দেশজুড়ে

বন বিভাগের তালিকায় সাড়ে ৪ হাজার ভাঙা গাছ, বাস্তবে কয়টি?

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতে লন্ডভন্ড হয়েছে উপকূলীয় এলাকা। ঝড়ের প্রকোপে ভেঙে গেছে বহু কাঁচা ঘরবাড়ি, ভেসে গেছে মাছের ঘের, ভেঙেছে উপকূলীয় এলাকার গাছপালা। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের আঘাতের পর প্রকাশ পেয়েছিল, বুলবুলের মূল আঘাত হেনেছে সুন্দরবনে। সুন্দরবনের কারণেই শক্তি হারিয়ে লোকালয়ে দুর্বল আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল।

Advertisement

গত ১০ নভেম্বর রোববার ভোররাত ৪টার দিকে। ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের এ তাণ্ডব চলে সকাল ৯টা পর্যন্ত। সাতক্ষীরার উপকূলীয় এলাকায় ৫০ হাজার কাঁচা ঘরবাড়ি আংশিক ও সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। ভেসে যায় হাজার হাজার বিঘা মাছের ঘের। গাছ উপড়ে পড়ে উপকূলীয় এলাকায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা।

বুলবুলের তাণ্ডবে যদি উপকূলীয় এলাকা এভাবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় তবে মূল আঘাত পড়েছে সুন্দরবনে। বর্তমানে সুন্দরবনের পরিস্থিতি কী? এমন প্রশ্ন দেখা দেয় পরিবেশবিদসহ জনমনে। বন বিভাগও তড়িত গতিতে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে জরিপের কাজ শুরু করে।

গত বৃহস্পতিবার (১৪ নভেম্বর) সন্ধ্যায় বন বিভাগের খুলনা কার্যালয় থেকে প্রধান কার্যালয়ে একটি জরিপ প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

Advertisement

সংশ্লিষ্ট স্টেশন ও ফাঁড়ির সাহায্যে করা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বুলবুলের প্রভাবে সুন্দরবনে ৪ হাজার ৫৮৯টি গাছ উপড়ে পড়েছে। অবকাঠামোগত ক্ষতি হয়েছে ৬২ লাখ ৮৫ হাজার টাকার। বেশি ক্ষতি হয়েছে সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগে।

সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি পূর্ব ও অপরটি পশ্চিম বিভাগ সুন্দরবন। পশ্চিম সুন্দরবনের আওতাধীন সাতক্ষীরা ও খুলনার অংশ। বাগেরহাট ও বরিশাল অংশ পূর্ব বন বিভাগ।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ অর্থাৎ সাতক্ষীরা ও খুলনার অংশে গাছ উপড়ে পড়েছে ৪ হাজার ২টি। আর্থিকভাবে ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ৪১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এছাড়া পশ্চিম বন বিভাগের আওতায় বিভিন্ন ফরেস্ট অফিসের ক্ষতির পরিমাণ ধরা হয়েছে ২৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা।

অন্যদিকে, পূর্ব বন বিভাগ অর্থাৎ বাগেরহাট ও বরিশাল অংশে গাছ উপড়ে পড়েছে ৫৮৭টি। ৮ লাখ ৬২ হাজার টাকা গাছের আর্থিক মূল্য ধরা হয়েছে। অবকাঠামোগত ক্ষতি ৩৯ লাখ ৬০ হাজার টাকা।

Advertisement

তবে সরেজমিনে সাতক্ষীরা ও খুলনা অংশের পশ্চিম সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কারণে সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির হিসেব মেলে না। গাছপালা ভাঙার কোনো চিহ্নও চোখে পড়েনি। তবে গাছের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা কীভাবে নিরূপন করল বন বিভাগ? বন বিভাগ প্রতিবেদনে বলছে, ৪ হাজার ৫৮৯টি গাছ উপড়ে গেছে। উপড়ে পড়া সে গাছগুলোই বা গেল কোথায়?

গত ১৮ নভেম্বর (সোমবার) ২০ জনের একটি দলের সঙ্গে সুন্দরবনে প্রবেশ করেন সাতক্ষীরা শহরের মুনজিতপুর এলাকার মৃত শওকত আলীর ছেলে আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ। টানা পাঁচ দিন সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ফিরে আসেন গত শুক্রবার (২২ নভেম্বর)।

