আওয়ামী লীগ মহাজোট সরকার গঠন করার পর থেকেই জনগণের মুখে মুখে আলোচনা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির (জাপার) ক্ষমতা নিয়ে। একই সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ ও বিরোধী দলে থাকা নিয়ে সরকার গঠনের শুরু থেকে ভিন্ন কথা বলেন ক্ষমতার দাপট নিয়ে থাকা দলটির জ্যেষ্ঠ অনেক নেতা। একই সঙ্গে সরকারের ভিতরে ও বিরোধী দলে থাকায় এবার দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছোট ভাই ও প্রেসিডিয়াম সদস্য জি এম কাদের আশঙ্কা প্রকাশ করে জাগো নিউজকে বলেছেন সরকারের মন্ত্রী পদে থাকায় জাতীয় পার্টির নেতাদের ভবিষ্যতে বিচারের মুখোমুখি করা হতে পারে।তিনি বলেন, মন্ত্রিপরিষদের পাশাপাশি বিরোধী দলে থাকা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। জাপার নেতারা মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছেন বলেও তিনি দাবি করেন। জিএম কাদের বলেন, বাংলাদেশ সংবিধানের আইনসভার ৭০ অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে; ‘কোনো নির্বাচনে রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরুপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ সদস্য হইলে তিনি যদি ‘ধারা ক’ উক্ত দল হইতে পদত্যাগ করেন অথবা ‘ধারা খ’ সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন তাহলে তাহার আসন শূন্য হইবে তবে, তিনি সেই কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হইবার অযোগ্য হইবেন না।’এমন ব্যাখ্যা দিয়ে জিএম কাদের বলেন, মন্ত্রিসভায় কোনো বিল পাশ করতে হলে অবশ্যই সব সদস্যকে ‘হ্যাঁ’ ভোট দিতে হবে। অর্থ্যাৎ জাপার মন্ত্রীরাও ‘হ্যাঁ’ ভোট দিয়েছেন সেটাই সংসদে বিবেচ্য হবে। আর যদি কেউ বিরোধীতা করতে চান তাকে অবশ্যই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করতে হবে। যদি জাপা সত্যিকারের বিরোধী দল হয় তাহলে তারা সরকারের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তকে ‘না’ ভোট দেবে এটাই স্বাভাবিক। মন্ত্রীরা ‘হ্যাঁ’ ভোট আর তার দলের সদস্যরা ‘না’ ভোট দিলে পরস্পর বিরোধী অবস্থান সৃষ্টি হবে। অর্থ্যাৎ দলের বিপক্ষে অবস্থান চলে গেলে সংবিধান অনুযায়ী বিপক্ষে অবস্থানকারীদের সংসদ পদ থাকে না। এই সমস্যার কারণে বর্তমানে বিল পাশের ক্ষেত্রে জাপার কোনো সংসদ সদস্য আর ‘না’ ভোট দিচ্ছেন না। এটা তারা বুঝে গেছে যে, আমাদের (জাপা) মন্ত্রীদের হ্যাঁ জয়যুক্তের মাধ্যমে বিল পাশ হচ্ছে তাই সদস্যরা ‘না’ জয়যুক্ত করলে সেক্ষেত্রে তাদের (মন্ত্রীদের) অবস্থান দলের বেশিরভাগ সদস্যদের বিপক্ষে চলে গেলে তার সংসদ সদস্য পদ শূন্য হবে।জিএম কাদের বলেন, এ ভাবনায় বর্তমানে সংসদে মন্ত্রিসভার কোনো সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেন না জাপার সংসদ সদস্যরা। সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদের আরো বললেন, এটা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। তিনি আরো বলেন, অনুচ্ছেদ ৫৫ এর ৩ ধারা মোতাবেক মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের নিকট দায়ী থাকবেন। অথ্যাৎ বর্তমান মন্ত্রিসভা যা করছেন তার দায়ভার ভবিষ্যতে কেউ কোনো বিষয়ে আইনের মুখোমুখি করলে তার দায় এড়াতে পারবে না জাপার মন্ত্রীরা।দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কেউ সরকারের মন্ত্রিসভায় যেতে চাইলে অবশ্যই সেটা সরকার পক্ষের দেয়া চিঠি অনুযায়ী পার্টির চেয়ারম্যানের অনুমোদন নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। স্বাভাবিকভাবে পার্টির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম এ অনুমোদন দেয়। বর্তমান জাতীয় পার্টির মন্ত্রীরা কার অনুমোদন নিয়েছে সেটিও জানতে চান তিনি।পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, অনুমোদন না দিলে তাদের দলের প্রথমিক সদস্য পদে থাকার এখতিয়ারও নেই। জিএম কাদের প্রশ্ন তোলেন চেয়ারম্যানের ক্ষমতা নিয়ে। তিনি বলেন, ক্ষমতা থাকা সত্বেও চেয়ারম্যান কেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেন না।দলের অন্যতম আরেকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যদের সঙ্গে কথা হয় এ বিষয়ে। এক সময় দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের কাছের লোক হিসেবে পরিচিত ওই নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, জাতীয় পার্টি এখন খেলার মাঠে। কে কী খেলছেন তা বলা খুব কঠিন।তিনি বলেন, সংবিধানে কি আছে তা এ দলের অনেকেই ভালো জানেন। তবে, বলতে গেলে পদ থাকবে কিনা তা জানি না। তাই নাম প্রকাশ না করার জন্য অনুরোধ করেন তিনি। তিনিও জিএম কাদেরে সঙ্গে একমত পোষণ করেন। এ ব্যাপারে জাপার সেক্রেটারি জিয়া উদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, সরকারে থাকতে দোষ কিসের। তিনি বলেন, ভারতে মমতা ব্যানার্জী এর আগে সরকারে ছিলো। তাই বলে তিনি বিরোধী দলীয় ভূমিকা পালন করতে পারেন নি।বাবলু আরো বলেন, জাতীয় পার্টি সরকারের অনিয়ম দুর্নীতি ও সরকারি ব্যাংক থেকে শুরু করে সর্বত্র লুটপাটের বিপক্ষে কথা বলছে। মায়ের পেটে আজ শিশু নিরাপদ নয় তারও প্রতিবাদ করছে জাপা। আর সংবিধান বিষয়ে জাপার মন্ত্রী ও বিরোধী দলে থাকা নিয়ে দলের সিনিয়র নেতা কী বলছেন, তা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ফোন কেটে দেন।সংবিধান প্রণেতা ড. কামালা হোসেন জাপার মন্ত্রিসভা ও বিরোধীদলে থাকা নিয়ে জাগো নিউজকে বলেন, আমি সরাসরি এ বিষয়ে কিছু বলছি না। তবে জিএম কাদের সাহেব মহজোট সরকারের সাবেক একজন মন্ত্রী। তাই আমার মনে হয় তিনি না বুঝে কোনো কথা বলেননি।বিষয়টি নিয়ে কথা হয় সুপ্রিম কোর্টের আরেক সিনিয়র আইনজীবীর সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আইনজীবী জাগো নিউজকে বলেন, বয়স বেশি হয়ে গেছে। এ বয়সে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। তিনি বলেন, একই সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদে থাকা আর বিরোধী দলে থাকা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।এদিকে, এতকিছুর পরও সম্প্রতি জাতীয় পার্টির সংসদীয় কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দুইজন সিনিয়র নেতার বৈঠক নিয়ে চলছে নানা আলোচনা। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে ওই বৈঠকের সংবাদ। বৈঠকে এবার রওশন এরশাদ সরকারের মন্ত্রিসভায় দলের নেতাদের না রাখার পক্ষে মত দিয়েছেন। অথচ পার্টির চেয়ারম্যান আরো দুইজন মন্ত্রী বাড়ানোর কথা বলেছেন বলে জানা গেছে।এফএইচ/এআরএস/এমএস
Advertisement