গি হামলার ঘটনা। সেই রাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে জাপান, ইতালি ও ভারতের ১৭ জন নাগরিককে নারকীয়ভাবে হত্যা করা হয়েছিল। দুইজন পুলিশ কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশের কয়েকজন মানুষকেও প্রাণ দিতে হয়েছিল ওই হামলাকারী জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের হাতে।
Advertisement
বিশ্বের সকল দেশের কাছে বাংলাদেশের জন্য এটা ছিল এক লজ্জাজনক অধ্যায়। এর আগে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদীদের উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছে কিছু সন্ত্রাসী ঘটানাও ঘটেছে। কিন্তু তারা যে এত সংগঠিতভাবে এতবড় একটি ঘটনা ঘটানোর মতো শক্তি অর্জন করেছে,সেটা ছিল অনেকের অনুমানেরও বাইরে। হামলার সাথে জড়িতরা নিজেদেরকে আইএস (ইসলামিক স্টেট)-এর সদস্য বলে দাবি করেছিল। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, না, বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই। এরা হলো নব্য জেএমবি। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, তারা যে দেশের জন্য ভয়াবহ বিপদ তৈরি করেছিল তা নিয়ে বিতর্ক করার সুযোগ ছিল না।
হলি আর্টিজানের ঘটনা আমাদের অনেকের জন্যই ছিল এক বড় ধাক্কা। জেগে ওঠার তাগিদ দিয়েছিল ওই হামলা। জঙ্গিবাদের বিপদকে যারা হালকাভাবে দেখতেন, যারা মনে করতেন, দরিদ্র কিছু মাদরাসা ছাত্র অর্থের লোভে হাতে অস্ত্র নিলেও তারা সমাজ-রাষ্ট্রের জন্য কোনো হুমকি তৈরি করতে পারবে না। কিন্তু হলি আর্টিজান দেখালো গরিব মাদ্রাসা ছাত্র নয়, বিত্তবান পরিবারের ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষিত তরুণরাও গিয়ে শামিল হয়েছে ওই অন্ধকার পথে। হলি আর্টিজানে হামলাকারীরা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল না। দেশের খ্যাতনামা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও নামিদাম বেসরকারি ইউনিভার্সিটির ছাত্র ছিল। বাংলাদেশকে একটি বড় তোপের মুখে ফেলে দিয়েছিল ওই জঙ্গি হামলা। কারণ এর আগে কখনোই কোনো হামলায় বাংলাদেশে এত বিদেশি মারা যায়নি।
জাপান বাংলাদেশের একটি বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশ। সেই দেশের ৭ জন হত্যার ঘটনায় এর প্রতিক্রিয়াও অনেক খারাপ ছিল। ১৭ জন হত্যার ঘটনায় শুধু জাপান নয়, বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অনুজ্জ্বল হয়েছিল সেদিন। বাংলাদেশ অনেকের কাছেই একটি অনিরাপদ দেশ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। এমন ঘটনার পর বিদেশি কূটনীতিকদের অনেকেই পরিবার-পরিজনকে নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ভয়ে। নিজেদের স্বাভাবিক চলাচল কূটনীতিকরা সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশিদের ধারণা রাতারাতি পাল্টে গিয়েছিল। তাদের মুখ থেকে লজ্জাজনক কথা শুনতে হয়েছে। মোটকথা, হলি আর্টিজান হামলা বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে অনেক নীচুতে নিয়ে গিয়েছিল। দেশে বিনিয়োগ আসাও অনেকখানি কমে গিয়েছিল। সাংবাদিক ও পর্যটকরাও কিছুদিন এদেশে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলেন । ফলে দেশ অনেক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল।
Advertisement
