যান্ত্রিক নগরী ঢাকায় রাতের নিস্তব্ধতা যেন ক্রমশই ক্ষীণ হয়ে আসছে। রাত গভীর হতে না হতেই রাজপথ চলে যায় ভারীযানের দখলে। পণ্যবাহী ট্রাক-লরির শব্দে মিলে যায় রাতের নিরবতা। তবে রাতের অমন ধুম শব্দকেও আড়াল করে দেয় রাজধানীর মিরপুর শাহ আলী বোগদাদি (রঃ) মাজারসংলগ্ন আস্তানা থেকে ভেসে আসা ঢাকের বাড়ি। এ যেন সুর বিতানের মহামেলা। যেন সুরে সুরে ভক্তকূলের হৃদয় দোলা।রাত যত গভীর হয়, ভক্তকূলের পদভারে মাজার চত্বর ততই প্রাণ পায়। সর্বহারা ভক্তদের মিলনমেলায় গানের পুরো আস্তানা হয়ে ওঠে সাধুআশ্রম। ক্ষণিকের তরে সংসারত্যাগী মানুষগুলো আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন ঘটানোর তাড়না অনুভব করতে থাকে। প্রতি বৃহস্পতিবার (গুরুবার) শাহ আলী (রঃ)-এর মাজার চত্বরে গানের আয়োজন করা হয়। এদিন মাজার এলাকা প্রাণের মেলায় রূপ নেয়। শুধু রাজধানী থেকে নয়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ভক্তকূল ছুটে আসেন শাহ আলী (রঃ) এর দরবারে। কেউ জিকিরে, কেউ জিয়ারতে আবার কেউ কুঞ্জ সাজিয়ে মশগুল থাকেন রাতভর। গানের মাঝে সাধন-ভোজন‘যদি দুঃখ পেলে তোমায় মেলে, আমি দুঃখ সাগরে বইবো তরি। আমি আর যাবো না সুখ সাগরে, সুখ পেলে দয়াল-তোমায় ভুলতে পারি।’ বাউল সাধক বিজয় সরকারের এমন গানের অর্থকথা যেন পূর্ণতা পায় বৃহস্পতিবার শাহ আলী (রঃ)-এর মাজারে। অমন গানে সাধক, খ্যাপা-খ্যাপী আর ভক্তকূলের মনমাজারে উম্মাদনার ঢেউ খেলে যায় নিমিষেই। সুরের মূর্ছনায় আত্মহারা হয়ে পড়েন হাজারো আশেকান। দুঃখে ভরা হৃদয় নিয়ে সংসার জীবনে হতাশাগ্রস্ত মানুষগুলো আত্মিক প্রশান্তির তরে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মাজারকে কেন্দ্র করে বাউল শিল্পীরা মিরপুর এবং এর আশেপাশের এলাকায় বসবাস করে আসছে অনেক আগে থেকেই। এসব শিল্পীদের নিয়েই শাহ আলী মার্কেট এবং মাজার সংলগ্ন এলাকায় বেশ কিছু সঙ্গীত একাডেমিও গড়ে উঠেছে। আবার বাউল গানকে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বেশ কিছু রেকর্ডিং হাউজ। বৃহস্পতিবার বাদে অন্যান্য দিন এসব রেকর্ডিং হাউজে গানের আসর বসে। এমন আসরকে কেউ বলে জলসা ঘর, কেউ বলে কুঞ্জ, আবার কেউ কেউ আস্তানা বলে থাকেন। এসব আস্তানায় রাতভর চলে ফোক ধাচের মুর্শিদি, বিচ্ছেদ, বিচার, হিন্দি-উর্দু-বাংলা কাওয়ালি, আধ্যাত্মিক, বাউল গান। পুরুষ শিল্পীরা গাইলেও আস্তানায় সাধারণত অল্পবয়সী নারী শিল্পিদের প্রাধান্যই বেশি থাকে। ভক্তকূলের মন জয় করে বকশিস পেতে শিল্পীদের মধ্যে চলে রীতিমত প্রতিযোগিতা। সৃজনশীল গানের এমন প্রতিযোগিতায় লালন সাঁই, বিজয় সরকার, শাহ আব্দুল করিম, রাধারমণ, মোনমোহন, অনাদি সরকার, আককাস দেওয়ানের মতো বাউল সাধকদের লেখা, সুরে গানগুলো যেন আরো প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।দেশীয় বাদ্যযন্ত্রে শিল্পীরা সর্বোচ্চ আবেগের প্রকাশ ঘটান। গানের তালে শিল্পীরা নাচছেন, নাচছেন ভক্তরাও। কেউ আবার গান শুনেই দু’নয়ন জলে ভাসাচ্ছেন। সাধন-ভোজনের যেন এক আজব লীলা।