বিশেষ প্রতিবেদন

আর কত শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরলে সরকারের ঘুম ভাঙবে?

অ্যাডভোকেট সালমা আলী। মানবাধিকার আইনজীবী। সাবেক নির্বাহী প্রধান, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতি। নারীর অধিকার ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করছেন দীর্ঘদিন ধরে। বিশেষ করে নারী পাচাররোধ এবং প্রবাসী নারী শ্রমিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখছেন এ মানবাধিকার নেত্রী।

Advertisement

সম্প্রতি প্রবাসী নারী শ্রমিকদের ওপর নির্যাতনের প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। আলোচনায় গুরুত্ব পায় দেশের নারী উন্নয়নও। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : আগের পর্বে নারী শ্রমিক বিদেশে পাঠানোর বিরোধিতা করেছেন। যেসব দেশ শ্রমিক নিচ্ছে, তাদেরও শর্ত থাকে নারী শ্রমিক পাঠানোর। নারীদের পাঠানোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে শ্রমবাজার হাতছাড়াও হতে পারে।

সালমা আলী : এটি ভুল ধারণা। আমরা নারী পাঠানোর বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছি না। মনে রাখতে হবে, নারীরা সেখানে ভিক্ষে করতে যায় না। শ্রম দিতে যায়। আমরা শুধু শ্রমের মর্যাদা চাইছি। এটি দুটি দেশের মধ্যকার বোঝাপড়ার ব্যাপার। বাংলাদেশ সরকার কেন সে দরকষাকষি করতে পারবে না। নারীরা সিঙ্গাপুর, হংকংয়ে গিয়ে শ্রম দিচ্ছে। সেখান থেকে তো এত অভিযোগ আসছে না। দক্ষরা যাচ্ছেন সেখানে। তারা মর্যাদা পাচ্ছেন। তারা যথাযথ আইনি সহায়তা পাচ্ছেন। দূতাবাসে গিয়ে অভিযোগ করতে পারছেন, সহায়তা পাচ্ছেন।

Advertisement

জনশক্তি রফতানি ব্যুরো থেকে বলা হয়, নারীরা বিদেশে গিয়ে কাজ করতে চায় না। আমি জানতে চাই, সেই নারীদের কী বোঝানো হয়? সুরক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা আছে? কোনো ধরনের পরামর্শ নেই, সহায়তা নেই। জাগো নিউজ : কী কারণে সহায়তা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন? সালমা আলী : যাদের কাছে শ্রমিক যাচ্ছে, তাদের সঙ্গে যদি সমানে সমানে দাঁড়িয়ে দরকষাকষি করতে না পারি, তাহলে এ নির্যাতন হবেই। যদি নিজেদের অবস্থান শক্তভাবে উপস্থাপন করতে না পারি, তাহলে কোনোভাবেই এ ধরনের চুক্তি করা যাবে না। নির্যাতন হবে, যৌন নির্যাতন হবে, গর্ভবতী হবে, আত্মহত্যা করবে অথচ নারীরা সহায়তা পাওয়ার কোনো অধিকার রাখবে না, এ বর্বরতা তো কোনোভাবেই সহ্য করা যায় না।

নির্যাতনের শিকার হয়ে নারীরা আত্মহত্যা করছেন অথচ মেডিকেল রিপোর্টে বলা হচ্ছে স্বাভাবিক মৃত্যু। মেডিকেল রিপোর্টটি পর্যন্ত সঠিকভাবে নিতে পারছে না আমাদের দূতাবাসগুলো। অথবা পেলেও তারা চেপে যাচ্ছে। নারী শ্রমিকরা আত্মহত্যা করছে, দূতাবাসগুলো স্বাভাবিক মৃত্যু বলছে। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই দূতাবাসের কর্মকর্তারা এমন আচরণ প্রকাশ করতে পারছে বলে মনে করি। শুধু নারী নয়, পুরুষ শ্রমিকদেরও সুরক্ষা দেয়ার জন্য পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বড় দায়িত্ব রয়েছে।

জাগো নিউজ : আইনি কোনো জটিলতা দেখছেন কি-না? সালমা আলী : আমি তা মনে করি না। আন্তর্জাতিক শ্রম আইনে স্পষ্ট করে শ্রমিকের অধিকারের কথা বলা আছে। সেই অধিকারের ভিত্তিতেই দুটি দেশ চুক্তি করে। অথচ সে আইনের প্রয়োগ নেই।

