আচ্ছা, জাতীয়, বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ে বাস, মিনিবাস মালিক সমিতির নেতৃত্বে কারা? তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী? সড়ক পরিবহন মালিক, শ্রমিক সংগঠনের মূল নেতৃত্বে আসতে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা লাগেই। আর সরকারি দলের প্রত্যক্ষ সমর্থন, পরোক্ষ সহযোগিতা ছাড়া এসব সংগঠনের নেতৃত্বে থাকা যায় না। সরকারের আইনকে চ্যালেঞ্জ করে সরকার ও সাধারণ মানুষকে জিম্মি করতে পরিববহন ধর্মঘট ডেকেছে কারা? তাদের শক্তির উৎস কী? রাষ্ট্রের চেয়েও কি তারা শক্তিশালী?
Advertisement
অসম্ভব। এটা হতেই পারে না। রাষ্ট্রযন্ত্র এত দুর্বল নয় যে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের কতিপয় স্বার্থান্বেষী চাইলেই সরকারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো যায়। তাহলে কি সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে? বলা নেই, কওয়া নেই আচমকা পরিবহন ধর্মঘট ডেকে সাধারণ মানুষকে দুর্ভোগে ফেলার পেছনে রহস্য কী? সরকার সম্পর্কে জনগণের ধারণা নেতিবাচক করা। এমন একটি মনোভাব জনগণের মধ্যে তৈরি হতে দেওয়া যে সরকারের ব্যবস্থাপনা সংকট প্রকট! তাহলে কারা এর সঙ্গে জড়িত? নতুন যে সড়ক পরিবহন আইন হয়েছে সেটি প্রণয়নের সঙ্গে খোদ পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের প্রতিনিধিরাও জড়িত ছিল।
যতদূর জানি, আইন প্রণয়নের আগে ২৭ বার বিভিন্ন বৈঠকে তারা তাদের মতামত দিয়েছে। আর যখন আইনটি সংসদে পাস হয়ে কার্যকর হতে যাচ্ছে বাস্তবে তখনই বাধা দিচ্ছে তথাকথিত পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। এরা আসলে কারা? পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের নেতৃত্বে যারা আছেন তাদের আদ্যপান্ত পরিচয় জনসম্মুখে আসুক। এরা আসলে সরকার, সরকারি দল বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দল মতের সমর্থক আমাদের আও খোলাসা করে জানা প্রয়োজন।
৬৪ জেলায় সরকারি দলের সংসদ সদস্যরা যদি একযোগে এই পরিবহন মালিক শ্রমিকদের সহযোগিতা না করেন অথবা জনস্বার্থে তাদের কর্মসূচির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন তাহলে কি তাদের টিকতে পারার কথা? কিন্তু তারা সেটি নিচ্ছেন না। সংসদ সদস্যদেরকে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে নির্দেশনা দেওয়া হোক। সাধারণ মানুষকে কথায় কথায় এভাবে ভোগান্তিতে ফেলা একটি ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। আর এই ধর্মঘট অস্ত্র উপর্যুপরি ব্যবহার করে সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনই। আমি নিশ্চিত সরকারি প্রশাসনের সঙ্গে স্থানীয় সাংসদদের সমর্থন হারালে পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের বাড়-বাড়ন্ত কমবে। আর তাতে উপকৃত হবে সাধারণ মানুষ। তবে সর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে সেই ভূত কি আর তাড়ানো যাবে?
