স্কুল, কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে লড়ছি ১৯৯৭-৯৮ এর দিকে। স্বপ্ন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো, রোকেয়া হলে অ্যাটাচ হতে চেয়েছি এবং সাধ ছিল সেখান থেকেই ছাত্র রাজনীতির সাথে সরাসরি যুক্ত হবো। কিন্তু ফরম জমা দিতে গিয়েই যা দেখলাম, মন গেল বিগড়ে। সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হল আর সূর্যসেন হলের মারামারিতে ক্রস ফায়ারে পার্থ মারা গেল। ঘটনা চক্রে সেদিন দেখলাম, একজনের মাথা থেকে গড়িয়ে রক্তের ফিনকি ছুটছে। এই দৃশ্য দেখার মুহূর্তেই মনে হলো- এর নাম যদি ছাত্র রাজনীতি হয়, তবে সে রাজনীতি আমি চাই না। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস আমার হলো, রোকেয়া হলও আমার হলো। কিন্তু রাজনীতি আমাকে আর টানলো না।
Advertisement
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সময় ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতির নানা ঘটন-অঘটন অনেক চিত্রের খবর পেয়েছি, দেখেছি। আমার মনে হলো, বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের লেজুড় বৃত্তি করে ছাত্ররা ক্রমেই হারাচ্ছে নিজেদের ঐতিহ্য এবং স্বকীয়তা। এই পূর্ববঙ্গে ছাত্র রাজনীতির সূচনালগ্ন থেকেই জাতীয় রাজনৈতিক সংগঠনের পৃষ্ঠপোষকতা ছিল। তাই বলে ছাত্র সংগঠন কখনোই পুরোপুরি লীন হয়নি রাজনৈতিক সংগঠনে।
দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচন শিক্ষার্থীদের মাঝে বেশ আশার সঞ্চার করেছিলো। মনে হয়েছিল, এবার বুঝি ছাত্র রাজনীতি আবার তার গৌরবোজ্জ্বল পথে হাঁটবে। কিন্তু নির্বাচনের মাত্র ছয় মাস পরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বলছেন, তাদের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে ছাত্র সংগঠনগুলো। এখনও বৈধভাবে হলে সিট পাচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। এখনও জবরদস্তির রাজনীতি করানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। তাদের অভিযোগ, ছাত্রদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে সোচ্চার নয় ছাত্র সংগঠনগুলো। প্রশ্ন হলো, তারা কাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করছে?
একসময়ের আন্দোলনের সূতিকাগার, স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রগণ্য অবদান রাখা প্রতিষ্ঠান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে নানা ছাত্র সংগঠনের অস্তিত্ব থাকলেও দৃশ্যমান কার্যক্রম বাংলাদেশ ছাত্রলীগেরই সবচেয়ে বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারাও স্বীকার করেন, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের সব ছাত্র সংগঠনই কম-বেশি জাতীয় রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। ফলে ছাত্র সংগঠনগুলো অনেক সময়ই সাধারণ ছাত্রদের থেকে বিচ্ছিন্ন।
Advertisement
রাজনীতি বিশ্লেষকরাও মনে করেন, ছাত্র রাজনীতি সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তারাও একমত যে, এই অবস্থার জন্য দায়ী দেশের সামগ্রিক রাজনীতির প্রভাব। তবে এটাও সত্য যে, এখনকার সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা অনেক বেশি সচেতন। তারা জানে কে কী করছে। ছাত্র রাজনীতির নামে কমিশন খাওয়া, প্রশাসনের সহযোগিতায় নানা রকম দুর্নীতির যে অভিযোগ ছাত্র সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে রয়েছে সাধারণরা এসব বিষয়ে ওয়াকিবহাল।
গত কয়েক বছরের ছাত্র আন্দোলনের উদাহরণ পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিভিন্ন ন্যায্য আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই একত্রিত হয়েছে। তারা ছাত্র সংগঠনগুলোর ওপর আর নির্ভর করতে রাজি নয়। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং ২০১৮ সালে নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের হাত ধরেই। আন্দোলন শুরু হবার পরে ছাত্রসংগঠনগুলো শিক্ষার্থীদের দাবি-দাওয়ার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। সড়কে দুর্ঘটনা আর বিশৃঙ্খল অবস্থার বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন ছিল সাম্প্রতিক সময়ের অনন্য দৃষ্টান্ত।
কিন্তু এর উপরও কালিমা লেপন করেছে ছাত্র সংগঠনের ক্ষমতার দম্ভে মোহগ্রস্ত শিক্ষার্থীরা। এরই নিকটতম সময়ের উদাহরণ হলো বুয়েট ছাত্র আবরারের মৃত্যু। সম্প্রতি আবরারকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ওঠে আসে অপর ১৯ ছাত্রের নাম। অপরাজনীতিতে জড়িয়ে তাদের এই অধঃপতন, এমনটাই মনে করছেন সাধারণ মানুষ। মনস্তত্ত্ববিদসহ সচেতন মহল বলছে, সন্তানদের পুঁথিগত বিদ্যায় মেধাবী করে গড়তে ব্যস্ত পরিবার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাদের কোথাও নৈতিক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে না। ফলে হারাচ্ছি মূল্যবোধ। শঙ্কা তৈরি হচ্ছে মানবিক বিপর্যয়ের। এ থেকে উত্তরণে ছাত্র সংগঠনগুলোকেই উদ্যোগী হতে হবে। লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে বেরিয়ে, ছাত্র রাজনীতির ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে পূর্বসূরিদের কাছে যেতেই হবে বর্তমানের ছাত্রনেতাদের।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।
Advertisement
এইচআর/জেআইএম