আমার পছন্দের দুইটি লাইন দিয়ে শুরু করছি। "The Whiter your diet, the sooner you're diseased! অর্থাৎ খাবার যতো সাদা হবে ততো তাড়াতাড়ি মানুষ অসুস্থ হবে। "Longer the belt, shorter the lifespan" অর্থাৎ কটি বন্ধনী (বেল্ট) যতো বড় হবে, আয়ুষ্কাল ততো ছোট হবে। সুস্থ থাকার সময়কাল (healthspan) বাড়ানোর জন্য আমাদের গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে চিন্তা করতে হবে। যাদের স্বাস্থ্য শিক্ষা বা পুষ্টি শিক্ষা তুলনামূলকভাবে কম তাদের নিয়ে ভাবতে হবে। খাদ্যাভ্যাস এর বিষয়ে ভাবতে হলে আমাদের খাদ্য প্রক্রিয়াজাত করন এবং খাদ্যপণ্য লেবেলিং নিয়ে সুচিন্তা করতে হবে।
Advertisement
সাধারণ ভোক্তাদের জন্য আসলে খাবারের মোড়কের উপরের তথ্য দেখে খাবার নির্বাচন করা একটু কঠিন। বর্তমানে প্রচলিত লেবেলিং এর পরিবর্তে যদি মোড়কের উপরে ট্রাফিক লাইট পদ্ধতি অনুযায়ী মাত্রা পরিমাপক হিসেবে আলাদা আলাদা রঙ যেমন সবুজ, হলুদ এবং লাল ব্যবহার করা হয় বা আর ডি এ পদ্ধতি অনুযায়ী কোন উপাদান প্রতিদিনের চাহিদার কত শতাংশ পূরণ করবে সেভাবে উল্লেখ থাকে তাহলে মানুষ সহজেই অল্প সময়ে এক নজরে দেখেই বুঝতে পারবে সেই খাবারে কী ধরনের উপাদান কী পরিমাণে আছে। কারণ এখনকার দিনে মানুষ আসলে অর্থের দিক দিয়ে খুব গরিব না হলেও সময়ের দিক দিয়ে বেশ গরিব। তাই সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
চারিদিকে প্রক্রিয়াজাত খাবার রেস্তোরাঁ এবং ফাস্ট ফুডের দোকানের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে। বাংলাদেশে দুইটা জিনিস সমানভাবে বাড়ছে একটি হচ্ছে খাবারের দোকান আরেকটি হচ্ছে হাসপাতাল। অবস্থাটা এমন বেশি বেশি প্রক্রিয়াজাত খাবার খাও আর হাসপাতালে ভর্তি হও। এই প্যাকেটজাত খাবার আসলে শরীর এবং পরিবেশ উভয় এর জন্যই খারাপ।
প্রক্রিয়াজাত খাবার একদিকে যেমন খাবারের তৃপ্তি কমিয়ে দেয় অন্যদিকে ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয় এবং ওজন বাড়িয়ে তোলে যা পরবর্তিতে অন্যান্য অনেক সমস্যার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। আবার পরিবেশের জন্যও এসব খাবারের প্যাকেট সমূহ বোঝাস্বরূপ। ব্যস্ত সময়ের ব্যস্ত মানুষের জন্য প্যাকেট এবং প্যাকেটজাত খাবারের লেবেলিং এর দিকে মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন।
Advertisement
যখন আমরা রাস্তায় চলাফেরা করি তখন বেশ দূর থেকে ট্রাফিক লাইট এর সিগনালের রং দেখে আমার বুঝে যায় যে আমাদের থামতে হবে নাকি যেতে হবে। তেমনি ভাবে প্রক্রিয়াজাত খাবারে যদি এই ট্রাফিক লাইট পদ্ধতি বা আর ডি এ (Recommended dietary allowance) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় তাহলে মানুষ সহজেই বুঝতে পারবে কোন মাত্রা পর্যন্ত সেটা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো বা কোন মাত্রা স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ । অর্থাৎ কতটুকু পর্যন্ত খাওয়া যাবে এবং কোন পর্যায়ে গিয়ে থামতে হবে। অনেকটা ওষুধের ডোজের মতো কাজ করবে। যদি আমরা প্রক্রিয়াজাত খাবারের উপর নির্ভরশীলতা বা অভ্যাস না কমাতে পারি তাহলে এমন দিন মনে হয় খুব বেশি দূরে নেই যখন খাবারও ওষুধের মতো ডোজ অনুযায়ী খেতে হবে।
