দেশজুড়ে

নভেম্বরেই ধু ধু বালুচর তিস্তায়

নভেম্বরের শুরুতেই ধু ধু বালুচরে পরিণত হয় একসময়ের সর্বনাশী তিস্তা নদী। গত এক মাস আগেও সেখানে ছিল অর্থে পানি। এখন সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র। শুকিয়ে খাঁ খাঁ করছে। যেন এক মরা নদী। বিশাল বালুর স্তূপে মূল গতিপথ হারাতে বসেছে। নদীতে পানি না থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছে তিস্তা পাড়ের জেলেরা।

Advertisement

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, তিস্তা ব্যারাজের ৫২টি গেটের মধ্যে ৪৫টি বন্ধ করে উজানে পানি আটকানোর চেষ্টা করছে কর্তৃপক্ষ। এতে যেটুকু পানি উজানে জমছে তাতেই ব্যারাজটির বাকি সাতটি গেটের মাধ্যমে সেচ কার্যক্রম পরিচালিত হবে। কিন্তু চলতি সপ্তাহে পানিপ্রবাহ মাত্র ১ থেকে দেড় হাজার কিউসেকে ওঠানামা করায় সেচের লক্ষ্যমাত্রা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছে কর্তৃপক্ষ।

দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্পের তিস্তা ব্যারাজ দাঁড়িয়ে আছে বালুচরে। চলতি বছরের জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর মাসে টানা বর্ষণ আর উজানের ঢলে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছিল তিস্তা নদী। ওই সময় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধায় অবস্থিত দেশের বৃহত্তম সেচ প্রকল্প ‘তিস্তা ব্যারাজ’ রক্ষায় খুলে দেয়া হয় ৫২টি গেট। এতে শুধু ব্যারাজের উজানের বাসিন্দারাই নন, ভাটিতে থাকা লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। নদীভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে নিঃস্ব প্রায় ৩০ হাজার পরিবার।

একসময়ের প্রমত্তা তিস্তার নাব্য এতটাই হ্রাস পেয়েছে যে, আসন্ন রবি মৌসুমে ব্যারাজের সেচ কার্যক্রম চালানোই কঠিন হয়ে পড়বে। প্রতিদিনই পানি কমছে। কোথাও সামান্য পানি আবার কোথাও বিস্তীর্ণ বালুচর। ব্যারাজ থেকে শুরু করে তিস্তার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে পানি না থাকায় শঙ্কায় পড়েছেন কৃষকরা।

Advertisement

তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় একদিকে যেমন বর্ষা মৌসুমে ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে প্রতি বছর উত্তরাঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ নিঃস্ব হচ্ছে, তেমনি শুষ্ক মৌসুমে ব্যারাজের ভাটিতে ভারত গোজল ডোবা নামক স্থানে বাঁধের সাহায্যে একতরফা পানি আটকে বাংলাদেশের উত্তর জনপদের লাখ লাখ কৃষকের বোরা চাষাবাদ ব্যাহত করছে। ফলে দিন দিন অকার্যকর হয়ে পড়েছে দেশের বৃহত্তম তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্প।

এ অবস্থায় পানির ন্যায্য হিস্যা আদায় করে তিস্তা নদী বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছেন লালমনিরহাট, নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজাপুরসহ এ অঞ্চলের অধিবাসীরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে যে হারে পানিপ্রবাহ কমছে তাতে শিগগিরই কাঙ্ক্ষিত পানি চুক্তি না হলে, মরা খালে পরিণত হতে পারে এককালের প্রমত্তা তিস্তা নদী। সেই সঙ্গে এই নদীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা উত্তর জনপদের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।

তিস্তা সেচ প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে উজানের পানির ওপর। কিন্তু নদীতে পানি কম আসার কারণে সেচযোগ্য জমির আওতা কমছে। শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে খাঁ খাঁ করে বালুচর। বর্ষাকালে পানি উপচে ভাঙনের মুখে পড়ে বসতবাড়ি, স্কুল-কলেজ, মাদরাসা, সড়ক-পুল-কালভার্ট। ফলে চাষাবাদ কমে বদলে যাচ্ছে এলাকার মানুষের জীবিকা।

Advertisement

চলতি বছরের নভেম্বরেই লালমনিরহাটের পাঁচ উপজেলার তিস্তাপাড়ের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে চোখে পড়ে ধু ধু বালুচর। চরের মধ্যে ভেঙে পড়ে আছে একাধিক সড়ক ও সেতু।

স্থানীয়রা জানান, একসময় সেখানে ছিল জনপদ, আগে প্রচুর ভুট্টার আবাদ হলেও এখন আর হচ্ছে না। বর্তমানে বালুচরে পরীক্ষামূলক চিনাবাদাম, মিষ্টি কুমড়া ও তরমুজ চাষ করছেন কৃষকরা।

জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলার দোয়ানীতে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তিস্তা সেচ প্রকল্প চালু হয় ১৯৯৮ সালে। এর মাধ্যমে নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ১২টি উপজেলার ৯০ হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় আসার কথা।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ডালিয়া বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রবিউল ইসলাম বলেন, উজান থেকে পানি কম আসায় সেচযোগ্য জমির আওতা কমানো হচ্ছে।

এলাকাবাসীর আশা, ভারতের সঙ্গে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি হলে তাদের ভোগান্তি আর থাকবে না। পানিপ্রবাহ একটা নিয়মের মধ্যে থাকবে। যদিও চুক্তিটি কী ধরনের হবে তা জানেন না তারা।

এদিকে নদীতে পানি কম থাকায় জেলেরা বেকার হয়ে পড়েছেন। প্রায় ২০ বছর ধরে তিস্তায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করছেন লালমনিরহাটের গড্ডিমারী ইউনিয়নের দোয়ানী গ্রামের সুলতান (৫০)। তিনি জানান, এখন নদীতে পানিও নেই, মাছও নেই। তাই পরিবার নিয়ে খুব কষ্টে আছি।

একই গ্রামের ছোবাহান মিয়া (৪০) বলেন, সাত-আট বছর আগেও এ সময় তিস্তায় মাছ পাওয়া যেত। এখন নদীতে পানি না থাকায় প্রতি বছর মাছ কমে যাচ্ছে। অনেক জেলে পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে দিনমজুরের কাজে নেমেছেন।

দোয়ানী উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রবিউল ইসলাম বলেন, পানি বণ্টন চুক্তি না হওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে চৌচির হয়ে পড়ে নদী। জেগে ওঠে অসংখ্য চর। বর্ষায় হঠাৎ করে পানির ঢল নামায় নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে বন্যার সৃষ্টি হয়। এতে বাড়িঘর গ্রামগঞ্জ-হাটবাজার, রাস্তা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, পুল-কালভার্ট সব ভেঙে তছনছ হয়ে যায়।

তিস্তা সেচ প্রকল্পের সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাফিউল বারী বলেন, তিস্তা ব্যারাজ সেচ প্রকল্পের আওতায় আগামী বছরের জানুয়ারি থেকে সেচ কার্যক্রম শুরু হবে। বর্তমানে পানি স্বল্পতার কারণে সেচ সুবিধার লক্ষ্যমাত্রা ১০ হাজার হেক্টর জমি নির্ধারণ করা হয়েছে।

রবিউল হাসান/এমএমজেড/জেআইএম