‘আমার ঐতিহ্যের বাংলাদেশ, হেরিটেজের বাংলাদেশ’ ২০১৬ সালের ১৭ মে শুরু করেছিলাম দেশের হেরিটেজ ভ্রমণ। এই পরিভ্রমণে জেনেছি অনেক, শিখেছিও অনেক, পেয়েছি কতশত বন্ধু। মনে হয়েছে সব অভিজ্ঞতা যদি লিপিবদ্ধ করতে চাই, তাহলে এক জীবনে সম্ভব নয়। আমার ৪৩ বছরে ট্রাভেলার হিসেবে এটিই সব থেকে বেশি পাওয়া।’
Advertisement
কথাগুলো বলছিলেন ভ্রমণকন্যা এলিজা বিনতে এলাহী। দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ও ট্যুরিজমকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পুরো দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি। ইতোমধ্যে দেশের ৬৪টি জেলা ভ্রমণ করেছেন। দেশ ভ্রমণ শেষে এখন ছুটছেন বিদেশের পথে। তার সর্বশেষ ভ্রমণের তালিকায় রয়েছে ৪৮তম দেশ মিসর।
ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্বপ্রেমী এলিজা তার অনুরাগের জায়গা থেকেই দেশে পর্যটনের সম্ভাবনাময় খাত হেরিটেজ ট্যুরিজম গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয়েছেন।
তিনি ইংরেজি সাহিত্যে গ্র্যাজুয়েশন করেছেন। বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল কর্পোরেশনের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এসএম ইলাহী নেওয়াজ ও জামালপুরের সাবেক সংসদ সদস্য বেগম রহিমা খন্দকারের একমাত্র কন্যা।
Advertisement
‘গ্রিক, রোমান আর ইজিপশিয়ান মিথ আমাকে টেনেছে প্রবলভাবে। ২০ বছর ধরে আমি পৃথিবী ঘুরে বেরিয়েছি। ইউরোপে পথে পথে হেঁটে দেখেছি, তারা কীভাবে নিজেদের ঐতিহ্যকে বিপণন করেছে। ইউরোপের সেই হেরিটেজ পর্যটনই আমাকে আগ্রহী করেছে। আমাদের কী আছে, সেই খোঁজ থেকেই শুরু আমার হেরিটেজ জার্নি।’
‘প্রকৃতি তো অনেক বিশাল। প্রকৃতির মাঝখানে আমি নিজেকে খুঁজে পাই না। বরং ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনা আমাকে মানুষের সীমাহীন ক্ষমতার কথা মনে করিয়ে দেয়। এই যে ধরুন, শের শাহ’র সৃষ্টি গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড- এটি আমাকে আকর্ষণ করে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ঘুরতে ঘুরতে আমার মনে হলো, আমাদেরও কত সমৃদ্ধ ইতিহাস। এখানে এসেছেন বিশ্ব বিখ্যাত ট্রাভেলাররা। এসেছেন ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং, ফা হিয়েন, ভাস্কো দা গামা- এরা সবাই ভারতবর্ষে এসেছেন। আমাদের ইতিহাস তারাই লিপিবদ্ধ করেছেন। সেই ইতিহাস, স্থাপনা আমরা কেন ব্যবহার করছি না?
ভ্রমণ নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ব ট্রাভেলার এলিজা বলেন, ‘পুরো বাংলাদেশ ভ্রমণ শেষ করে সংগৃহীত তথ্য, স্থিরচিত্র ও ভিডিও দেশ ও জাতির উপকারে লাগে সে ব্যাপারে ব্যাপক পরিকল্পনা রয়েছে। যার মধ্যে প্রতিটি বিভাগ এবং সম্ভব হলে জেলাভিত্তিক বই ও স্থিরচিত্র দিয়ে তথ্যবহুল ছবির অ্যালবাম প্রকাশ করতে চাই। টেলিভিশন ও ইন্টারনেটে ভিডিও ডকুমেন্টারি ও ট্রাভেল শো করারও ইচ্ছা আছে।’
বিভাগীয় ও কেন্দ্রীয়ভাবে হেরিটেজ ফেয়ারের মাধ্যমে দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে হেরিটেজ ট্যুরিজমকে বিস্তৃত করার পাশাপাশি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাগুলো যেন সঠিকভাবে সংরক্ষিত হয় সে ব্যাপারে দেশি-বিদেশি সংশ্লিষ্ট মহলের কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে বলে তিনি মনে করেন।
