মতামত

সিন্ডিকেটহীন জনতার হজমি শক্তি

পেঁয়াজের বাজারে ডাকাতির হোতাদের বিষয়ে কি এফবিসিসিআই কোনো উদ্যোগ নেবে?- ব্যবসায়ীদের পার্লামেন্ট খ্যাত প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিমের কাছে এমন প্রশ্ন ছিল গণমাধ্যমের। জবাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রভাবশালী এই সদস্য সাফ জানিয়েছেন, এটি তাদের দায়িত্ব নয়।

Advertisement

পাল্টা কোনো প্রশ্নে যাননি গণমাধ্যম কর্মীরা। জানতে চাননি, তা’হলে এটা কার দায়িত্ব? তবে, এ প্রশ্নের জবাব রয়েছে মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্যে। তিনি বাজারের এ অস্থির দশার কিছুটা দায়িত্ব দিয়েছেন জনগণের ওপর। একেবারে নিজস্ব ভাষায় বলেছেন, বিভিন্ন সেক্টর নিজস্ব স্বার্থে সিন্ডিকেট করছে। তারা ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু, জনগণের সিন্ডিকেট নেই। থাকলে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হত। ইউনিটি হয়ে প্রয়োজনে একমাস পেঁয়াজ না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে মজুতদাররা জনগণকে ‘বাপ’ ডেকে কম দামে পেঁয়াজ ছাড়তে বাধ্য হতো।

দশ কথার এক কথাই বলেছেন রাষ্ট্রপতি। জনতার সিন্ডিকেট থাকলে কেবল পেঁয়াজ, চাল, লবণ নয়-আরো অনেক সিন্ডিকেটই খান খান হয়ে যেত। অথবা সিন্ডিকেট গড়েই উঠত না। রাজনীতি-অর্থনীতি, সমাজ, পরিবহন, শিক্ষাঙ্গনসহ অনেক অঙ্গনের চেহারাই ভিন্ন হতে পারতো। তা না হওয়ায় জনগণকে শুধু সিন্ডিকেটের কবলেই পড়তে হচ্ছে না। নানা মশকরা-তামাশাও হচ্ছে তাদের নিয়ে। অসহায় পেয়ে কতোজন কতো সবকও দিচ্ছেন। নইলে কি করে তাদের তাচ্ছিল্য করে একজন মন্ত্রী বলে দিলেন- ‘মানুষ প্লেনে উঠতে পারে না। আর আমরা প্লেনে করে পিয়াজ নিয়ে আসছি।’

জনগণকে পেঁয়াজ না খাওয়ার পরামর্শও শুনতে হচ্ছে। বিনাপেঁয়াজে ২২ পদের তরকারি রান্না করতে জানেন বলে শুনিয়েছেন স্বয়ং খাদ্যমন্ত্রী। চাল ছাড়া ভাত রান্নার রেসিপিটা কেবল বাকি রেখেছেন। চালের দাম আসলে বাড়েনি বলেও দাবি করেছেন এই মন্ত্রী। তার মতে, মানুষ এখন মোটা চাল খেতে চায় না। তাই চিকন চালের ওপর একটু চাপ বেড়েছে। কোনো পণ্যের সংকট দেখা দিলে সেটি বর্জনের আহ্বান নিয়েও কিছু কথা থেকে যায়। এমন পণ্য বর্জনের আহ্বানের মধ্যে নিজের ব্যর্থতা আড়ালের কৌশল স্পষ্ট। এটা লুকানো যায় না। নিজের ব্যর্থতার দায় কেন অন্যের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা? নিজের অযোগ্যতা-অক্ষমতা, ব্যর্থতা প্রকাশ করলে তেমন কি ক্ষতি? ক্ষমতা চলে যাবে? মোটেই না। সেই বাস্তবতা বা ভয় বর্তমানে একেবারে অমূলক। বাংলাদেশের অনৈক্যের মানুষের দুর্ভাগ্য, আর ক্ষমতাবানদের জন্য সেটা সৌভাগ্য। নমুনায় মনে হয় সংকটের সময় নেতা-মন্ত্রীরা মানুষকে পরিহাস করে বিকৃত মজা পান। দায় এড়ান। নাগরিকদের কষ্ট নিয়ে তারা কোনো সহানুভূতি প্রকাশ না করে তাচ্ছিল্যতে মেধা খাটান। পেঁয়াজের পাশাপাশি এখন চাল নিয়েও চালাচ্ছেন। মানুষও হজমে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।

