চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ভর্তি পরীক্ষায় বাংলা মাধ্যম, ন্যাশনাল কারিকুলাম (ইংরেজি মাধ্যম) ও ব্রিটিশ কারিকুলাম- এই তিন ক্যাটাগরির শিক্ষার্থীরা অংশ নিয়ে থাকে। তাদের জন্য আলাদা প্রশ্নও প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু গত ২৮ অক্টোবর ‘ডি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপানো প্রশ্নে ছিল না বাংলা বিষয়ের অংশটি। এটির পরিবর্তে তাদের ব্রিটিশ কারিকুলামের ‘স্পেশাল ইংলিশ’ অংশটি উত্তর দিতে বলা হয়। কিন্তু যা ছিল পরীক্ষার নিয়মবহির্ভূত। সকাল-বিকাল দুই শিফটেই এমন নিয়মবহির্ভূতভাবে পরীক্ষা নেয়া হয়। শুধু তাই নয়, বিকেলের শিফটে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের জন্য নির্ধারিত ক্যাটাগরির প্রশ্নে সাধারণ জ্ঞানের অংশে একটি প্রশ্নের ছিল না সঠিক উত্তর।
Advertisement
‘ডি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষাজুড়ে ছিল এমনই অসঙ্গতির চিত্র। তবে এরই মধ্যে ইউনিটটির ফল প্রকাশ স্থগিত করা হয়েছে। ৬ নভেম্বর পুনঃপরীক্ষার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। আগের পরীক্ষায় উপস্থিত ন্যাশনাল কারিকুলামের ৪১৬ জন শিক্ষার্থী এতে অংশ নেবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে। এতে করে যে ফলাফল তৈরি করা হবে, তাতে বৈষম্যের আশঙ্কা করছেন শিক্ষার্থীরা।
পরীক্ষার দিন ৩ কক্ষে যা ঘটেছিল২৮ অক্টোবর দুই শিফটে অনুষ্ঠিত হয় ‘ডি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা। এতে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের নিচতলার ১০১, ১০২ ও ১০৩ নম্বর কক্ষ নির্ধারিত ছিল ন্যাশনাল ও ব্রিটিশ কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের জন্য।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, সেখানে ন্যাশনাল কারিকুলামের ইংরেজি মাধ্যমের ৪১৬ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিল। প্রথম শিফটে পরীক্ষা শুরু হলে তাদের (ন্যাশনাল কারিকুলাম) জন্য আলাদা প্রশ্ন সরবরাহ করা হয়নি। ওই শিক্ষার্থীদের বাংলা অংশের প্রশ্নের উত্তর দেয়া আবশ্যিক হলেও, তাদের ব্রিটিশ কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের জন্য ছাপানো প্রশ্ন দেয়া হয়। যাতে ছিল না বাংলা অংশটি। এমন প্রশ্ন পেয়ে তিনটি কক্ষের শিক্ষার্থীরা আপত্তি জানালে, কক্ষগুলোতে দায়িত্বরত শিক্ষকরা ব্রিটিশ কারিকুলামের প্রশ্নের ‘স্পেশাল ইংলিশ’ অংশটি উত্তর করতে নির্দেশনা দেন। পরে শিক্ষার্থীরা সে নির্দেশনাই অনুসরণ করে। দ্বিতীয় শিফটের ক্ষেত্রেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়।
Advertisement
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন নির্দেশনা ‘মারাত্মক অনিয়ম’। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা নিয়মাবলি অনুযায়ী যাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে শিক্ষা কার্যক্রমে মাতৃভাষা বাংলা নয় তারাই কেবল ‘স্পেশাল ইংলিশ’ অংশটি উত্তর দিতে পারবে। কিন্তু তা উপেক্ষা করে ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের ‘স্পেশাল ইংলিশ’ অংশের উত্তর দেয়ার নির্দেশনা দেয়াটি ছিল নিয়মবহির্ভূত।