Advertisement
ভ্রমণ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় নানা প্রতিকূলতায় পড়তে হয়েছে তাকে। একজন নারী হিসেবে ভ্রমণ করতে গিয়ে বিভিন্ন জেলায় আবাসন সংকটে পড়তে হয়েছে। এক্ষেত্রে সবসময় একজন পুরুষের সাহায্য নিতে হয়েছে, যা কাজের কিছুটা হলেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। তবে সহযোগিতাও পেয়েছেন তিনি।
প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা শুধু নয়, পেছনের ইতিহাসটাও ট্যুরিজমের অংশ যোগ করে এলিজা বলেন, ‘দেশজুড়ে অবহেলায় ধুঁকতে থাকা হাজারো স্থাপনা আর ঐতিহ্য ঘুরে আমার মনে হয়েছে, ইউরোপের মতোই সমৃদ্ধ সম্ভার আমাদের। অথচ আমাদের ঐতিহ্যগুলো দেখার উপযোগী নয়। অবকাঠামো গড়ে তোলা যায়নি। প্রচার নেই, প্রসার কিছুই নেই। ডিজিটালাইজেশনের সুবিধা আমরা নিতে পারিনি। কোনো অংশেই ইউরোপ থেকে পিঁছিয়ে নেই আমরা। আমাদের নেই সমন্বয়। পর্যটনের সাথে হেরিটেজ ট্যুরিজমের সমন্বয়, মেলবন্ধ- কোনোটাই আমাদের নেই।’
‘শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা নয়, এর পেছনের ইতিহাসটাও এই ট্যুরিজমের অংশ। কোন এলাকার পোশাক, খাবার, মিষ্টি, পার্বত্য অঞ্চলের গয়না- এগুলোও হেরিটেজের অংশ। আমি কুড়িগ্রামের একটা অঞ্চলে দেখেছি, সেখানকার মেয়েরা নাকে পাঁচটা ফুটো করে। তার একটাতে হয়তো তার শাশুড়ি নথ পরিয়ে দিচ্ছেন, অন্যটাতে স্বামী দিচ্ছে কিংবা ভাসুর দিচ্ছে। তো এগুলো কত মজার! এগুলোকেই সামনে তুলে ধরতে হবে।’
আমাদের বৈচিত্র্য আছে। বৈচিত্র্য, সমৃদ্ধি, প্রাচীনত্ব- যাই বলি না কেন কোনো অংশেই কম নেই। এগুলোকে গোছাতে হবে। গোছানোর কথা বলতেই, সম্ভাবনা আর চ্যালেঞ্জ খুঁজতেই আমার এই হেরিটেজ ভ্রমণ।
‘হেরিটেজ ট্যুরিজম ধারণাটাই গড়ে ওঠেনি, আমি সরেজমিনে ভ্রমণ করতে গিয়ে যে সমস্যাগুলো পেয়েছি, তাতে সব থেকে বড় সমস্যা আবাসন। নিরাপত্তা সমস্যা আছে। আছে তথ্যের অপ্রতুলতা। প্রত্নতত্ত্ব স্থাপনাগুলো দেখার উপযোগী করতে হবে। কারণ এক একটা রাজবাড়ীর এতই ভগ্নদশা! শুধু রাজবাড়ি কেন, অর্ধ খননকৃত বেশকিছু বৌদ্ধবিহার দেখেছি আমি। বৌদ্ধবিহার বললেই শুধু পাহাড়পুরের কথা আমরা বলি। তার চেয়েও প্রাচীন সীতাকোট বিহার, যেটি পাঁচ শতকে তৈরি।’
‘আরো প্রাচীন ভাতের ভিটা বৌদ্ধবিহার আমি পেয়েছি মাগুরায়। অল্প কিছু খনন করা হয়েছে এই বিহার। এরপর ঢেকে দেয়া হয়েছে। গাইবান্ধায় আরেক প্রাচীন বৌদ্ধবিহার দেখেছি, যার খবর স্থানীয়রা জানেই না। এটি ১৯৫৯ সালে খনন করা হয়েছিল। এসব এলাকায় গিয়ে আমি দেখেছি, ঐতিহ্য যে পর্যটনের অংশ হতে পারে তার ধারণাই স্থানীয় প্রশাসনের নেই।’
‘ঘোষণা করা হোক হেরিটেজ ট্যুরিজম ডে, আমি দেশজুড়ে ঘুরেছি, হেরিটেজ ট্যুরিজম ধারণাটাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। আমার পুরো ভ্রমণ, আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবি, ভিডিও আকারে দিয়েছি। আগামীতে একটা হেরিটেজ ফেয়ার করতে চাই। যেখানে এই খাত নিয়ে বিশেষজ্ঞরা কথা বলবেন। আলোকচিত্রে তুলে ধরা হবে হেরিটেজ ট্যুরিজম। আরো নানা কিছু।’
“আমি চাই, পর্যটন দিবসের মতোই একটা হেরিটেজ `ট্যুরিজম ডে’ ঘোষণা করা হোক। প্রতি বছর যদি দিনটি পালিত হয় তবে তা দেশের পর্যটনকে নতুন দিশা দেবে, বিশ্বাস করি।”
এমআরএম/এমএস