মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তর ঈদ তথা আন্দোৎসব হচ্ছে কোরবানি। এর মূল মর্মবাণী হচ্ছে উৎসর্গ করা। সৃষ্টিকর্তার নৈকট্য লাভের আশায় পশু কোরবানি দেওয়া এই ঈদের প্রধান লক্ষ্য। মুসলিম সম্প্রদায় এই ঈদে তা-ই করে থাকে। একই সঙ্গে কোরবানিকৃত পশুর মাংসের একটি নির্ধারিত অংশ গরিবের মধ্যে বিতরণের মাধ্যমে ত্যাগের মানসিকতা, গরিবের পাশে থাকা, পশুর চামড়ার মূল্য নিজে ভোগ না করে গরিবদের কল্যাণে ব্যয় করার নীতি বিধান রয়েছে। এসব ধর্মীয় বিধানের তাৎপর্য নিঃসন্দেহেই সমাজজীবনে বড় ধরনের প্রভাব বিস্তার করে থাকে। তাছাড়া ঈদ উল আজহা উপলক্ষে সামর্থ্যবান মুসলমানদের একটি বিরাট সংখ্যক নারীপুরুষ মক্কায় হজ পালন করতে যান। এর মাধ্যমে বৃহত্তর পরিসরে মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের ভ্রাতৃত্ব বোধ জাগ্রত হওয়ার সুযোগ ঘটে। ঈদ-উল-আজহা উপলক্ষে পালিত এসব অনুষ্ঠান, বিধান, আচার, সম্প্রদান ইসলাম ধর্মের শুরু থেকেই চলে আসছে। তবে যুগে যুগে ঈদের আনুষ্ঠানিকতায় দেশে দেশে নানা পরিবর্তন এসেছে। সমাজ, রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সম্পর্ক, যাতায়াত ইত্যাদির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এ সব পরিবর্তন অনেক বেশি বিস্তৃত হয়েছে। এক সময় হজ পালনের জন্যে মানুষ পায়ে হেঁটে মক্কা যেতো। অনেকেই এক বছর আগেই নিকটজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পায়ে হেঁটে এমন যাত্রা করতেন। তাদের বেশির ভাগই আর ফিরে আসতেন না। দুর্গমপথ, নদীপথ ইত্যাদি অতিক্রম করে দূরদেশ থেকে মক্কায় হজ পালন করতে যারা যেতেন তাদের মানসিক বল ও বিশ্বাসের ভিত্তি কতোটা প্রবল ছিল তা ভাবতেই অবাক হতে হয়। তখন খুব কম মানুষই পথঘাট চিনতেন, নদীপথ অতিক্রম করাও ছিল বেশ কঠিন। তারপরও অনেকেই সেই কষ্ট করতে দ্বিধা করেন নি। আমার বাবা-চাচাদের কাছে শুনেছি আমাদের দাদার বাবা এবং মা এভাবে পদব্রজে হজ পালন করতে বিদায় নিয়ে যাওয়ার পর তারা আর ফিরে আসেন নি। তবে তারা হজ করতে বাড়ি ত্যাগ করার পর প্রতিবেশিরা আমাদের বাড়িটিকে হাজিবাড়ি বলেই ডাকা শুরু করেন। সম্ভবত একশ বিশ-ত্রিশ বছর আগে এ ঘটনা ঘটেছিল । এখনও এলাকার মানুষ আমাদের বাড়ির নাম হাজিবাড়ি বলেই জানে, দাদার বাবাদের পূর্ব পুরুষগণ যেহেতু পাটোয়ারী ছিলেন তাই কাগজ কলমে বা দলিল দস্তাবেজে আমরা পাটোয়ারী বাড়ির মানুষ। কিন্তু হাজিবাড়ি বলেই সবাই এখনও ডাকে। অথচ এখন অনেকেই জানেনই না যে, এই হাজিবাড়ি নামের উৎসটা কোথা থেকে এসেছে? কিন্তু একবার হাজিবাড়ি নাম উচ্চারিত হওয়ার পর সেটি চলে আসছে শত বছরেরও অধিক সময় ধরে। শুধু পায়ে হেঁটে কেন, পাকিস্তান অামলে জাহাজযোগে অনেকেই হজ পালন করতে যেতেন, এটি একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় হজ পালনের ব্যবস্থা ছিল। তখনও আসা যাওয়ায় প্রায় তিন থেকে চার মাসের মতো সময় লেগে যেত। সে কারণে যারাই হজ করতে মক্কা যেতেন তারা নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে বিদায় নিয়েই যেতেন। তবে তখন মানুষের খারাপ আর্থিক অবস্থা এবং যাতায়াতের সমস্যার কারণে প্রতি বছর হজ পালনকারীর সংখ্যা খুবই সীমিত ছিল, একইভাবে কোরবানির ঈদও বিশেষভাবে সীমিত ছিল ঈদগাহে নামাজ পড়া, মিষ্টান্ন খাওয়া এবং কোরবানির মাংস বিতরণের মধ্যে। খুব অল্প সংখ্যক মানুষের পক্ষেই গরু-ছাগল ক্রয় করে কোরবানি দেওয়া সম্ভব হতো। তবে পরিবারের