মানুষে মানুষে আস্থার সঙ্কট তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। রাষ্ট্র, সমাজ, কমিউনিটির ওপর থেকে ব্যক্তির আস্থা কমতে শুরু করেছে বহুকাল আগ থেকেই। বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি আর প্রযুক্তির অভাবনীয় উত্থানে গোটা দুনিয়া আজ একটি মাত্র গ্রামে রূপ নিচ্ছে। গ্রামীণ মৌলিক কাঠামো ভেঙে পড়ায় ছোট ছোট কমিউনিটিগুলোও (গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়) আজ বিশ্বগ্রামের (গ্লোবাল ভিলেজ) জালে আটকা পড়েছে।তবুও নিজস্ব স্বকীয়তা ধরে রাখতে বিশ্বজুড়ে কতিপয় সম্প্রদায় নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ চেষ্টা যেন কথিত সভ্যতাকে (আধুনিক সমাজ ব্যবস্থা) চ্যালেঞ্জ করার নামান্তর। বাংলাদেশের বেদে-বেদেনীরা তেমনি এক সম্প্রদায়, যারা আস্থাহীন সমাজে পাহাড়সম আস্থা নিয়ে টিকে আছেন। এখনো সরদারকে ঘিরেই ঐক্যবদ্ধ থাকেন বেদে-বেদেনীরা।স্বজনপ্রীতি, পক্ষপাতিত্ব আর হিংসার কারণে গ্রাম্য সালিশ ব্যবস্থা বিলুপ্ত প্রায়। সর্বত্রই আইন-আদালতের হাত। মানুষ আর গ্রাম্য মাতব্বরে ভরসা রাখে না। কিছু ঘটলেই আশ্রয় নিতে চায় থানা-আদালতে। সেখানেও সাধারণের আস্থা কমতে শুরু করেছে।এমন সময়েও সরদারের ওপর থেকে আস্থা কমেনি বেদেদের। বেদেপল্লীতে সরদারই প্রভু আবার সরদারই ভৃত্য। সরদারকে নিশানা করেই তাদের পথ চলা। সরদারের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার শক্তি-সাহস বেদেপল্লীর কারোরই নেই। সরদারের সিদ্ধান্তে পল্লীর সবাই চলেন। বেদেপল্লী অথবা গাওয়ালে গিয়ে নিজেদের মধ্যে যতো বড় জটিল সমস্যাই সৃষ্টি হোক না কেন, তা সমাধানের দায়িত্ব সরদারের ওপরই বর্তাবে।সম্প্রতি সাভারের অদূরে পোড়াবাড়ি বেদেপল্লীতে গিয়ে সরদারের একক কর্তৃত্বের নেপথ্যের কাহিনী জানা গেল। সরদারকে মান্য করা বেদে সম্প্রদায়ের হাজার বছরের সংস্কৃতি। সরদারের নির্দেশ মেনে চলাকে কেউ কেউ ইবাদত সমতুল্যও মনে করে থাকেন।সরদারকে মান্য করার অন্যতম কারণ হচ্ছে, গোটা সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষার্থে সরদারের নিবেদিত ভূমিকা। কোনো সিদ্ধান্তই নিজের স্বার্থে দিয়ে থাকেন না বেদে সরদার। বেদে সম্প্রদায়ের সুখ-দুঃখে অংশীদার হওয়া সরদারের পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করা হয়।তবে দৃশ্যত একক ক্ষমতার অধিকারী হলেও সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে একজন বেদে সরদার সর্বোচ্চ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে থাকেন। নিজেদের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হলে, প্রথমে তা মীমাংসার জন্য শাখা সরদাররা চেষ্টা করেন।মূলত ছোট-খাটো সমস্যাগুলো শাখা সরদাররাই মিটমাট করে থাকেন। কোনো জটিল সমস্যা যদি শাখা সরদাররা সমাধান করতে না পারেন, তাহলে প্রধান সরদারের শরণাপন্ন হন।এমন পরিস্থিতিতে প্রধান সরদার শাখা সরদারদেরকে নিয়ে বৈঠকে বসেন। সেখানে বাদী-বিবাদীর বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে শোনা হয়। এরপর গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় শাখা সরদারদের পরামর্শে প্রধান সরদার সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। এমন সিদ্ধান্ত গোটা সম্প্রদায়ের জন্য মঙ্গলময় বলে বেদেদের বিশ্বাস।