একে একে শিক্ষকের মর্যাদা যে তলানির দিকে যাচ্ছে তার সর্বশেষ শো-ডাউন হয়ে গেল রাজশাহীতে। অজু নয়, একেবারে পানিতে চুবিয়ে সেখানে শিক্ষককে গোসলও করিয়ে দিয়েছে ছাত্ররা। তাদের সাংগঠনিক নাম ছাত্রলীগ। কথা না শোনায় রাজশাহী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের অধ্যক্ষ প্রকৌশলী মো. ফরিদ উদ্দিন আহম্মেদকে ক্যাম্পাসের পুকুরে ফেলে দিয়েছে তারা।
Advertisement
ছাত্রদের কাছ থেকে এমন মর্যাদা হজম করা কঠিন হয়ে পড়েছে বয়োবৃদ্ধ এই শিক্ষকের। নিয়মমতো ক্লাসে উপস্থিত না থাকা এবং মধ্য পর্ব পরীক্ষায় অংশ না নেয়ায় দু’জন শিক্ষার্থীকে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার ফরম পূরণের সুযোগ না দেয়ায় এমন দাওয়াই দিয়েছে তারা। ভাগ্যিস তার সাঁতার জানা ছিল। তাই পরে অধ্যক্ষ সাঁতরে কিনারায় উঠে আসতে সক্ষম হন। অধ্যক্ষ ফরিদের অভিযোগ, তাকে হত্যা করতেই পুকুরের পানিতে ফেলে দেয়া হয়েছিল। বলেন, সাঁতার না জানলে হয়তো মরেই যেতাম।
স্কুল পাঠ্যতে আমরা ‘শিক্ষকের মর্যাদা’ শীর্ষক একটি কবিতা পড়েছি। ‘বাদশা আলমগীর, কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলভি দিল্লির’- এভাবে লেখা কবিতাটির বর্ণনাও ভীষণ শিক্ষণীয়। দিল্লির বাদশা আলমগীরের ছেলেকে পড়াশোনা শেখাতেন এক শিক্ষক। একদিন শিক্ষক অজুর পানি চান বাদশাপুত্রের কাছে। শাহজাদার শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালার দৃশ্যটি দেখে ক্ষেপে যান বাদশা। তিনি তলব করলেন শিক্ষককে। বাদশা ডেকে পাঠানোয় ভয় পান শিক্ষক। ভয়ে ভয়ে হাজির হন বাদশাহর দরবারে। এসে পেলেন উল্টো অভিজ্ঞতা। বাদশাহ তাকে ক্ষোভের সঙ্গে বললেন, আমি খুবই অসন্তুষ্ট হয়েছি আপনার ছাত্রের ওপর। সে কেন আপনার পায়ে শুধু পানি ঢালছিল? কেন সে নিজ হাতে আপনার পা ডলে দেয়নি?
ক্লাসে শিক্ষকরা কবিতাটি বোঝাতেন নানা উপমায়। কিন্তু, দিল্লি বহু দূরস্ত। সেই দিল্লি নেই। বাদশা আলমগীরও নেই। নেই শাহজাদাও। অজু নেই। অজু এসে ঠেকেছে গোসলে। শিক্ষকের পায়ে পানি না ঢেলে পুকুরে চুবিয়ে মারার চেষ্টা আছে। রাজনীতিতে ঝানু ছাত্ররা এখন গুরুজীদের উল্টো শিক্ষা দেয়। ডলে দেয় না। পারলে ঢেলেও দেয়। আবার সেই শিক্ষকই বা আছেন ক’জন? শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সঙ্গে গোটা শিক্ষাব্যবস্থার মানও প্রশ্নবিদ্ধ-বিতর্কিত। মানের চেয়ে স্বার্থ ও লাভ তুলতে মরিয়া শিক্ষকরাও। তারা দলবাজিতেও দুরন্ত। ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষার্থীদের চেয়েও এগিয়ে কোনো কোনো শিক্ষক। মিলমিশে চাঁদাবখরা ভাগবাটোয়ারাও করেন। এসবের যোগফল পড়েছে গোটা শিক্ষার মানের ওপর।
Advertisement
রাজশাহীতে বৃদ্ধ অধ্যক্ষকে পুকুরে ছুড়ে মারার ঘটনা শিক্ষাক্ষেত্রে নতুন মাত্রার সৃজনশীলতা এনে দিয়েছে। এ অরাজকতার স্রোত থেকে বাঁচতে নতুন করে সাঁতার শিখে কদ্দূর কুলাতে পারবেন শিক্ষাগুরুরা? সুইমিং ড্রেস পরে থাকবেন সব সময়? শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান বা দায়িত্ববানরা কি এইসব বিষয় ভাবার মতো সময় পান? কেউ কেউ দিনের প্রায় পুরোটা সময় ব্যয় করেন দলবাজিতে। শিক্ষা এবং শিক্ষাব্যবস্থার যতো উপরে তাকানো হবে ততোই এ দলবাজির ভয়াবহতা। সর্বোচ্চ ৪৬টি বিদ্যাপীঠের দশা সর্বোচ্চভাবেই করুণ। একটির চেয়ে আরেকটির গুরুচরণদশা। কোনো কোনোটিতে শিক্ষাগুরুরাই সমস্যা তৈরির কারিগর। কোনো কোনোটিতে তারা বিভক্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে।
কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তোড়ে তালাঝোলার অবস্থা। চাঁদাবাজির সঙ্গে নিয়োগ নিয়ে বাণিজ্যও বাদ নেই। ভিসি, প্রো-ভিসি, ট্রেজারারের নানামুখিতায় হাবুডুবু খাচ্ছে কয়েকটি। এসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ পদগুলোতে নিয়োগ নিয়ে অতিরাজনীতির জের গড়াচ্ছে বহুদূর। দেখা দিয়েছে প্রশাসনিক ও একাডেমিক অচলাবস্থাও। গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নেই এক মাসের ওপর ধরে। ছাত্র-শিক্ষকদের তোলপাড় করা আন্দোলনে অনিয়ম, দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ মাথায় নিয়ে রাতের আঁধারে ক্যাম্পাস ছেড়ে পালান সেখানকার ভিসি ড. খোন্দকার নাসিরউদ্দিন। টানা পাঁচ মাস শূন্যতার পর ভিসি পেল বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রোভিসি-ট্রেজারারও নেই। নেই রেজিস্ট্রারও।
দেশের আরেক প্রাচীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ও ভিসিহীন ছিল প্রায় পাঁচমাস। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও নিয়মিত ভিসি ছিল না প্রায় দু'বছর। মাত্র রবিবার নিয়মিত ভিসি হিসেবে নিয়োগ পেলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। তিনি এতদিন ছিলেন অস্থায়ী ভিসি হিসেবে। এর বাইরে দেশের ২৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রো-ভিসি নেই। ট্রেজারার নেই ২৮টিতে। ভাবা যায়? দিনের পর দিন চলতে পারে এভাবে?
হ্যাঁ, চলে। চলছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় অচল প্রায়। সেখানে চলছে ভিসিবিরোধী আন্দোলন। সেখানে শিক্ষকদের একটি পক্ষ চাইছে বর্তমান ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম পদত্যাগ করে সরে যান। তারা নানা কর্মসূচি পালন করছেন। আরেক পক্ষ অধ্যাপক ফারজানার পক্ষে শক্ত অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করছেন। ছাত্রলীগ নেতাদের হাতে মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বুয়েটেও স্থবিরতা।
Advertisement
দুটি হলের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষের পর অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়-কুয়েটের শিক্ষা কার্যক্রম। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েরও বিধ্বস্ত অবস্থা। পাবলিক-প্রাইভেট মিলিয়ে দেশে প্রায় দেড়শ' বিশ্ববিদ্যালয়। দেড়শ' ভিসি দূর থাক, দেড়শ' জন ভালো মানের শিক্ষক খুঁজে পাওয়াও সহজ নয়। এসব পদে নিয়োগ পেতে কিছু শিক্ষাগুরুর রাজনৈতিক দেন-দরবার, তদ্বির অনেকটা ওপেন সিক্রেট। সামগ্রিক এ চিত্র মোটেই শিক্ষা সহায়ক নয়। এতে নানা জরিপে আমাদের শিক্ষা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের করুণ চিত্র উঠে আসাই তো স্বাভাবিক।
বিশ্বের এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যৌথভাবে অবস্থান করছে ৮০১তম স্থানে। ডেটা ও গবেষণার ওপর ভিত্তি করে প্রতি বছরের মতো এবারও বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিং প্রকাশ করেছে 'কিউএস'। এটি যুক্তরাজ্যভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান। এশিয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ১২৭তম। এই খবরটি খোদ জানিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
এর আগে যুক্তরাজ্যভিত্তিক আরেকটি প্রতিষ্ঠান 'টাইমস হায়ার এডুকেশন' এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর একটি জরিপ প্রকাশ করে। ওই জরিপে ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো অবস্থান ছিল না। এসব জরিপ আমাদের শিক্ষা, শিক্ষকসহ শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুর্দশাই ইঙ্গিত করছে। আর বাদশা আলমগীর, তার পুত্র, ওস্তাদজিদের জায়গা করে দিচ্ছে মিউজিয়ামে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম