মতামত

মিথিলা এবং গুলতেকিন, সমাজ পরিবর্তনের দিশারী

কিছুদিন ধরেই ফেসবুকে, মিডিয়ায় ঝড় যাচ্ছে। প্রথম ঝড় গেল মিথিলাকে নিয়ে, তারপর গুলতেকিনকে নিয়ে। মিথিলার তৎকালীন প্রেমিকের সাথে কিছু অন্তরঙ্গ ছবি সোশ্যাল মিডিয়াতে ভাইরাল হয়েছে। মিথিলা কি পাপ করেছে নাকি পূণ্য? এমন কাজ কিভাবে করল, এই সব আলোচনায় আমি যাব না। এটা যার যার ব্যক্তিগত বিশ্বাসের উপর, জীবনাদর্শের উপর নির্ভর করে।

Advertisement

কে কার সাথে প্রেম করবে, সেই সম্পর্কের সীমানা থাকবে কিনা, সেই সীমানা কতখানি এটা তার ব্যাপার। তবে, আমি বললেই তো হবে না। সেলিব্রেটিরা, সব সময়ই জনগণের সম্পত্তি। তাদের ব্যক্তিগত বলে আসলে কিছু থাকে না। এটা আমাদের দেশে বলে না, পৃথিবীর সব দেশেই খুব সাধারণ ব্যাপার। সাধারণ মানুষ সেলিব্রেটিদের পূজা করবে, তাদের মত হতে চাইবে চলনে, বলনে, দর্শনে। তাদের জীবনের সব কিছুর উপরে, খুঁটিনাটি সব ঘটনার উপরে চোখ থাকে তাই সবার। আর পান থেকে চুন খসলে শুরু হয় কানাকানি, জানাজানি, শোরগোল।

পত্রিকার কাটতি বাড়ে, মিডিয়ায় ট্রাফিক বাড়ে, ভিউ বাড়ে। আর সেই ঘটনার সাথে যদি কোনভাবে যোগ থাকে কিঞ্চিত আদিরসাত্মক গন্ধ, প্রেম, রোমান্স, পরকীয়া, বিয়ে তাহলে সেই খবরের চাহিদা সব চেয়ে বেশি। তাই সুন্দরী মিথিলা, যে হয়তো অনেকেরই আরাধ্য, উপরন্ত ডিভোর্সি, সে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়েছে, কিঞ্চিত দৈহিক ব্যাপার স্যাপারের আলামত পাওয়া গেছে এই খবর হট কেক হবেই।

আমি এতে একটুও অবাক হই নি। বিরক্ত হলেও আসলে সত্য কথা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। মিথিলার মত হাজারটা ঘটনা ঘটছে, যেটা মেয়েটার সাথে রীতিমত একটা অন্যায়, অনেকক্ষেত্রে উদ্দেশ্য প্রণোদিত ব্ল্যাকমেল, সেখানেও এত কথা হয় না, কারণ সেসব মেয়েরা সেলিব্রেটি না। মিথিলা এবং প্রভার ক্ষেত্রে হয়, হবে, সব দেশে, সব কালে। মিথিলা এবং প্রভারা সেটা জানেন ভালো করেই। তবে, আমাকে চমকে দিয়েছেন মিথিলা। নিজের সব কাজের দায়িত্ব নিজে নিয়েছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন একটুও রাখ ঢাক না করে।

Advertisement

এমন কয়টা মেয়ে পারে? যত শিক্ষিত আর প্রতিষ্ঠিতই হোক না কেন। যতই খুঁটির জোর থাকুক না কেন। উপরন্ত, তিনি মা, একটি কন্যা সন্তানের মা। তাকে নিয়ে সমাজ কী ভাববে, তার কী ভবিষ্যৎ, তার মেয়ের কী ভবিষ্যৎ এসব ভাবেননি। তাকে আর কেউ গ্রহণ করবে কিনা, তার চার পাশের পরিচিত সমাজ, বন্ধু, কর্মস্থলের সবাই তাকে, তার পরিবার নিয়ে কী ভাববে, কী বলবে সব কিছুকে উপেক্ষা করে এক সন্তানের মা একজন ডিভোর্সি নারীর জন্য এভাবে খোলামেলাভাবে কথা বলা অত্যন্ত সাহসের পরিচয়। এই ঘটনা থেকে আমার মনে হয়েছে সমাজে আসলে পরিবর্তন এসেছে। একজন মিথিলা হলেও তার প্রতি ঘটে যাওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছে লোকলজ্জার ভয়ে ধামাচাপা না দিয়ে। সাইবার ক্রাইমের শিকার বিভিন্ন মেয়েরা যদি এই ঘটনা থেকে সাহস পায়, সেটাই হবে মিথিলার সাফল্য।

এবার আসি গুলতেকিনের কথায়। একজন ডিভোর্সি মহিলা যদি বিয়ে করে, সেখানে দোষের কী আছে? ডিভোর্সিদের যে বিয়ে হয় না তা কিন্তু নয়। বাচ্চাসহও হয়, তবে আপেক্ষিকভাবে কম। কিন্তু ছাপ্পান্ন বছর বয়সে? নানি হয়ে যেয়ে নানির বিয়ে? না, এটা খুব বিরল। এক্ষেত্রেও তিনি সেলিব্রেটি, তিনি শুধু গুলতেকিন নয়, তিনি প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদের প্রাক্তন স্ত্রী। এই বয়সে নাতি, নাতনি মেয়ের জামাইকে নিয়ে, নিজের পছন্দের মানুষের গলায় মালা পরিয়েছেন তিনি, এটা বাঙালি নারীকে মানায় না। এই বয়সে শুধু ধর্ম, কর্ম, মৃত্যু চিন্তা করবেন। যে মানুষটা একা একা এতোগুলো বছর ছেলে মেয়ে লালন পালন করে তাদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাকে আরও একাকীত্ব গ্রাস করুক আর আমরা তার একাকীত্ব আর দুখকে মহিমান্বিত করি। তা না করে, তিনি জীবনের স্বাভাবিক গতিকে আলিঙ্গন করেছেন।

মানুষ কী বলবে, কী ভাববে তা নিয়ে চিন্তিত হননি। এক্ষেত্রে চমৎকার উদাহরণ সৃষ্টি করেছে তার শিক্ষিত পুত্র কন্যা জামাতা। যারা আনন্দিত চিত্তে এই বিয়েতে মত দিয়েছেন, অংশ নিয়েছেন। যদিও মা, বাবার বিয়ের ব্যাপারে হয়তো সন্তানদের মতামত বাধ্যতামূলক নয়, তবু সত্যিকারভাবে মা, বাবার কথা ভাবলে, তাদের নিঃসঙ্গতার কথাও তাদের ভাবার কথা আর সন্তানরা খুশি থাকলে বাবা, মায়েরও ভাল লাগে। গুলতেকিনের এই বিয়ে আমাদের দেশে অসংখ্য বয়স্ক, নিঃসঙ্গ বিধবা, ডিভোর্সি নারীদের ক্ষেত্রে, তাদের পরিবারের ক্ষেত্রে উদাহরণ হয়ে অনুপ্রেরণা জোগাবে। সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে এটিও একটি বড় ধাপ।

মিথিলা এবং গুলতেকিন, দুই অসম বয়সী সাহসী নারী এবং পেছনে থাকা তাদের সাহসী পরিবারকে অভিনন্দন।

Advertisement

এইচআর/পিআর