বেদে সম্প্রদায়ের বাইরে কোনো পক্ষের সঙ্গে থানা-পুলিশে মামলা হলে, তখন বেদেরা নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে, সেই মামলা মোকাবেলা করে থাকেন। আবার নিজেদের মধ্যে কেউ অবাধ্য হয়ে থানা-পুলিশে গেলে গোটা সম্প্রদায় তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে থাকে।এমন আনুগত্যের বিষয়ে আলাপ হয় শাখা সরদার তাহের উদ্দিনের সঙ্গে। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা থানা-পুলিশের ধার ধারি না। আদালতে যাওয়ার রেকর্ড নেই বললেই চলে। আদালতে যারা বিচার সালিশ করে থাকেন, তারা আমাদের মতোই মানুষ। আমরা যদি আমাদের নিজেদের সমস্যা সমাধান করতে না পারি, অন্য সম্প্রদায়ের মানুষ তা করতে পারবে না। এতে অবিশ্বাস বাড়ে, আমাদের সমাজ ভেঙে যেতে পারে। আমরা তা চাই না।’তিনি বলেন, ‘সহনশীলতাই পরম ধর্ম। আমরা সে ধর্মই মেনে চলি। আমরাও মানুষ। ভুল বোঝাবুঝি থেকে বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হতেই পারে। কিন্তু সেই সমস্যা সরদারের মাধ্যমে সমাধান করা আমাদের সম্প্রদায়ের রীতি, পূর্ব পুরুষদের শিক্ষা।’সরদার তাহের উদ্দিনের কথায় সায় দিয়ে ছেলে সুমন একটি উদাহরণ টেনে বলেন, কয়েক বছর আগে বেদেপল্লীতে একটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এটি আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর ঘটনা ছিল। বাইরের লোকের পরামর্শে ভুক্তভোগী আদালতের আশ্রয় নেয়, যা সবাইকে আরো বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে। পরে সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তে মামলা প্রত্যাহার করে নেয় ভুক্তভোগী পরিবার। এরপর আমাদের সরদার সেই ঘটনার উপযুক্ত বিচার করে বিষয়টির সমাধান দেন। সবাই তার সিদ্ধান্তেই সন্তুষ্ট।’যাযাবর প্রকৃতির এই সম্প্রদায়ের পূর্বে কোনো স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। নৌকাতে ঘাঁটি করেই এদের জীবন চলা। নদীনালার পানি শুকিয়ে যাওয়ায় অনেকেই স্থলভাগে বসতি গড়ছে। সাভারের অমরপুর, পোড়াবাড়ি, কাঞ্চনপুর, বক্তারপুর মিলে দেশের সর্ববৃহৎ বেদেপল্লী। এ পল্লীতে প্রায় ১৫ হাজার বেদে-বেদেনীর বসবাস।সাভার বেদেপল্লীর সরদার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ইউসুফ আলী। তিনি বলেন, ‘সরদারের দায়িত্ব পালন করা পবিত্র কাজ বলে মনে করি। এটি একটি দায়েরও ব্যাপার। ঐতিহাসিক কারণেই বেদে সম্প্রদায়ের লোকজন শান্তিপ্রিয়। লোকের নানা কথা শুনেই আমাদের জীবিকা অর্জন করতে হয়। সহজে রাগলে চলে না। আর এটিই আমাদের ঐক্যতার প্রতীক।’তিনি বলেন, ‘মাঝে মাঝে জটিল সমস্যায় পড়তে হয়। তবুও থানা-আদালতে যাওয়ার রেওয়াজ নেই। থানা-আদালতে গেলে উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়ে। পূর্ব পুরুষদের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে দায়িত্ব পালন করছি। আমার পরে যিনি আসবেন, তিনিও একই শিক্ষা অনুসরণ করবেন বলে আশরা করি।’## বদলে যাচ্ছে বেদে পেশাএএসএস/এসএইচএস/বিএ
Advertisement