বগুড়ার শিবগঞ্জে এক হিন্দু কিশোরীকে ধর্ষণ করে আবার তার বাসায় পৌঁছে দিয়েছে এক দুর্বৃত্ত। পুলিশ তাকে পরে গ্রেফতার করছে। এনিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি চলছে। যেসব পত্রপত্রিকা হিন্দু শব্দটি ব্যবহার করছে, তাদের মনমানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে একথাও সত্য যে, সংখ্যালঘুরা, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ এসমাজে এক ধরনের অনিরাপত্তায় থাকেন সবসময়। সবচেয়ে অনিরাপদ তাদের জমি, তাদের ঘরের মেয়েরা। সংখ্যালঘু গরের মেয়েক ধর্ষণ করা, তাদের জমি কেড়ে নেয়া, নাম মাত্র মূল্যে বলপূর্বক কিনে নেয়া এখন এক সংস্কৃতির নাম। এই সংস্কৃতির চ্যাম্পিয়ন যেমন ধর্মান্ধ রাজনৈতিক গোষ্ঠী, তেমনি তথাকথিত অসাম্প্রদায়িক দলগুলোর ভেতরও আছে তেমন চরিত্র। এর কারণ হলো, এসব করলে কোনো শাস্তি হয় না, শুধু ক্ষমতায় যারা থাকেন তারা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আর অসাম্প্রদয়িকতার কিছু বুলি আওড়ে যান সবসময়। নির্বাচনের আগে-পরে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর যে গণহারে নির্যাতন হলো, সেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি রাষ্ট্র। এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোনো কিছু আমরা দেখিনি। তবে প্রতিশ্রুতি ছিল অনেক। অপরাধ করেও নিষ্কৃতি পাওয়ার সংস্কৃতির ফল সংখ্যালঘুদের ওপর সাম্প্রতিক নিপীড়ন। সত্যি বলতে কি এই অপরাধ একধরনের সন্ত্রাসবাদ। এবং দৃষ্টান্তমূলক বিচার না হলে এ ধরনের ঘটনা চলতেই থাকবে। ক্ষমতাসীনদের ভাবতে হবে যে, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার জন্যই দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে সাম্প্রদায়িক হামলার বিচার করতে হবে।যারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগায় তাদের একটি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে, আর তা হলো বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নষ্ট করা। এর পেছনে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক তৎপরতা আছে। আর প্রতিটি ঘটনার বেলায় আমরা দেখি শেষ পর্যন্ত কিছু হয় না। এর কারণ হলো সাম্প্রদায়িক হামলার তদন্তে সবসময় দলীয় বিবেচনাই প্রাধান্য পায়। আর এতে করে, পেশাদার দুষ্কৃতকারীরা উৎসাহিত হয়।নির্বাচন এল সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাড়ে। তবে একে শুধু নির্বাচনকেন্দ্রিক বলা ঠিক নয়। এর শিকড় গভীরে প্রোথিত, যারা বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি চায়নি তারা অনেক গভীর করে ভাবে কিভাবে এই দেশটিকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করা যাবে। তারাই এসব হামলা অত্যন্ত পরিকল্পনা করে করে। বিশ্ব রাজনীতির দিকে তাকালেও দেখা যায় এই সংঘাতময় বিশ্বে দিন দিন সাম্প্রদায়িক বিভাজন স্পষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থাও খুব করুণ। পাকিস্তান এ অঞলে সবচেয়ে বেশি অস্থিতিশীল দেশ এবং আঞ্চলিক ধর্মীয় উন্মাদনার পৃষ্ঠপোষক। ভারতেও বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বিরাজমান। মিয়ানমারের আরাকান প্রদেশ সাম্প্রদায়িক সংঘাতে রক্তাক্ত। শ্রীলংকা মাত্র কিছুদিন আগে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে তামিলদের দমন করেছে। আর বাংলাদেশেতো ধর্মভিত্তিক দলগুলোর প্রাধান্য সুস্পষ্ট। ১৯৭১ এ আমাদের চাওয়া ছিল একটি উদার, অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার মধ্য দিয়ে সেই নীতিকে আমরা পরিত্যাগ করে সাম্প্রদায়িকতার পথে হেঁটেছি দীর্ঘ সময়। ১৯৯৬-এ ক্ষমতায় আওযামীলীগের প্রত্যাবর্তন বা ২০০৮-এ এই দলটির বিপুল ভোট