>> ৯টি পাঁচ তারকা হোটেল ছাড়া সবগুলো অগ্নিঝুঁকিতে>> ঢাকার ৩২৬টি হোটেলের মধ্যে অগ্নিঝুঁকিতে ৩১৭টি>> সক্ষমতা বাড়াতে সময় দেয়া হলেও প্রতিপালন হয়নি
Advertisement
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পাঁচ তারকাখচিত মর্যাদাপূর্ণ তালিকায় মোট ১৭টি হোটেল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে নয়টি ছাড়া সবগুলো অগ্নিনিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে।
রাজধানীর অধিকাংশ আবাসিক হোটেলই চলছে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে। দুর্বল অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে ৩২৬টি হোটেলের মধ্যে অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে ৩১৭টি। ইতোমধ্যে ২৪৭টি হোটেল কর্তৃপক্ষকে এক মাসের মধ্যে তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেশির ভাগ হোটেলে অগ্নিনির্বাপণের নির্দেশিত ব্যবস্থা নেই। বিদেশি এনজিও ও জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশে এসে যেসব ঝুঁকিপূর্ণ হোটেলে ওঠেন, এমন ৩০টি হোটেলের নাম পাঠানো হয়েছে ফায়ার সার্ভিস বিভাগকে। ঢাকার সাতটি পাঁচ তারকা হোটেলসহ ওই ৩০টি আবাসিক হোটেলকে সতর্ক করে ফায়ার সার্ভিস চিঠি দিয়েছে।
Advertisement
ফায়ার সার্ভিস বিভাগের পরিচালক (অপারেশন, মেনটেনেন্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, জাতিসংঘ থেকে আমাদের ই-মেইলে হোটেলের তালিকা দেয়া হয়েছে। তালিকায় থাকা ৩০টির সবগুলোই ঢাকায় অবস্থিত। বিদেশিরা এই ৩০ হোটেলেই বেশি ওঠেন বলে জাতিসংঘ আবাসিক অফিসের ধারণা। এসব হোটেল কর্তৃপক্ষকে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা যথাযথ মানে উন্নীত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, আবাসিক হোটেলের স্থাপনা ও ভবন নির্মাণে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ও সিটি কর্পোরেশনের কাছে দায়বদ্ধ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান। ফায়ার সার্ভিস এককভাবে চেষ্টা চালালে হবে না। যেহেতু তারা ভবন নির্মাণের অনুমোদন দেয় এবং ভবনগুলোর তদারকি করেন, সেহেতু রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনকে এগিয়ে আসতে হবে।
আগুন থেকে বাঁচতে এভাবে এফআর টাওয়ার থেকে নামার চেষ্টা
এ সমস্যা সমাধানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) কী ভূমিকা নিয়েছে, জানতে চাইলে মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের ভেতরে যেসব তারকাখচিত আবাসিক হোটেল আছে, সেগুলোতে নিয়মিত মনিটরিং করা হচ্ছে। অগ্নিনির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের নীতিমালা অনুসরণ করতে নির্দেশনা দেয়া আছে।
Advertisement
ঢাকা শহরের ভেতরে তারকাখচিত হোটেল সম্পর্কে তিনি বলেন, এখানকার পাঁচ তারকা হোটেলগুলো অনেকটা মান রক্ষা করে চলছে। তবে দু-একটি হোটেল আছে যারা পাঁচ তারকা হলেও সব শর্ত পূরণ করেনি।
ফায়ার সার্ভিসের প্রতিবেদন বলছে, দেশে পর্যটন কর্পোরেশনের অনুমোদিত হোটেল সংখ্যা ১৭টি। এগুলো হলো- হোটেল প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও, ইন্টারকন্টিনেন্টাল ঢাকা, রেডিসন ওয়াটার গার্ডেন হোটেল, ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড, হোটেল সারিনা লিমিটেড, ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, লা মেরিডিয়ান ঢাকা, ডরিন হোটেলস অ্যান্ড রিসোর্টস লিমিটেড, রেনেসান্স হোটেলস, সীগাল হোটেল লিমিটেড, ওসেন প্যারাডাইস লিমিটেড, সায়মন বীচ রিসোর্ট লিমিটেড, রেডিসন ব্লু বে ভিউ, রয়্যাল টিউলিপ সী পার্ল বীচ রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা, গ্রান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফ, মম ইন লিমিটেড, হোটেল জাবীর প্যারাডাইস লিমিটেড। ১৭টির মধ্যে নয়টি হোটেল শর্ত পূরণ করলেও আটটি ঝুঁকিতে রয়েছে।
ঝুঁকিপূর্ণ এসব হোটেলের বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের হোটেল অ্যান্ড রেস্তোরাঁ সেলের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত সচিব মিজানুর রহমান বলেন, কেবল অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থাই নয়, মন্ত্রণালয়ের নির্দেশিত সকল শর্তাদি বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন সময়ে চিঠি দেয়া হয়ে থাকে। নির্দেশনা না মানার অভিযোগে ইতোপূর্বে বেশকিছু আবাসিক হোটেলকে জরিমানাও করা হয়েছে।
চকবাজারের অগ্নিকাণ্ডে নিহত হন ৭১ জন
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছাকাছি হওয়ায় বিদেশি ব্যবসায়ীদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট। তবে অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলায় পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় হোটেলটি ঝুঁকিপূর্ণ তালিকাতে রয়েছে। শুধু ঢাকা রিজেন্সি নয়, রাজধানীর ৩২৬টি আবাসিক হোটেলের মধ্যে ৩১৭টিই অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে বলে ফায়ার সার্ভিসের মে মাসের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
অগ্নিনির্বাপণ সক্ষমতা বাড়াতে এসব হোটেলকে এক মাস সময়ও বেঁধে দেয়া হয়। কিন্তু হোটেল কর্তৃপক্ষ সক্ষমতা বাড়াতে পারেনি।