Advertisement
পেঁয়াজের ঝাঁজে গোটা দেশ যখন উত্তপ্ত তখন বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলাম দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই অবিশ্বাস্য রকমের নিশ্চুপ, নিষ্ক্রিয়। পেঁয়াজ নিয়ে আলোচনা, সমালোচনায় সরকার যখন নানা মহলে প্রশ্নবিদ্ধ তখন শতভাগ সরকারি আনুক‚ল্য নিয়ে এফবিসিসিআই নেতৃত্বে বসা ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দকে কোনো দৌড়ঝাঁপ করতে কেউ দেখেছেন? বিষয়টি কি এতটাই অবহেলাযোগ্য? এফবিসিসিআই নেতৃবৃন্দ নড়েচড়ে বসলেই পেঁয়াজের মূল্য বৃদ্ধি রোধ হয়ে যাবে বিষয়টি মোটেও এরকম নয়। কিন্তু যে ইস্যুতে বাজার সরগরম, সরকার প্রতিনিয়ত প্রশ্নের মুখে ব্যবসা-বাণিজ্যের সেই ইস্যুতে এফবিসিআই নেতৃত্ব পুরোমাত্রায় সক্রিয় থেকে নিজেদের ইতিবাচক অস্তিত্ব জানান দেবে এটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু সেটি না করায় এফবিসিসিআইসহ বাণিজ্য সংগঠনগুলো অদূরদর্শিতা, অপরিপক্ষতা, অনভিজ্ঞতা ও দায়িত্বহীনতাই প্রকাশ পেয়েছে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনের নেতৃত্ব কি যোগ্য সংকটে রয়েছে? সরকারের নীতি নির্ধারকদের হস্তক্ষেপে প্রত্যক্ষ ভোট ছাড়া নির্বাচিত এফবিসিসিআইয়ের নেতৃত্ব নিয়ে শুরুতেই যে কানাঘুষা ছিল পেঁয়াজের মতো একটি নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে নিজেদেরকে অপ্রাসঙ্গিক করে রাখা সেই কানাঘুষাকেই প্রতিষ্ঠিত করল। অর্থের বিনিময়ে এফবিসিসিআইকে কেউ কেউ পরিচালক, সভাপতি পদ লাভ করেছেন এমন অভিযোগ আগে থেকেই আছে। এফবিসিসিআই পরিচালকেরা সিআইপি মর্যাদা পান। বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে মর্যাদার সঙ্গে আমন্ত্রণ পান, বিমানবন্দরে পান ভিআইপি সুবিধা। প্রশ্ন, সত্যিকারের ব্যবসায়ী নেতৃত্ব কি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এফবিসিসিআইতে? যদি হতো তাহলে ব্যবসায়ী আর ভোক্তার মধ্যে আজ যে মুখোমুখি সম্পর্ক সেখানে সরকারকে ইতিবাচক সহযোগিতা করতে পারত এফবিসিসিআই।
শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনটির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে নেতৃত্ব বসানোর ক্ষেত্রে যোগ্যতা প্রকৃত পক্ষে সুযোগ পাচ্ছে কি না সেটি আরও সতর্কভাবে দেখা প্রয়োজন। সরকারের আনুক‚ল্য নিয়ে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি শীর্ষ পদে কেউ কেউ যদি নিজের যোগ্যতাহীনতার কারণেই সরকারের বিপাকে পড়ার কারণ হয় সেটি নিশ্চয় দুঃখের, কষ্টের। কিন্তু যখনই কোনো সংকট সৃষ্টি হচ্ছে তখনই শীর্ষ পদে আসীন কারো কারো দায়িত্বহীনতা সরকারকে আরও বিপাকে ফেলছে। বিভিন্ন দ্রব্যের সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধিতে বাণিজ্যমন্ত্রী দায় নিতে রাজি নন। নিন্মমানের রেললাইন, রেল দুর্ঘটনায় নিজ মন্ত্রণালয়ের দায় দেখছেন না রেলমন্ত্রী। প্রবাসে কর্মসংস্থান কমে যাওয়া, বিদেশে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি না হওয়া, সৌদি আরবসহ আরও কয়েকটি দেশে কর্মরত বাংলাদেশি নারী শ্রমিকদের শারীরিক মানসিক হয়রানিতেও নিজেদের দায় নেই বলেই মনে করে পররাষ্ট্র ও প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী। ডেঙ্গু রোগের ভয়াবহ প্রকোপেও দায় স্বীকার করেনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা মন্ত্রণালয়। আর এডিস মশার ভয়াবহ বিস্তারেও এলজিআরডি মন্ত্রণালয় এটি তাদের দায় নয়।
হঠাৎ চালের মূল্য একটু চড়া। খাদ্যমন্ত্রী মনে করছেন, চালের মূল্য বৃদ্ধির কোনো কারণ নেই। এটি পুরোপুরি কারসাজি। পর্যাপ্ত মজুদ সত্ত্বেও সারাদেশে দু’একদিন লবণের মূল্যও ছিল বেশ চড়া। স্রেফ গুজবের ওপর ভিত্তি করে লবণ সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে সাধারণ মানুষের শত শত কোটি টাকা। এখন এই গুজব নিয়ন্ত্রণের দায় কার? কোথায় চলেছি আমরা? চার দিকে হচ্ছেটা কী? দেশের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এত এত ভালো কাজ করছেন, কিন্তু যোগ্য সহযোগিতা সহকর্মীদের থেকে পাচ্ছেন কি? এই প্রশ্ন জোরেশোরে উঠেছে। টিম হাসিনা কতখানি কার্যকর, যোগ্যতাসম্পন্ন? ক্যাপ্টেন শেখ হাসিনা যোগ্যতম। কিন্তু সহযোগীরা!
Advertisement
লেখক : সম্পাদক, দৈনিক ঢাকা টাইমস, ঢাকা টাইমস টোয়েন্টিফোর ডটকম ও সাপ্তাহিক এইসময়।
এইচআর/পিআর