কে দিয়েছিলেন এমন সিদ্ধান্তওই তিনটি কক্ষে শিক্ষার্থীদের আপত্তির মুখে দায়িত্বরত শিক্ষকরা যে নির্দেশনা দেন তা ছিল ‘নিয়মবহির্ভূত’। বুধবার দিনভর এ নিয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের একাধিক শিক্ষকের সাথে কথা বলেন এই প্রতিবেদক।
তারা জানান, ইউনিট প্রতিনিধি হিসেবে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সেই তিনটি কক্ষে দুই শিফটেই পালাক্রমে অবস্থান করেন লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী। যদিও ডিউটি রোস্টার অনুযায়ী তার শিক্ষা অনুষদে দায়িত্ব পালন করার কথা ছিল। কিন্তু এর আগে ডি ইউনিটের কো-অর্ডিনেটরের নির্দেশে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের কিছু শিক্ষার্থীর জন্য বাংলা প্রশ্ন নিয়ে সেখানে যান। ১০১ থেকে ১০৩ কক্ষে ওই শিক্ষার্থীদের আপত্তির বিষয়টি দায়িত্বরত শিক্ষকরা অধ্যাপক ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী কে জানান। তিনি সমস্যা সমাধানে পরিস্থিতি বিবেচনায় ‘স্পেশাল ইংলিশ’ অংশের উত্তর দেয়ার নির্দেশ দেন।
বিষয়টি স্বীকার করে অধ্যাপক ড. কাজী এস এম খসরুল আলম কুদ্দুসী সাংবাদিকদের বলেন, প্রশ্নসংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিলে বিষয়টি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদকে জানিয়েছিলাম। ওই সময় বাংলার অতিরিক্ত প্রশ্নও পর্যাপ্ত ছিল না যে, শিক্ষার্থীদের আলাদা করে দেয়া হবে। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন নিষ্ক্রিয় থাকায় পরিস্থিতি বিবেচনায় ন্যাশনাল কারিকুলামের শিক্ষার্থীদের ব্রিটিশ কারিকুলামের ‘স্পেশাল ইংলিশ’ অংশটি উত্তর দেয়ার নির্দেশ দেই। কারণ তখন তো শিক্ষার্থীদের ছেড়ে দেয়া যায় না। নেটওয়ার্কের সমস্যার কারণে ‘ডি’ ইউনিটের কো-অর্ডিনেটরকে বিষয়টি জানাতে পারিনি।
Advertisement
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ জাগো নিউজকে বলেন, এখন মিথ্যাচার করা হচ্ছে। ওইদিন ওই তিন কক্ষের সমস্যার বিষয়ে ড. খসরুল আলম কুদ্দসী আমাকে কিছুই জানাননি।
অধ্যাপক ড. ফরিদ উদ্দিন আহামেদ বলেন, ওইদিন দায়িত্বরত কোনো শিক্ষক বা কোনো লেভেল থেকে আমাকে বিষয়টি জানানো হয়নি। জানালে ১০ মিনিটের মধ্যে বিষয়টির সমাধান করা যেতো। তখন শুধু বাংলা বিষয়ের প্রশ্ন সরবরাহ করলে সমাধান হতো। কুদ্দুসী কোন দায়িত্ব এখানে এসেছেন আর ওই কক্ষগুলোতে কী সিদ্ধান্ত দিয়েছেন তা আমার জানা ছিল না। ইউনিটপ্রধানও সেটি আমাকে অবহিত করেননি। তাছাড়া পরীক্ষার দায়িত্ব বণ্টনের ফাইলে তার নামও দেখিনি। প্রথম শিফটের পর বিরতি ছিল তখন পর্যন্ত কেউ বিষয়টি আমাকে জানায়নি। আমি কয়েকজন অভিভাবক থেকে পরে জেনেছি।
নিয়মবহির্ভূত এই ঘটনা জানতেন না উপাচার্য ও ইউনিটপ্রধান২৮ অক্টোবর ‘ডি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা শুরুর পর দুই শিফটে ন্যাশনাল কারিকুলামের ৪১৬ জন শিক্ষার্থী প্রশ্ন নিয়ে জটিলতায় পড়েন। কিন্তু ঘটনার দিন তা কিছুই জানতেন না বিশ্ববিদ্যালয়ের রুটিন দায়িত্বে থাকা উপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার এবং ইউনিট কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল ফারুক। পরীক্ষার