যাইহোক, ট্রাফিক লাইট বা আর ডি এ পদ্ধতির মাধ্যমে মানুষ দ্রুততম সময়ে খাবারের সারভিং বা মাত্রা সম্পর্কে ধারণা পাবে। আসলে সাধারণ ভোক্তাদের জন্য বিশেষভাবে যাদের খাদ্য পুষ্টি বিষয়ে ভালো ধারণা নেই তাদের জন্য এই পদ্ধতি অনেক উপকারে আসবে বলে মনে করি। তাই সময় এসেছে বিষয়গুলো নিয়ে নতুনভাবে ভাববার।
উদাহরণ স্বরূপ যদি কোন খাদ্য প্রস্তুতকারক কোম্পানি কোন খাদ্যপণ্য তৈরি করে তাহলে মোড়কের উপরে স্পষ্টভাবে ট্রাফিক লাইট বা আর ডি এ পদ্ধতি অনুযায়ী খাদ্য উপাদান সম্পর্কে নির্দেশিকা দিবে। চিনি, ভালো চর্বি, খারাপ চর্বি, লবণ বা অন্যান্য উপাদান কী পরিমাণে আছে সেগুলো উল্লেখ থাকতে হবে কালার কোডিং এর মাধ্যমে বা কী পরিমাণ খেলে আর ডি এর দৈনিক চাহিদার কত শতাংশ পূরণ হবে সেটা উল্লেখ থাকতে হবে। এর মাধ্যমে বিভিন্ন খাবারের মধ্যে তুলনা করাও সহজ হবে।
পাশাপাশি আরেকটি বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। কিছু বছর আগেও মানুষ যেখানে অপুষ্টি বলতে শুধু কম পুষ্টি কে বুঝতো বিশেষ করে স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কিন্তু এখন দৃশ্যপটের পরিবর্তন হচ্ছে। অপুষ্টির আরেকটি স্ট্যান্ড হচ্ছে অতি পুষ্টি (স্থূলতা) সেই দিকেও মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। কারণ এই অতি পুষ্টির কারণে বিভিন্ন রোগের সাথে সাথে অন্য আরেকটি সমস্যা দেখা দিচ্ছে সেটা হচ্ছে অপুষ্টির তৃতীয় স্ট্যান্ড যেটাকে বলা হয় হিডেন হাঙ্গার (অনু পুষ্টির অভাবজনিত উপসর্গ )। এটিকে হিডেন হাঙ্গার বলা হয় কারণ এর উপসর্গ দেরিতে পরিলক্ষিত হয়। স্বাভাবিকভাবেই একজন মানুষ যখন প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাবে তখন তার অন্ত্র (Gut) এর বন্ধু আঁশ জাতীয় খাবার কম খাওয়া হবে অর্থাৎ ফলমূল, শাকসবজি কম খাওয়া হবে তখনই আসলে অপুষ্টির তৃতীয় স্ট্যান্ড অর্থাৎ হিডেন হাঙ্গার এর ঝুঁকি বেড়ে যায়।
Advertisement
দুঃখজনকভাবে জীবন যাপন ও খাদ্যাভাস সম্পর্কিত রোগের বিস্তার দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। সময় থাকতে আমাদের সাবধান হতে হবে এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের সচেতন হওয়ার পাশাপাশি বিশেষভাবে শিশুদের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। যদি আমরা শিশুদের সঠিক খাদ্যাভ্যাস শৈশব থেকেই তৈরি না করতে পারি তাহলে পরবর্তীতে তা বদলানো সহজ হবে না।
এই দিক থেকে বিবেচনা করলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে ইলেকট্রনিকস মিডিয়ায় বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যের অতিরঞ্জিত বিজ্ঞাপন। কারণ শিশুরা তো অনুকরণ প্রিয়। তারা খুব সহজেই যা দেখে, যা শোনে তা নিজেদের মধ্যে ধারণ করে নেয়। তাই আমাদের অবশ্যই দেখতে হবে, ভাবতে হবে এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যেন গণমাধ্যমের মতো শক্তিশালী মাধ্যমে কোনোভাবেই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অতিরঞ্জিত বা ভুল তথ্য পরিবেশন করা না হয়।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের বিষয় গুলোর দিকে সুদৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। সবার সম্মিলিত আন্তরিক প্রচেষ্টায় আমরা একটা সুস্থ সুন্দর সমাজ চাইলেই গড়ে তুলতে পারি। তাই আসুন আমরা যার যার অবস্থান থেকে নিজেরা বদলে যাই এবং অন্যদেরকে বদলে যেতে উৎসাহিত করি।
লেখক : শিক্ষক, ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।shammyiu3@gmail.com
এইচআর/এমএস