মতামত

পেঁয়াজ : ভারতের দোহাইয়ে বাড়ে, কমে না কেন?

পেঁয়াজ না আপেল ভালো? পেঁয়াজ ছাড়া কি তরকারি হয় না? ইত্যাকার নানা প্রশ্নগুলো কম-বেশি নিশ্চয়ই সবাই শুনছেন। পেঁয়াজ নিয়ে সবার মুখেই এক আলোচনা- পেঁয়াজের বাজারের এতো ঝাঁজ কেন? পেঁয়াজ-শব্দটা শুনলেই আমার মনে হয় চকারপাশ জ্বলছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার মতো অনেকেরই এখন পেঁয়াজের কথা শুনলে এমনটাই মনে হচ্ছে। কারণ, বাঙালির খাদ্য তালিকার একটি অবিচ্ছেদ্য উপাদান এই পেঁয়াজের অত্যধিক চড়া বাজার মূল্য।

Advertisement

পরিমাণের দিক দিয়ে পেঁয়াজ বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ মসলা। তবে শুধু মসলা বললে ভুল হবে। কারণ পেঁয়াজ একাধারে মসলা এবং সবজিও বটে। সেই পেঁয়াজের ঝাঁজে গত মাস দুয়েক ধরে পুড়ছে সাধারণের পকেট। এখন পেঁয়াজ খাওয়াটা মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য গরীবের ঘোড়া রোগের মতো দাঁড়িয়েছে। এ ক'দিনে পেঁয়াজের ঊর্ধ্বমূল্যের বাজারে উচ্চবিত্ত ছাড়া প্রায় সব শ্রেণির মানুষেরই রুদ্ধশ্বাসে চলছে জীবন। বলছেন, এক পেঁয়াজেই যদি কেজি প্রতি একশ' ২০ থেকে দেড়শ' টাকা গুণতে হয়, তাহলে বাকি নিত্য প্রয়োজনীয় কেনা হবে কিভাবে?

যদিও গত এক দশকে মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু কাজীর গরু তো গোয়ালে না থেকে, শুধু কিতাবে থাকলে লাভ নেই। কাগজ-কলমের হিসাবের সাথে সাধারণের জীবনের হিসাব তো মেলে না। গত দশ বছরে সরকারি কর্মকর্তাদের কয়েক দফা বেতন-ভাতা বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু দেশের বেশির ভাগ মানুষ তো আর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নন। ধনিক শ্রেণির কথা না হয় বাদ রাখা গেল। কিন্তু মাঝারি ধরনের ব্যবসায়ি বা বেসরকারি চাকরিজীবী- যার কথাই বলুন না কেন, যারা স্বল্প আয়ের মানুষের তালিকায় পড়েন, তাদের সংখ্যাই তো এই দেশে বেশি। আর যেকোন পণ্যের বাজার দর বাড়লে, তারাই হয় ভুক্তভোগী।

কথা হচ্ছিল পেঁয়াজের বর্তমান বাজার পরিস্থিতি নিয়ে। আমাদের দেশে চাহিদা বৃদ্ধির সাথে সাথে পেঁয়াজের উৎপাদনও বাড়ছে, বাড়ছে আমদানির পরিমাণও। রমজান মাসে ও কুরবানি ঈদের সময় পেঁয়াজের চাহিদা দ্বিগুণ/তিনগুণ হয়ে যায়। বিশেষ করে রমজান মাসে পেঁয়াজের ব্যবহার অনেক বেশি বেড়ে যায়। সেই অজুহাতেও ব্যবসায়ীরা পেঁয়াজের দর এক/দুই দফা বাড়িয়ে দেন, যা চলতে থাকে কুরবানীর ঈদের পরও বেশ কিছুদিন। কিন্তু এ বছরের মতো এতটা অস্থির বাজার দেখা যায়নি স্মরণকালে।