পরদিন ২৯ অক্টোবর বিকেলে ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের এক শিক্ষক ও কয়েকজন অভিভাবক উপাচার্যকে ফোনে মৌখিকভাবে বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ করেন। পরে সন্ধ্যায় ইউনিট সদস্যদের নিয়ে বৈঠক করেন উপাচার্য। সেখানে এটি নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ দেখা দেয়। সেখানে উপস্থিত থাকা দুই জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের বরাতে জানা যায়, সভায় তিন শিক্ষক ওই পরীক্ষায় অংশ নেয়া ন্যাশনাল কারিকুলামের সব শিক্ষার্থীকে বাংলা অংশের জন্য ৩০ নম্বর দিয়ে দিতে প্রস্তাব দেন। কিন্তু অন্যান্য শিক্ষকদের আপত্তির মুখে সর্বসম্মতিক্রমে ৪১৬ শিক্ষার্থীর পুনঃপরীক্ষা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
এদিকে ভর্তি পরীক্ষায় এমন অসঙ্গতি ও অসামঞ্জস্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। ৪৪ হাজার ৯৬০ জন শিক্ষার্থী ‘ডি’ ইউনিটের পরীক্ষায় অংশ নিলেও পুনঃপরীক্ষায় কেবল ইংরেজি মাধ্যমের ৪১৬ জন শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে। এতে করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি পক্ষ লাভবান, না হয় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়ে যাবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের মতে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কিছু অংশের পরীক্ষা নিলে তা আইনসম্মত হবে না। দুই শিফটে দুই ধরনের প্রশ্ন। ফের পরীক্ষা হলে আরেক ধরনের প্রশ্ন। এক্ষেত্রে প্রশ্নের মানও এক হবে না। শিক্ষার্থীদের কোনো পক্ষের ভুল না হলেও, একটি পক্ষ লাভবান হবে। এতে প্রশাসনের ভুলে বৈষম্যের শিকার হবেন সব শিক্ষার্থী। আর যেহেতু ‘ডি’ ইউনিটের পরীক্ষায় অনেকগুলো অসঙ্গতি প্রতীয়মান, সেহেতু এটি নিয়ে শিক্ষার্থীরা চাইলে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলা মাধ্যমে পরীক্ষা দেয়া এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জাগো নিউজকে বলেন, ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান বলেই প্রশাসন পুনঃপরীক্ষা নিচ্ছে। কিন্তু এতে করে তাদের আবার পরীক্ষার সুযোগ দেয়ায় অন্যরা বৈষম্যের শিকার হবেন। প্রশাসন চাইলে বাংলা মাধ্যমে ফলাফল প্রকাশ করে উত্তীর্ণদের সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের একসাথে পরীক্ষা নিতে পারে। যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যা বলছেউপাচার্য অধ্যাপক ড. শিরীণ আখতার সাংবাদিকদের বলেন, আমাকে কয়েকজন অভিভাবক বিষয়টি জানায়। পরে পরীক্ষা কমিটির সাথে বৈঠক করে ইংরেজি মাধ্যমের পরীক্ষা পুনরায় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কেউ যাতে প্রশ্ন তুলতে না পারে তাই এ সিদ্ধান্ত।
বিষয়টি নিজেদের ভুল স্বীকার করে ‘ডি’ ইউনিটের কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল ফারুক বলেন, আমরা এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করছি। জাহাঙ্গীরনগরে আট শিফটে ভর্তি পরীক্ষা নেয়া হয়। ফলে আমরাও প্রশ্নের মান ঠিক রাখব। এই পুনঃপরীক্ষাকে তৃতীয় শিফট হিসেবে গণ্য করা হবে। এখানে কোনো বৈষম্য হবে না।
বিএ