সুন্দরবন থেকে ফিরে আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ জাগো নিউজকে বলেন, ভ্রমণের উদ্দেশে আমরা ২০ জন একত্রে সুন্দরবনে গিয়েছিলাম। সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন কটকা, কচিখালী, জামতলা, দুবলারচর, মান্দারবাড়ি, কালিরচর, ডিমেরচরসহ আরও বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখেছি। সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের মধ্যে সকল পয়েন্টে ঘুরে দেখেছি। তবে ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের কোনো প্রভাব চোখে পড়েনি। নতুন করে কোথাও কোনো গাছপালা ভেঙে পড়তে দেখিনি। তবে কিছু গাছপালা ভাঙা বা উপড়ে পড়া রয়েছে সেগুলো আগেও ছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ফনির সময়কার কিছু গাছপালা ভাঙা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, এছাড়া নদীর পাড়ের হাতে গোনা কিছু গাছ উপড়ে পড়া দেখেছি। সুন্দরবনের কালিরচরে ২-৩টি গাছের ডাল ভাঙা দেখেছি। এছাড়া কিছু গাছের গোড়ায় মাটি না থাকায় সেগুলো উপড়ে পড়েছে। বুলবুলের প্রভাবে গাছের ক্ষতি হয়নি। গাছপালা বা ঘরবাড়ির ক্ষয়ক্ষতি যেটুকু সেটুকু উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় হয়েছে। সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হয়নি।

একই সময়ে বিশেষ ডিউটিতে সুন্দরবনে পাঁচ দিন সময় পার করেছেন র‌্যাব-৬ এর আওতাধীন সাতক্ষীরা কোম্পানির এসআই শামীম হোসেন ও তার সঙ্গীয় তিন র‌্যাব সদস্য।

র‌্যাবের এসআই শামীম হোসেন বলেন, সুন্দরবনকে ঘিরে একটি চলোচ্চিত্র নির্মিত হবে। দস্যু ও র‌্যাবকে ঘিরে নির্মাণ হবে চলচ্চিত্রটি। চলচ্চিত্র নির্মাণকে ঘিরে সুন্দরবনের বিভিন্ন পয়েন্ট ঘুরে দেখেছি। যেখানে শ্যুটিংয়ের স্পট করা হয়েছে। সেখানে যাতায়াত ও পরিবেশ পরিস্থিতি দেখার জন্য আমাকে পাঠানো হয়েছিল। ডিসেম্বরের মধ্যে যেকোনো সময়ে শ্যুটিং শুরু হবে।

তিনি বলেন, সুন্দরবনে বুলবুলের প্রভাবে তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতি দৃষ্টিতে আসেনি। তবে কিছু গাছ উপড়ে পড়া দেখেছি।

সুন্দরবন ঘুরে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা দেয়া বন কর্মকর্তাদের একজন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা বুড়িগোয়ালীনি বন স্টেশন কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, আমরা সুন্দরবনে ঘুরে ঘুরে ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করে ঊর্ধ্বতন অফিসে পাঠিয়েছি। গাছপালা ভাঙা দেখে এ তালিকা করা হয়েছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত সংখ্যা আমি দিতে পারব না।

সরেজমিনে সুন্দরবন ঘুরে গাছপালা ভাঙার কোনো দৃশ্য চোখে পড়েনি তবে গাছপালা ভাঙার তালিকা কীভাবে করলেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কীভাবে তালিকা করেছি তার ব্যাখ্যা আমি আপনাকে দেব না। তালিকা দিয়েছেন বিভাগীয় কর্মকর্তা। আপনি তার সঙ্গে কথা বলেন।

ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর সুন্দরবন ঘুরেছেন বন সংরক্ষক দফতর খুলনা সার্কেলের উপ বন সংরক্ষক কবির হোসেন পাটোয়ারী। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড় বুলবুলের পর আমি সুন্দরবনের হিরোন পয়েন্ট পর্যন্ত গিয়েছি। তবে উল্লেখযোগ্য কোনো ক্ষয়ক্ষতির দৃশ্য চোখে পড়েনি। ক্ষয়ক্ষতির যে তালিকা করা হয়েছে সে বিষয়ে আমার কাছে কোনো তথ্য নেই।

বন সংরক্ষক দফতর খুলনা সার্কেলের বন সংরক্ষক মো. মঈনুদ্দিন খান জাগো নিউজকে বলেন, ফিল্ড অফিসারদের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল পরবর্তী সুন্দরবনের ক্ষয়ক্ষতির তালিকা প্রস্তুত করে প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। ৪ হাজার ৫৮৯টি গাছ উপড়ে গেছে। ফিল্ড অফিসাররা সরেজমিনে দেখে এ তালিকা করেছেন।

প্রতিবেদনে গাছপালা ভাঙার কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে গাছ ভাঙার দৃশ্য নেই কেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, নদীর পাড়ে বা যেসব গাছের গোড়ায় মাটি নেই সে গাছগুলো উপড়ে গেছে। সেগুলো আমরা তালিকায় ধরেছি। এছাড়া গরান ও গেওয়া গাছ বেশি ক্ষতি হয়েছে। ফনির সময়ে উপড়ে পড়া গাছগুলো নতুন এ তালিকায় ধরা হয়নি। সামগ্রিক বিবেচনায় সুন্দরবনে খুব বেশি ক্ষতি হয়নি।

আকরামুল ইসলাম/এমবিআর/পিআর