তবে আগে দেশে জঙ্গি উপস্থিতি সম্পর্কে সরকারের মধ্যে কিছুটা শিথিল মনোভাব থাকলেও হলি আর্টিজানের হামলার ঘটনায় সরকারেরও টনক নড়ে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। জঙ্গিদের ব্যাপারে শূন্য সহনশীলতার নীতি গ্রহণ করা হয়। শৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্কতা, কার্যকর গোয়েন্দা নজরদারির কারণে জঙ্গিরা আর কোনো বড় ধরণের অঘটন ঘটাতে পারেনি। পরবর্তী সময়ে জঙ্গিবিরোধী ছোটবড় ১৯ টি সফল অপারেশনের মাধ্যমে জঙ্গিদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। চূড়ান্তভাবে জঙ্গি নির্মূল এখনও সম্ভব না হলেও তারা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কারণেই জঙ্গিদের প্রভাব কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশ ৯০ ভাগ মুসলিমের দেশ হওয়া সত্ত্বেও ইসলামি জঙ্গিদের নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে দুটো কারণে। বাংলাদেশের মানুষ ধর্মানুরাগী হলেও ধর্মান্ধ নয়। ধর্মের নামে জবরদস্তি এদেশের মানুষ পছন্দ করে না। তাই মুসলিম অধ্যুষিত দেশ হলেও এখানে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ধর্ম পালনের স্বাধীনতা রয়েছে। বিভিন্ন মহল থেকে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা সৃষ্টির অপচেষ্টা হলেও সংখ্যাসাগরিষ্ঠ মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতির পক্ষে । বাঙালি মুসলিমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না। ধর্মের নামে,বর্ণের নামে রক্তপাত , হানাহানি এখানে হয় না বললেই চলে। তাই সাধারণ মানুষের কাছে জঙ্গিরা প্রশ্রয় পায়নি। বরং সাধারণ মানুষ জঙ্গিবিরোধী অভিযানে সরকারের সমর্থনে এগিয়ে এসেছে। বিভিন্ন অপারেশনে তারাও বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
হলি আর্টিজানের হামলায় মোট ২১ জনের বিরুদ্ধে নানাভাবে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। এরমধ্যে পাঁচজন ঘটনার দিন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছে। আটজন নিহত হয়েছে জঙ্গিবিরোধী বিভিন্ন অভিযানে। আটক আট জনের বিরুদ্ধে বিচারিক প্রক্রিয়া চলে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বিচার কার্যক্রম শেষ হয়। গত ২৭ নভেম্বর ২০১৯ যখন হলি আর্টিজান মামলার রায়ে ৭ জনের ফাঁসির দন্ড দেওয়া হয়, আর একজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
যখন এই রায় ঘোষিত হলো তখন দেশে জঙ্গিদের অবস্থান অতি দুর্বল। তাদের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠার সুযোগ কম। অপরাধীদের ফাঁসির রায়ে খুশি হয়েছে দেশের সাধারণ মানুষ। আর এ বিচারকার্যের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশ এই বার্তা পৌঁছাতে সক্ষম হলো যে,বাংলাদেশ শুধু অস্ত্র দিয়ে জঙ্গি দমন করে না। আইনি ও বিচারিক প্রক্রিয়াতেও তাদের দমন করা হচ্ছে। হলি আর্টিজান হামলা মামলার রায়ে মানুষ স্বস্তি বোধ করছে। হামলাকারীরা বাংলাদেশকে যে পরিচিতি দিতে চেয়েছিল, সেটাতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
Advertisement
জঙ্গি তৈরির কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে এবং সেগুলো দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। সমাজ থেকে অনিয়ম এবং বৈষম্য দূর করতে না পারলে, মানুষের জীবন ও সম্পদ নিরাপদ রাখার ব্যবস্থা রাষ্ট্র নিশ্চিত করতে না পারলে একটি ফাঁক তৈরি হয় এবং সেই ফাঁক দিয়েই জঙ্গিবাদসহ নানা ‘অপ-বাদ' জায়গা করে নেয়। হলি আর্টিজানের ঘটনা বাংলাদেশের সামনে যে বিপদ ও আশংকা তৈরি করেছিল তা সরকারের উদ্যোগ ও জনসচেতনতার কারণে অনেকটাই দূর হয়েছে।জঙ্গিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি মানুষকে আশাবাদী করে তুলেছে।
লেখক : কবি ও শিক্ষক।
এইচআর/এমএস