আমরা যদি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে না পারি, তাহলে শ্রমিক পাঠানোর তো দরকার নেই। শ্রমের নামে ক্রীতদাস বানানোর দরকার নেই। আর কত শ্রমিক লাশ হয়ে ফিরলে সরকারের ঘুম ভাঙবে? একের পর এক লাশ হয়ে ফিরছে, অথচ একটি ঘটনা নিয়েও আমরা চ্যালেঞ্জ করি না।

Advertisement

জাগো নিউজ : কী চ্যালেঞ্জ নিতে পারে সরকার?সালমা আলী : অন্তত বাংলাদেশে নিযুক্ত দূতাবাসের কর্তাদের ডেকে কৈফিয়ত চাইতে পারে সরকার। কারণ ওই সব দেশে শ্রমের বাজার আছে বলেই শ্রমিকরা যাচ্ছে। চাহিদা না থাকলে জোর করে যাওয়া সম্ভব হতো না। চুক্তির মধ্য দিয়ে নিয়ে এভাবে নির্যাতন কেন, তার জবাব চাইতেই পারে।

প্রবাসে নারী শ্রমিকদের দেহ ব্যবসায় ঠেলে দেয়া হচ্ছে। তারা শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের শিকার। দেশে ফিরেও তারা সংসার টিকাতে পারছে না। মানসিকভাবে আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। পরিবারে থাকতে পারছে না। এ পরিস্থিতি কোনোভাবেই সুষ্ঠু শ্রমের পরিবেশ না।

কার মাধ্যমে গিয়েছে, কার কাছে গিয়েছে, তাদের নাম ঠিকানাও বলতে পারে না ভিকটিমরা। এটি অবশ্যই জবাবদিহিতার মধ্যে আনা সম্ভব, যদি সরকার চায়। পরিস্থিতি আরও বেসামাল হওয়ার আগে সরকারকেও জবাবদিহি করা উচিত বলে মনে করি।

জাগো নিউজ : নারী নির্যাতন দেশেও ঘটছে। প্রবাসে নারী নির্যাতনের ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকেও এমনটি বলা হচ্ছে। সালমা আলী : হ্যাঁ, দেশের মধ্যেও নারী নির্যাতন হচ্ছে। এটি অস্বীকার করছি না। কিন্তু চাইলে ভুক্তভোগী মামলা করতে পারছেন। বিচারের সুযোগ পাচ্ছেন। কিন্তু প্রবাসে যারা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, তারা কী সেই সুযোগ পাচ্ছেন?

প্রতিটি ঘটনায় জবাব চাওয়ার কথা। যার ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে নারীরা মারা যাচ্ছে, তাকে বিচারের আওতায় আনার কথা। এত লাশ আসছে! কই একটি ঘটনার তদন্তও তো করতে পারছে না। যদি শ্রমিক হত্যার বিচার চাইতে না পারে, তাহলে দূতাবাস থাকার দরকার কী?

ধর্মীয় কারণে সৌদি আরবকে সম্মান দেখানো হচ্ছে, ভালো কথা। কিন্তু ইসলাম ধর্মে কি নারী নির্যাতনের কথা বলা আছে? ইসলাম তো নারীকে অনেক বেশি মর্যাদা দিয়েছে। কেন আমরা এমন নির্যাতন মেনে নিচ্ছি? কেন আমরা চুক্তি অনুযায়ী এসব নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফোরামে বিচার চাইছি না?

জাগো নিউজ : শ্রমিক নির্যাতনের এমন ধারাবাহিকতা থাকলে জনশক্তি রফতানিতে ঝুঁকি বাড়াবে কি-না? সালমা আলী : আমি জর্ডানের একটি হাসপাতালে ৪০ জন নারী শ্রমিকের লাশ নিয়ে কাজ করলাম। দুই বছরে ৪০ জন নারী আত্মহত্যা করে ওই হাসপাতালে রয়েছে বলে জানানো হলো। অথচ, আত্মহত্যা নয়, প্রতিজন নারীর মৃত্যু হয়েছে নির্যাতনে।

আমি দুই একটি ঘটনার তদন্তের বিষয়ে পররাষ্ট্র এবং প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলাম। দেখলাম, দুটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চরম সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। আমরা আর এগুতে পারলাম না। অথচ, সমন্বয় থাকলে হাসপাতালে যারা আত্মহত্যা বলে রিপোর্ট দিল, তাদের আইনের আওতায় এনে বিচার করা সম্ভব হতো।

নির্যাতনের এমন চিত্র বহাল থাকলে যেকোনো ঝুঁকিই বাড়তে পারে।

এএসএস/আরএস/জেআইএম