কেউ কেউ গরু ছাগল লালন-পালন করে কোরবানি দিতো, কৃষকদের মধ্যে অনেকেই হালচাষের অযোগ্য গরুকেই কোরবানি দিতো। তবে গ্রামে কোরবানি দেওয়া মানুষের সংখ্যা হাতেগোনা কিছু সংখ্যক ছিল। ছাগল কোরবানির সংখ্যা গরুর চাইতে বেশি ছিল। কেননা, গরুর দাম এবং অংশীদার মেলানো খুব সহজ ছিল না। সেক্ষেত্রে ছাগলের অবস্থানটি তুলনামূলকভাবে সহজ ছিল। আমাদের কিশোরকাল পঞ্চাশের শেষ এবং ষাটের শুরু। তখন কোরবানি এখনকার মতো রমরমা ছিল না, এতো গরু-ছাগল কোরবানি দেওয়ার কথা গ্রামে ভাবাই যেত না। আমাদের ছোটকালে এতো প্রচার মাধ্যমে ছিল না। কোথাও গরু-ছাগল সস্তায় কোথায় কম দামে বিকোচ্ছে তা সহজে জানা যেত না। গ্রামে কোন বছর- কে গরু বা ছাগল কোরবানি দেবেন- তা আগে খুব একটা জানা যেত না। ঈদের ২/৪ দিন আগে শোনা যেত অমুক বাড়ির অমুক অমুক এক ভাগ বা দুই ভাগ নামে কোরবানি দেবেন। আমাদের বাড়িতে আমাদের এক চাচার আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো ছিল। তারা প্রতি বছর এক নামে কোরবানি দিতেন, আমার বাবার হাতে যে বছর বাড়তি অর্থ-থাকতো- সে বছর এক নাম দিতেন। গোটা বাড়ির ৬টি পরিবারের অর্ধেক সংখ্যক পরিবার কোরবানি দিতে পেরেছেন- এমনটি খুব বেশি মনে পড়ে না। আমি ষাটের দশকের কথাই বলছি। তবে ঈদে সবার ঘরে যে মাংস আসতো তাতে সবাই মিলে মিশে এক-দুই বেলা মাংস দিয়েই ভাত বা রুটি খেতে পারতেন। যারা কোরবানি দিতো তারা অন্তত চেষ্টা করতেন বাড়ির সব কটি ঘরে মাংস বিতরণ করতে। তবে গ্রামে অনেক বাড়িই ছিল যে বাড়িতে কেউ কোরবানি দেওয়ার সামর্থ্য রাখতেন না। সে সব বাড়িতে সবাইকে মাংস বিতরণ করা খুব একটা সম্ভব ছিল না। গোটা গ্রামে অল্প কয়েকটি গরু বা ছাগল কোরবানি দেওয়া হতো। সবার মধ্যে মাংস বিতরণ করার সুযোগ অনেক সময় হতো না। সমস্যাটি ছিল কাকে রেখে কাকে মাংস দেওয়া, না দেওয়া। চক্ষুলজ্জার কারণেই তা করা সম্ভব হতো না। তবে গ্রামে বেশ কিছু পরিবার ছিল-যারা একেবারেই নিঃস্ব ছিল। সকলে চেষ্টা করতো সেই সব বাড়ি বা ঘরে মাংস বিতরণ করতে। তবে যে সব নিম্নমাঝারি বিত্তের পরিবারে গরু বা ছাগল কোরবানি দেওয়া সম্ভব হতো না-তারা ঈদের দিনে মুরগির মাংস, ভালো মাছ, তরিতরকারির খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা রাখতো, যাতে শিশুদের মধ্যে হীন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না হতে পারে। এমন একটি সময়ের কথা এখন ভাবা যায় কি?স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে ধীরে ধীরে অবস্থা বদলাতে শুরু করে। তবে সত্তরের গোটা দশকটি বেশ কষ্টের ছিল, আশির-দশকের মাঝামাঝি পরিবর্তনটা অনুভূত হতে থাকে, নব্বই দশকে তা দৃশ্যমান হতে থাকে, একুশ শতকের শুরু থেকে এখন ব্যাখ্যা করে বলার কিছু নেই। এখন গ্রামগঞ্জেও দারিদ্র্যের প্রভাব ব্যাপকভাবে কমে গেছে। আমার নিজের গ্রামের বাড়িতে সেই যুগে যখন একভাগ কোরবানির বেশি সচরাচর ছিল না, এখন ৬/৭টি পরিবারে একত্রে ২ থেকে ৩টি গরু এবং ২/১টি ছাগল কোরবানি দিতে দেখা যাচ্ছে। এমন কোনো বাড়ি নেই যে বাড়ির চালচিত্র এর চাইতে কোনো অংশে খারাপ। গ্রামের যে সব তরুণ বিদেশে থাকে তারা এক মাস আগেই বাবা-মাকে কোরবানির টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছে, যারা গ্রামে কাজকর্ম করে তারাও অন্তত পক্ষে এক নামের কোরবানি দেওয়ার চেষ্টা করে। বেশির ভাগ মানুষই ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকুরি এবং আত্মনির্ভরশীল কাজ কর্ম