Advertisement

দায়িত্বপূর্ন জায়গা থেকে বিরতিহীনভাবেই চলে আসছে এই টাইপের মন্তব্য। এখানে কয়েকটি উল্লেখ করা যায়। যেমন: ১) নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়েনি, গণমাধ্যমের কারণে প্রচার হচ্ছে বেশি ২) দেশে টিভি চ্যানেলের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ধর্ষণের ঘটনা বেশি উঠে আসছে ৩) টেমস নদী দেখতে লন্ডন যেতে হবে না, বুড়িগঙ্গা গেলেই হবে ৪) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কানাডার সমান। ২০৪১ সালে বাংলাদেশ থেকে ঋণ নেবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ৫) ঢাকার পাবলিক টয়লেটগুলো ফাইভস্টার হোটেলের মতো ৬) উপর থেকে দেখলে বাংলাদেশকে সিঙ্গাপুর মনে হয় ৭) বিদেশের মন্ত্রীরা বাংলাদেশের মন্ত্রীদের পেছনে অ্যাপোয়েনমেন্টের জন্য ঘোরেন ৮) ফসলের দাম না পেলে ফ্রান্সেও ক্ষেতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় ৯) বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের কারণে ঘুর্ণিঝড় ফণীর ক্ষতি কমানো গেছে ১০) রিকশা উচ্ছেদের পর হেঁটে চললে স্বাস্থ্য ভালো থাকবে ১১) বিশ্বে একমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই দশ টাকায় ছা, ছপ, ছিঙ্গারা, ছমুছা পাওয়া যায়। এসব মন্তব্যের মুখগুলোর নাম উল্লেখ না করলেও চলে। বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনার সময় মানুষকে শুনতে হয়েছে, সহ্য করতে হয়েছে এসব মন্ত্রী, এমপি, ভিসি, মেয়র মহোদয়দের মন্তব্য। তাতে এখনো বিরতি পড়েনি।

বাক পাণ্ডিত্যকে আমাদের কুমিল্লার কিছু অঞ্চলে থোতার জোর, চোপার জোর বলা হয়। এই জোরাজুরির একটা উৎসব চলছে। বিশেষ করে রাজনীতিতে। কিন্তু আনুষ্ঠানিক প্রতিযোগিতা হয় না। সেটা হলে অনেকে নিজেই হতেন নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী। নিজেকে নিজের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হতো। তা না হওয়ার সুযোগে ক্ষমতা, শিনা, থোতার জোর যার আছে তিনি এগিয়ে চলেন। চলতেই থাকেন। সব ঘায়েল করে দেন নিজস্ব ক্যারিশমায়। এ প্রসঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক, প্রভাবশালী মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের প্রসঙ্গ এসে যায়। তিনি বলেছেন, সবকিছুর ওপরই সরকারের নিয়ন্ত্রণ আছে। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির ওপরও নিয়ন্ত্রণ আছে। নিয়ন্ত্রণ নেই শুধু বিএনপি নেতাদের মুখের ওপর।

এমন মন্তব্যের সপক্ষে তার যুক্তি অবশ্যই রয়েছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বা সিনিয়র যুগ্ন-মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভীর কিছু কথার উদ্বৃতি দিয়ে হানরেডে হানরেড প্রমাণও তিনি দিতে পারবেন। কিন্তু, নিজদলের মন্ত্রী-নেতাদের মুখের ওপরও কি সরকারের নিয়ন্ত্রণ আছে? নইলে কিভাবে তাদের মুখ দিয়ে বের হয় তাচ্ছিল্য ও হাস্যকর বচনগুলো? মানুষই বা কেন হজম করে যাচ্ছে সেগুলো?

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

Advertisement

এইচআর/জেআইএম