প্রাপ্তিতে দেশে অসাম্প্রদায়িক শক্তি কিছুটা পথ খুঁজে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু সন্ত্রাসনির্ভর ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক শক্তিকে আরো বেশি ঐক্যবদ্ধ করেছে। ১৯৭৫-এর পর বাংলাদেশের অর্থনীতি আর ব্যবসা-বাণিজ্যের পুরো কাঠামোই দখল করে নিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি। ফলে যা কিছু তারা করতে চায়, অর্থের দাপটে তাদের বিরুদ্ধে কিছু করা যায় না। আরেকটি বড় কারণ ভোটের রাজনীতির হিসেব নিকেশ করতে করতে গিয়ে যাদের হাতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার দায়িত্ব তারাও প্রতিনিয়ত আপোস করে চলেছে সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে। তাদের ঘরেও নিরাপদে বাস করে ওলামা লীগ নামের বিশেষ বস্তু। এক দুষ্টচক্রে ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে বাংলাদেশ। আর এরই বিরুদ্ধে তরুণ সমাজের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল শাহবাগ, যাকে আমরা প্রতিষ্ঠা দিতে পারিনি। এটি ছিল নাগরিক সমাজের একটি আন্দোলন, আমরা পারিনি একে গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যেতে। ঢাকা এবং অন্য কয়েকটি শহরাঞ্চলে শক্তিশালী, সীমাবদ্ধ রেখেই আমরা হয়ত ভেবেছিলাম দেশ জেগে উঠেছে। আর যে রাজনৈতিক শক্তি রাষ্ট্র ক্ষমতায় তারাও আপোস করেছে খুবই চতুরতার সঙ্গে। শাহবাগ আন্দোলনের লক্ষ্য ছিল দেশের বড় হিংস্র সাম্প্রদায়িক শক্তি জামাতে ইসলামের রাজনীতির বিরুদ্ধে। কিন্তু ১৯৭৫-পরবর্তী বাংলাদেশে স্বাধীনতা বিরোধী সাম্প্রদায়িক শক্তি শাখা বিস্তার করেছে দ্রুততার সাথে। এদের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বাংলাদেশের এলিটশ্রেণির প্রতিনিধি, এদের মধ্যে রয়েছে ব্যারিস্টার, অ্যাডভোকেট, অন্য পেশাজীবী এবং শিক্ষকেরা। এসব মৌলবাদি দলের মধ্যস্তরের নেতারা আসে গ্রাম ও জেলাশহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে- জমির মালিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক ইত্যাদি। সাধারণ কর্মীদের মধ্যে রয়েছে শহর ও গ্রামের গরিবেরা এবং শহর ও আধা-শহরের সুযোগ সন্ধানীরা।গ্রামীণ সমাজের বিশেষ করে চাষী সমাজের, শহুরে শ্রমিক এবং দিন মজুরের দৃষ্টিভঙ্গি শাহবাগের উদ্যোক্তারা জানতে পারেননি বা চাননি। তারা নির্ভর করেছে কিছু চেনা গণমাধ্যম আর ইন্টারনেট ভিত্তিক সংবাদ মাধ্যমের ওপর। আমরা আরসব প্রগিতিশীল আন্দোলনের মতো এখানেও দেখলাম যে, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সাধারণ মানুষের স্বাধীন মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়ার মতো যথেষ্ট শক্তি বাংলাদেশে কোনো দল বা সংগঠনের থাকে না, এবারও ছিল না।শুরু থেকেই বিরোধী দল একে নিয়ে খেলেছে। সাম্প্রদায়িক চক্র বরাবরের মতো এই তারুণ্যকে নাস্তিক প্রমাণের চেষ্টা করেছে এবং এক ধরনের ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিতে সফল হয়েছে। আর সরকারি দল চেয়েছে তার মতো করে এর সুফল নিতে। তারা সময়মতো একে খণ্ডিতও করেছে। ফলে যা হবার হয়েছে, একটি পর্যায়ে নেতৃত্বের সংকট সৃষ্টি করে গণজাগরণ মঞ্চ ভাঙ্গাও সম্ভব হয়েছে। আবেগপ্রবণ তারুণ্যের আন্তরিকতার অভাব ছিল না, কিন্তু ছিল রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাব। আর এর সাথে যুক্ত একটি শ্রেণি শুরু থেকেই ছিল সংশয়বাদী। এসবের যোগফলে এক সময় আন্দোলন তার গতি হারিয়ে ফেলে। তবে একটি কথা বলা প্রয়োজন যে, সময়ের প্রয়োজনে শাহবাগ আবার জাগবে। কারণ এ জাতি নিশ্চয় বুঝবে যে, স্বাধীনতা বিরোধী, হিংস্র সাম্প্রদায়িক শক্তি হল অসাম্প্রদায়িক মানুষের নীরবতা আর পারস্পরিক দ্বন্দ্বের ফসল। এইচআর/পিআর
Advertisement