দুহাতে সমান তালে লিখে গেছেন হুমায়ূন আহমেদ। এই কথাসাহিত্যিককে নিয়ে একটা কথা খুব বেশি প্রচলিত, সেটা হলো সাধারণ পাঠককে বই পড়া শিখিয়েছেন হুমায়ূন। পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়েন না এমন পাঠকও যদি কোনো গল্প, উপন্যাস পড়েন সেটা হুমায়ূন আহমেদের বই হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
Advertisement
শুধু লেখক হিসেবেই নন, নাটক ও চলচ্চিত্রেও সোনা ফলিয়েছেন তিনি। লিখেছেন দারুণ সব গান।
হুমায়ূন আহমেদ বাংলা নাটকের একটা আলাদা অধ্যায়। যার নাটকে দর্শক হেসেছে, কেঁদেছে, তাকে ভালোবেসেছে। সিনেমায়ও তিনি তৈরি করেছেন নিজে ভাষা। হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন তারকা গড়ার কারিগর। তার নাটক ও সিনেমায় অভিনয় করে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছেন।
হুমায়ূন আহমেদের নাটকে অভিনয় করে তুমুল জনপ্রিয়তা পাওয়া একজন অভিনেতা হলেন ডা. এজাজুল ইসলাম। এখনো হুমায়ূন আহমেদকে মনে প্রাণে ধারণ করেন তিনি।
Advertisement
আজ ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের ৭১তম জন্মদিন উপলক্ষে জাগো নিউজের কার্যালয়ে এসেছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা ডা. এজাজ। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন তিনি। একসময় প্রিয় এই মানুষটিকে নিয়ে কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন এ অভিনেতা।
ওরা তিনজন খ্যাত এই অভিনেতা বলেন, ‘লেখক, চিত্রনাট্যকার, চলচ্চিত্রকার যেদিক থেকেই তাকে দেখি না কেন আমার চোখে সবদিক থেকেই শ্রেষ্ঠ ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। মানুষ হিসেবেও অত্যধিক মানবিক ছিলেন তিনি। অল্পে খুশি থাকতেন। তার কাছে অনেক কিছু শিখেছি।’
‘শুটিংয়ের সময় মাঝে মধ্যে যখন ওভার অ্যাক্টিং করে ফেলতাম। স্যার ভুলটা ধরিয়ে দিতেন। কমেডি আমরা বুঝি না। স্যার বলতেন, কমেডি আর ভাড়ামি পাশাপাশি চলে। সুতরাং খুব সাবধান, সীমা ছাড়িয়ে গেলে ভাড়ামি হয়ে যাবে। আমার ব্যাপারে অন্যদের বলতেন ওকে ধরে রেখো’- যোগ করলেন এজাজ।
তিনি আরও বলেন, ‘একবার স্যার আমাকে পরীক্ষা করেছিলেন। একটা নাটকে আমাকে ছোট্ট একটা চরিত্র দিয়েছিলেন। এটা ছিল পথিকের চরিত্র। এক কাঁদি কলা নিয়ে আমি হেঁটে যাচ্ছি। পরে দেখি সেই নাটকের সিডি বেরিয়েছে বাজারে। সিডির কভার হয়েছে আমার সেই কলা কাঁধে নেওয়া ছবিটা দিয়ে। এমনই ছিলেন স্যার। উনার নাটকে যে একটা লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেও বড় স্টার।’
Advertisement
হুমায়ূন আহমেদের বিভিন্ন নির্মাণে তাকে পাওয়া গেছে বিভিন্ন চরিত্রে। তবে তারও আগে থেকেই রেডিও ও টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত অভিনেতা ডা. এজাজ। হুমায়ূন আহমেদের পরিচালনায় প্রথমবারের মতো অভিনয় করেছিলেন ‘সবুজ সাথী’ নাটকে, স্বাস্থ্য বিভাগের মাঠকর্মী হিসেবে ছোট একটি চরিত্রে। এরপর থেকেই হুমায়ূন আহমেদের প্রায় সব নির্মাণেই ছিল তার সরব উপস্থিতি।
কেমন ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে এক ঘটনার স্মৃতিচারণ করে কেঁদে ফেললেন এজাজ। বললেন, ‘একবার এফডিসিতে আমরা চলচ্চিত্রের শুটিং করছি। শীতের সময়। শুটিংয়ের জন্য একটা ছোট বাচ্চা ভাড়া নেওয়া হয়। বাচ্চাটা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্যার ব্যস্ত হয়ে গেলেন। উনি নিজেই ঠান্ডায় ভুগছিলেন সেই সময়। নিজের রুম থেকে রুম হিটার বের করে ছেলেটির জন্য দিয়ে দিলেন। আমাকে বললেন ছেলেটার যেন কোনো ক্ষতি না হয়। তুমি ওর দিকে খেয়াল রাখো। আমার চোখ দিয়ে পানি চলে আসলো। মানুষ হুমায়ূন এমনই ছিলেন। তাকে নিয়ে বলে আসলে শেষ করা যাবে না।’
অভিনয় ক্যারিয়ারের প্রথম দিকে হুমায়ূন আহমেদের নাটকে সিরিয়াস চরিত্রে অভিনয় করলেও পরবর্তীতে মজার চরিত্রগুলোতে অভিনয়ের সুযোগ পান ডা. এজাজ। তিনি বলেন, ‘এখনও শুটিং করতে গিয়ে যখন সংলাপ ভালো লাগে না তখন স্যারের কথা মনে হয়। স্যার এমন জাদু জানতেন, এমন ঘোরের জগৎ তৈরি করতে পারতেন। আজও আমরা মুগ্ধ হয়ে আছি তার কাজ নিয়ে। তার একটা নাটকে অভিনয় করে যেমন সাড়া পেয়েছি এখন অনেক অনেক নাটকে অভিনয় করেও সেই সাড়া পাই না।’
‘আমার মনে আছে। শ্রাবণ মেঘের দিন ছবির একটা দৃশ্য ছিল রাজবাড়ির নাতনি গ্রাম ঘুরে দেখছে। হঠাৎ দেখতে পেলো একটি বাঁশ পড়ে আছে। এজন্য সে যেতে পারছে না। আমি সেই বাঁশ তুলে কাঁধের ওপর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। রাজবাড়ির নাতনি আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে, আপনি কেমন আছেন। তখন আমার সংলাপ ছিল, রাজবাড়ির রাজকন্যা আমারে জিজ্ঞেস করে আমি কেমন আছি। আলহামদুলিল্লাহ, আমি ভালো আছি। ছোট্ট একটা সংলাপ কিন্তু কত প্রাণবন্ত ছিল। এখানে কমেডি ছিল, আবেগ ছিল, ভালোবাসা ছিল এবং সংলাপের যৌক্তিকতাও ছিল। এখন আর এ ধরনের সংলাপ দেখি না’- যোগ করেন এই অভিনেতা।
জনপ্রিয় এ অভিনেতা আরও বলেন, ‘হুমায়ূন আহমেদকে হারিয়ে আমরা যেমন সাহিত্যিক হুমায়ূনকে হারিয়েছি তেমনি হারিয়েছি বাংলা নাটকের এক অনন্য সম্পদ। যতই দিন যাচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ ততই প্রাসঙ্গিক হচ্ছেন। সেই সময় আমাদের নাটক কলকাতা জয় করে এসেছে, আর এখন কলকাতার নাটক নিয়ে পড়ে থাকছে বাংলাদেশের মানুষ।’
এমএবি/এলএ/এমকেএইচ