Advertisement

আগস্টের শেষ দিকে প্রায় হঠাৎই অস্থিরতা দেখা দেয় পাইকারি ও খুচরা পেঁয়াজের বাজারে। ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তারা এর জন্য ভারতীয় পেঁয়াজের বাজারকে দায়ী করেন। কয়েকদিন আগে ভারত রপ্তানির সর্বনিম্ন মূল্য প্রায় তিনগুণ বাড়িয়ে ৮৫০ ডলার নির্ধারণ করে- ফলে পরদিনই বাংলাদেশের বাজারে দাম বেড়ে যায়। কিন্তু গত এক সপ্তাহে ভারতের বাজারে পেঁয়াজের দর যে হঠাৎই জনসাধারণের হাতের মুঠোয় চলে এসেছে এক ঝটকায়, তার কোন প্রভাব তো আমাদের বাজারে এখনও পড়ছে না।

ভারতের মহারাষ্ট্রসহ বিভিন্ন অঞ্চলে পেঁয়াজের পাইকারী দর প্রায় তিনগুণ কমেছে। প্রকারভেদে কেজি প্রতি পাঁচ টাকা থেকে ২৯ টাকায় পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে ভারতে। প্রশ্ন হলো, প্রায় এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেল আমাদের দেশে দাম করছে না কেন? বাজার দর বৃদ্ধির সময় তো সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা চোখের পলকে পণ্যের দর বাড়িয়ে, ভারতের দোহাই দিয়ে দেন। দরপতনের ক্ষেত্রে কেন কোন তৎপরতা তাদের দেখা যায় না কেন? ব্যবসায়ী আর আড়তদারদের জিজ্ঞেস করতে চাই- পেঁয়াজ দর বৃদ্ধি করেছেন ভারতে বেড়েছিল বলে, তাহলে এখন সেখানকার দাম কমানোর উদাহরণ দেখে নিজেরা দৃষ্টান্ত রাখছেন না কেন?

বাংলাদেশে পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৪ লাখ টনের বিপরীতে উৎপাদন হয় ২৩ লাখ টনের কিছু বেশি। গত দু'মাস ধরে সরকার বলে আসছে, পেঁয়াজের দর বৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ পর্যাপ্ত মজুদ আছে। অথচ, সরকারের জরিপকারী দুই সংস্থা- বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর-ডিএই, পেঁয়াজের উৎপাদন নিয়ে দুই রকম হিসাব দিচ্ছে। এক সংস্থার সঙ্গে অন্য সংস্থার উৎপাদনের তথ্যে ফারাকও প্রায় পাঁচ লাখ টনের বেশি। পেঁয়াজ উৎপাদনের এই ‘বিভ্রান্তিকর’ পরিসংখ্যান নিয়েই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দেশে পেঁয়াজের কোনো ঘাটতি নেই। প্রশ্ন হলো, যদি ঘাটতি না থাকে তাহলে বাজার মূল্য জনসাধারণের হাতের নাগালে থাকছে না কেন?

দেশের বেশ কয়েকটি বাজার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পাইকারি বাজারে দু'একদিন দাম বেশ কিছুটা কমলেও ফল পায় না খুচরা ক্রেতারা। তবে ব্যবসায়ীরা আশ্বস্ত করছেন এই বলে যে, আগামী ডিসেম্বরেই দেশে নতুন পেঁয়াজ উঠবে। আবার অন্যান্য দেশ থেকেও পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে। ফলে পেঁয়াজের বাজারে স্থিতিশীলতা আসবে। তার মানে কি, এ ক'দিন ব্যবসায়ীদের যে, যেভাবে পারছেন সেভাবেই পেঁয়াজ বিক্রি করবেন? বাজার দর কমাতে পারলেও কমাবেন না! অন্যতম প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান এই পেঁয়াজের দর যাদের নিয়ন্ত্রণে তাদের মনে রাখা উচিত- মুনাফাই ব্যবসার প্রধান বিষয় নয়, নীতি-ধর্মও ব্যবসার অন্যতম উপাদান। তাই ব্যবসা করুন, কিন্তু জনগণকে জিম্মি করে নয়।

Advertisement

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।

এইচআর/জেআইএম