করে বেশ ভালো অর্থ-উপার্জন করছে। এরা এখন কারো মুখাপেক্ষী খুব একটা নন। ঈদের আনন্দ পরিবারে ভাগাভাগি করে নিতে গরু, ছাগল যার পক্ষে যা সম্ভব তাই কোরবানি দিয়ে থাকে। ফলে কোরবানি উপলক্ষে গ্রামের হাটবাজার বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে, লাখ টাকার গরুতে গ্রামের বাজারও ভরে ওঠে। গ্রামের প্রতিটি বাজারই এখন কোরবানির গরুতে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রশ্ন উঠছে, কোত্থেকে আসে এসব গরু, ছাগল? এর উত্তর হচ্ছে, স্থানীয়ভাবে অনেক খামারি এখন কোরবানির গরু, ছাগল, লালন পালন করে থাকেন। তারা বেশ সংখ্যক পশু পালন করেন কোরবানি উপলক্ষে সেগুলো বিক্রি করবেন বলে। এটি তাদের অর্থ উপার্জনের একটি ভালো উপায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিপুল সংখ্যক কৃষক, ফড়িয়া তাতে ভালো আয় করছেন। তাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে কোরবানির পশুপালনকে বেছে নিয়েছেন। এসব গরু, ছাগল মহিষ স্থানীয় বাজারে বেশ বিকোচ্ছে। আবার বাইরে থেকেও অনেক ফড়িয়া গরু নিয়ে আসে। এখন মোবাইল ফোনের যুগ। যেখানে সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে সেখানে ঈদ উপলক্ষে পশু সরবরাহ দিতে কোনো দেরি হয় না। শহরগুলোর অবস্থা সকলেরই জানা আছে। লক্ষ লক্ষ মোটাতাজা পশু এসব বাজারে কোরবানি উপলক্ষে বিক্রি হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ এই সিজনে পশু কেনা-বেচায় যুক্ত হয়ে বেশ মোটা অংকের আয় ঘরে তুলে নিতে সচেষ্ট থাকে। শুধু গরু ছাগলই নয়, এগুলোর চামড়া বেচা কেনাতেও রমরমা ব্যবসা চলছে। এক ঈদেই ৭০/৮০ লাখের বেশি চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে। এর সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে অনেকেই জড়িত থাকে। একই সঙ্গে কোরবানিতে নানা ধরনের মসলা ও রাঁধুনি সামগ্রী বেচাকেনার একটি বড় বিষয় এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কাপড়-চোপড়, জুতা-স্যান্ডেল, গয়নাপাতিতো রয়েছে। সব মিলিয়ে কোরবানির ঈদ উপলক্ষে বাংলাদেশে হাজার হাজার বা কয়েক লাখ কোটি টাকার ব্যবসা চাঙ্গা হয়ে থাকে, প্রতি বছর এর আকার বাড়ছে, ঈদ অর্থনীতি বলে একটি নতুন ধারণা তৈরি হয়ে গেছে। সমাজের নানা স্তরে নানা গোষ্ঠী বাণিজ্যের পসরা সাজিয়ে বসে, অর্থ-উপার্জন করে, দেশের চামড়া শিল্প দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে এই কোরবানি থেকে প্রাপ্ত পশু চামড়ায় ভালোভাবে লাভবান হচ্ছে। বাংলাদেশে পশু পালনের খামারি, সহযোগী নানা গোষ্ঠী, মসলা ব্যবসায়ী, নানান সামগ্রীর ব্যবসাও এরসঙ্গে চাঙ্গা হয়ে উঠছে। ফলে বলতে দ্বিধা নেই, কোরবানির ঈদ একদিকে যেমন আত্ম উৎসর্গ, সংযম,পরার্থে নিজেকে যতোটুকু সম্ভব বিলিয়ে দেওয়া এমনি মহিমায় বেড়ে উঠছে, একই সঙ্গে এটি ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সামষ্টিকভাবে জাতীয়, ব্যক্তিগত আর্থিক উন্নতি ও সামাজিক সমৃদ্ধিতেও বড় ধরনের ভূমিকা রেখে চলছে। এর ইতিবাচক ধারাকে আরো কিভাবে বেগবান করা যায়, মানুষের মধ্যে ত্যাগ ও সংযমের ধারাকে বেশি বেশি সমৃদ্দ করা যায় সেদিকে দৃষ্টি দিয়ে কোরবানিকে আরো অর্থবহ, তাৎপর্যময় করে তুলতে হবে। লোক দেখানো নয়, প্রকৃত মানব সেবায় এটিকে ব্যবহার করার শিক্ষা নিতে হবে। তবেই কোরবানির মৌল উদ্দেশ্য এবং শিক্ষার যথাযথ প্রতিফলন মানুষ ও সমাজজীবনে ঘটবে। এইচআর/এমএস
Advertisement