হারেজ নামে এক ভক্ত এক দশক ধরে প্রতি বৃহস্পতিবার আসেন শাহ আলীর মাজারে গানের আস্তানায়। মিরপুরেই বাড়ি। জাগো নিউজকে বলেন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির মধ্য দিয়েই জীবন। এমন আস্তানায় এসে ক্ষণিকের জন্য সংসার জীবনকে ভুলে থাকা যায়। আর এটিই হচ্ছে আমার জীবনের বড় পাওয়া। এখানকার মুর্শিদি, বিচ্ছেদ গানে জীবনকে যতটুকু স্পর্শ করা যায়, তা আর কোথাও মেলে না। শিল্পী সোহাগী সরকার তার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, দুই বছর থেকে মাজারের বিভিন্ন আস্তানায় গান করছি। গান শিখছিও এখানেই। বলতে পারেন, ভক্তদের মাঝেই প্রাণ খুঁজে পাই। তাই বাউল গানেই বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছি। সিদ্ধ হস্তে সিদ্ধি সাধনকেউ কলকিতে টান দিচ্ছেন, কেউ কাটছেন। কেউ আবার বাটল-বাটনার জোগান দিচ্ছেন। গাঁজা, ভাং, দেশাল, তামাক, শুকনা কত নামেই না ডাক তার। তবে সিদ্ধি নামে ডাকলেই যেন সুখ আসে। জীবন ঘাতক ক্ষতিকর এ বস্তুটি সেবনেই পরম সুখ অনুভব করে চলছেন যোগি-যোগিনীরা। নারী-পুরুষ কোনোই ভেদাভেদ নেই সিদ্ধি সেবনে। আত্মাতে আত্মা মেলাতে সিদ্ধি বন্ধনে আবদ্ধ সবাই। কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে কেউ গাইছেন, কেউ একতারায়, কেউ মন্দিরায় সুর মেলাচ্ছেন। তবে সময় গড়িয়ে গাঁজার কলকি যাচ্ছে সবার হাতেই। একজন টানছেন, বাকিরা চাতকের মতো চেয়ে আছেন। দক্ষরা গিলছেন, অদক্ষরা নিমিষেই বের করে দিচ্ছেন। এখানেও একজন আরেকজনকে গুরু মানছেন। সিদ্ধি বানানো, আগুন লাগানো, হাত বসানো, কলকিতে টান দেয়া, ধুঁয়া গেলা-বের করা সবকিছুতেই ওস্তাদ মানতে হয়। কেউ দেখে শিখছেন, কেউ নিপুণ হাতে শিখাচ্ছেন। সিদ্ধি সেবনে সাধকেরা যেন পরম্পরা।মাজারের পশ্চিমে বালুর মাঠে এরকম শত শত জটলা। সবাই গাঁজা সেবনে ব্যস্ত। কোনো বাধা নেই, কোনো বিপত্তি নেই। সিদ্ধি সাধনে সবাই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। নেশার ঘোরে লালচে চোখে শরীর তাদের টালমাটাল। গাঁজার ধোঁয়ায় লাল হয়ে ওঠছে দাড়ি-গোঁফও। রাতভর সেবন চলে, আর দিনভর ঘুম। অতিসেবনে কেউ আবার মাঝ রাতেই ঘুমিয়ে পড়ছে।মন কাড়ে সাধন কুঞ্জমাজারের মধ্যে যেন শত মাজার। কেউ বলে আসর, কেউ বলে আশ্রম, আবার কেউ বলে সাধন কুঞ্জ। এর মহত্ব কি তার কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখা না থাকলেও ওমন কুঞ্জই যেন সাধকদের নিশানা। বিশাল আকৃতির মমের বাতি জ্বালিয়ে জটলা পাকিয়ে গুরু আর ভক্তকূল আত্মাতে আত্মা মেলাতে থাকে। কেউ মাটির ঢিবি বানিয়ে তাতে ত্রিশূল, পাঞ্জাতন, ক্রুশ প্রতীকের লোহার শিখ গেঁথে কেউ রেখেছেন। কোনোটিকে আবার বৌদ্ধধর্মের চিহ্নও। ফুলে ফুলে ভরা গোটা কুঞ্জ। গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, গোলাপের সুবাস একাকার হয়ে মিলে যাচ্ছে ধূপের গন্ধে। ধূপের বাটিতে বাতাস করছে ভক্তরা। পিতলের বাটি, জগ, গ্লাস থরে থরে সাজানো।মহিষের সিং থাকে বেশ কয়েকটি। নারিকেল, নারিকেলের মালই, ডাব চোখে পড়বে অধিকাংশ কুঞ্জেই। বেশ কয়েক পদের ফলও থাকে সেখানে। সবই ভক্তদের দেয়া। ওগুলোই আবার সেবা (প্রসাদ বা শিরনি) আকারে বিতরণ করা হচ্ছে আগত ভক্তদের মাঝে। শিরনি বিতরণে জাত, ধর্ম, বর্ণের পরিচয় যেন অনেকটাই ম্লান হতে থাকে। এএসএস/এমএএস/এমএস
Advertisement