সরেজমিন ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে গিয়ে দেখা যায়, হোটেলটির ১৫ তলাবিশিষ্ট ভবনের পঞ্চম তলা থেকে ১৫ তলা পর্যন্ত বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, ফায়ার অ্যালার্ম ও জরুরি নির্গমন পথ প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে অভিজাত আবাসিক হোটেলটির এ অংশে অগ্নিদুর্ঘটনার ঝুঁকি রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা রিজেন্সি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্টে সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের ব্যবস্থাপক এস এম এইচ আমিরকে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
চলতি বছরের ৩০ মে জারি করা নতুন বিধিমালায় বলা হয়, পাঁচ তারকা হোটেলের কর্মচারীর ৫০ ভাগ সরকার স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হতে হবে। পাঁচ তারকা হোটেলের ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১০০টি কক্ষ থাকতে হবে। তিন থেকে পাঁচ তারকা পর্যন্ত হোটেলগুলোর সব কক্ষ ও কমন স্পেসে এয়ারকন্ডিশনিং ও হিটিং ব্যবস্থা থাকতে হবে। সেই সঙ্গে তিন, চার ও পাঁচ তারকা হোটেলে হেয়ার ড্রায়ার, ওভেন ও সমজাতীয় অন্যান্য ব্যবস্থা, ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ডে বিল দেয়ার ব্যবস্থা, বুফে ব্যবস্থায় সকালের নাশতা, দুপুর ও রাতের খাবার ও মিনি রেফ্রিজারেটর (ছোট ফ্রিজ), প্রতিটি কক্ষে সার্বক্ষণিক ঠান্ডা ও গরম পানির ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া এক থেকে পাঁচ তারকা পর্যন্ত সব হোটেলে সেবার তালিকা ও সেবার মূল্য প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।
বিধিমালায় আরও বলা হয়েছে, পাঁচ তারকার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ১০০টি গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকতে হবে। তিন, চার ও পাঁচ তারকা হোটেলে কনফারেন্স কক্ষসহ প্রতিটি কক্ষ ও উন্মুক্ত স্থানে ওয়াইফাইসহ তারযুক্ত ইন্টারনেট সংযোগ, ফ্যাক্স, ফটোকপিয়ার, প্রিন্টার, স্ক্যানারসহ বিজনেস সেন্টার থাকতে হবে। এসব হোটেলের নিজস্ব ওয়েবসাইট, অনলাইন রিজার্ভেশনের ব্যবস্থাও রাখতে বলা হয়েছে।
গুলশানের অ্যাসকট রেসিডেন্সি হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, এর সাততলা ভবনে নেই প্রয়োজনীয় সংখ্যক বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র ও ফায়ার অ্যালার্ম। এমনকি নেই জরুরি নির্গমন সিঁড়িও। এসব কারণে আবাসিক এ হোটেলটিকে অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে ফায়ার সার্ভিস।
একইভাবে অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষমতার ঘাটতির কারণে হোয়াইট হাউস হোটেল, হোটেল ডি মেরিডিয়ান, কভেনটিনা লেক স্যুারস, গ্র্যান্ড ওরিয়েন্টাল হোটেল, হোটেল ডি ক্রিস্টাল ক্রাউন, বিগস ইন হোটেল, স্টার আবাসিক হোটেল, হানিফ আবাসিক হোটেল, টি ট্রি হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট, হোটেল মেজবান, হোটেল হেভেন টাচ, হোটেল আমীরস, এশিয়া প্যাসিফিক হোটেল, হলিডে প্লানেট, হোটেল দি ঢাকা টু ডে, হোটেল ক্যানারি পার্ক, হোটেল ব্লু-ব্যারি, ইস্টার্ন হোটেল অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টসহ মোট ২৪৭টি হোটেলকে এ তালিকায় রাখা হয়েছে। এসব হোটেলকেও ৩০ দিনের মধ্যে সক্ষমতা বৃদ্ধির নোটিশ দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। কিন্তু তা প্রতিপালন করা হয়নি।
চলতি বছরের ২৮ মার্চ বনানীর এফআর টাওয়ারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় ২৬ জন নিহত হন। আহত হন অনেকে। এর আগে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চকবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৭১ জন নিহত হন। অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজধানী ঢাকায় দুটি বড় অগ্নিকাণ্ডের পর বহুতল ভবনের অগ্নিনিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। রাজধানীর সকল বহুতল ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা এবং আইনগত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখার ঘোষণা দেন গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। মন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী রাজউক ১ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত সংস্থাটির সব জোনে জরিপ চালায়। এ সময় ১০তলার অধিক উচ্চতার এক হাজার ৮১৮টি ভবন সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শন করা ভবনগুলোর মধ্যে বেশির ভাগ বহুতল ভবনের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডের সময় দ্রুত প্রস্থানের জন্য বিকল্প সিঁড়ির ব্যবস্থাও পায়নি সংস্থাটি। যেসব ভবনে এ সিঁড়ি আছে তার অনেকগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের ২০১৬ সালে করা জরিপ অনুযায়ী, রাজউক আওতাধীন এলাকায় ২২ লাখের বেশি ইমারত রয়েছে। এর মধ্যে ৮৪ শতাংশ ছোট ভবন। ১০তলার অধিক তিন হাজার ২৭৩টি বহুতল ভবন রয়েছে। ২০১৬ সালের পর গত তিন বছরে এ সংখ্যা আরও বেড়েছে। সব মিলিয়ে বহুতল ভবনের সংখ্যা সাড়ে তিন হাজারের বেশি।
আরএম/এমএসএইচ/এমএস