>> এভিয়েশন খাত সম্প্রসারিত হলেও মান বাড়ছে না সেবার>> বিমান ভ্রমণ নিরাপদ ও আরামদায়ক করতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ>> এভিয়েশন খাতের মানোন্নয়নে প্রয়োজন সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা
Advertisement
দেশের আকাশ পরিবহন খাত দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে। তবে সেই তুলনায় বাড়ছে না এয়ারলাইন্সগুলোর যাত্রীসেবার মান। গত ১০ বছরে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে চলাচল করা এয়ারলাইন্সগুলোর যাত্রী বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু সেই তুলনায় যাত্রীসেবার মানোন্নয়নে অনেক পিছিয়ে রয়েছে তারা।
বাংলাদেশে ১৯৯৫ সালে বেসরকারি খাতে বিমান চলাচল শুরু হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এ যাত্রা খুব সুখের ছিল না। অভ্যন্তরীণ রুটে তখন যাত্রী ছিল মাত্র তিন লাখ। নয় বছরের মাথায় জিএমজি যখন আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রা করে, তখন অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীর সংখ্যা দাঁড়ায় ছয় লাখে। অথচ গত পাঁচ বছরে অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রীর সংখ্যা ৪৫ লাখ ছয় হাজার ৪০৯ জনে উন্নীত হয়েছে। যা দেশের এভিয়েশন খাতের জন্য খুবই ইতিবাচক।
এদিকে উড়োজাহাজ আমদানিতে জটিলতা, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হ্যাঙ্গার না থাকা, দেশীয় এয়ারলাইন্সের জন্য বেশি জ্বালানি ব্যয় এবং যন্ত্রাংশ আমদানিতে ভ্যাট-ট্যাক্সের নামে হয়রানিতে অতিষ্ঠ দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলো।
Advertisement
ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সুরক্ষা সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
বেসরকারি বিমান পরিবহন সংস্থা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আশিষ রায় চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বেশির ভাগ দেশীয় এয়ারলাইন্সে বোয়িং ৭৪৭ কিংবা ৭৭৭ উড়োজাহাজ ব্যবহৃত হয়। এতে গড়ে তেল ধারণক্ষমতা প্রায় ৪০ হাজার গ্যালন। অথচ এখানে যদি জ্বালানির দাম এক ডলার করেও বেশি হয়, তাহলে প্রতিটি ফ্লাইটে ওই কোম্পানিকে বাড়তি খরচ গুনতে হয় প্রায় ৩২ লাখ টাকা। এরপরে লাভ। তাহলে যাত্রীসেবা আসবে কোথা থেকে?’
তিনি বলেন, দেশীয় এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলোর স্বার্থে এসব সংকট কাটানো এখনই জরুরি। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত আকাশ পরিবহন সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। এর পাশাপাশি রয়েছে দেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো। বর্তমানে তিনটি বেসরকারি সংস্থা অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
‘আকাশে শান্তির নীড়’ শ্লোগান দিয়ে ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারি আত্মপ্রকাশ করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। সুনির্দিষ্ট কর্ম ও বাণিজ্যিক পরিকল্পনার অভাবে প্রতিষ্ঠার ৪৭ বছরেও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানটি প্রকৃতপক্ষে উঠে দাঁড়াতে পারেনি। শুরুর কিছুদিন ভালো চললেও পরবর্তীতে অধিকাংশ সময়ে এটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলে। বর্তমানে ‘বিশ্বের সঙ্গে আকাশ পথের যোগাযোগ স্থাপনে’ কার্যকর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গতকাল বুধবার ষষ্ঠ আন্তর্জাতিক ফ্লাইট সুরক্ষা সেমিনার- ২০১৯ এর সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘গত পৌনে ১১ বছরে বিমানবহরে আমরা বোয়িং কোম্পানির চারটি অত্যাধুনিক ড্রিম লাইনারসহ মোট ১০টি বিমান সংযুক্ত করেছি। আরও দুটি ক্রয় করার প্রস্তুতি নিয়েছি। কারণ আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, আমরা বিশ্বের সঙ্গে আকাশ পথের যোগাযোগ স্থাপন করতে চাই। সে লক্ষ্য নিয়েই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আমরা আশা করি, নিউইয়র্ক, টরেন্টো, সিডনির মতো দূরবর্তী গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারব। এ ব্যাপারে আমরা আগ্রহী। এ লক্ষ্যে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষকে ক্যাটাগরি-১ এ উন্নতকরণের কাজ এগিয়ে চলছে।’
Advertisement
এ সময় তিনি সংশ্লিষ্ট সবাইকে ‘নিরাপদ উড্ডয়নের তাগাদা’ দিয়ে বলেন, ‘বিমান ভ্রমণ নিরাপদ, আরামদায়ক ও সহজতর করতে আমরা বদ্ধপরিকর। এজন্য আমরা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তৃতীয় টার্মিনাল স্থাপন করছি। এর কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। এটা বাস্তবায়িত হলে এখন আমরা যে পরিমাণ যাত্রীসেবা দিতে পারি, আগামীতে এর আড়াইগুণ বেশি অর্থাৎ বছরে প্রায় ১২ মিলিয়নের বেশি যাত্রীসেবা দেয়া সম্ভব হবে।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০০৭ সালের ২৩ জুলাই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিমান বাংলাদেশকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করা হয়। বিমান বাংলাদেশের সেবা গ্রহণের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ হলো হজযাত্রী ও বিদেশগামী যাত্রী। ব্যক্তিমালিকানাধীন বা বেসরকারি তিনটা প্রতিষ্ঠান চালু থাকায় প্রতিযোগিতা বেড়ে যায়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো উন্নত ও বিশ্বস্ত সেবা দিয়ে আট শতাংশ হারে ক্রমবর্ধমান বাংলাদেশি বাজার সুবিধা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়। এ বাজার সুবিধার উন্নতি মূলত প্রবাসী বাঙালি ও পর্যটকদের কারণে।
১৯৭২ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স একক আধিপত্য বজায় রাখে। ১৯৯৬ সালের আগ পর্যন্ত এর ব্যাপ্তিও ঘটে। কিন্তু দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনার কারণে ১৯৯৬ এর পর লোকসান হতে থাকে।
এক সময় বাংলাদেশ বিমান সর্বোচ্চ ২৯টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করতো। এর মধ্যে ছিল ঢাকা টু নিউইয়র্ক এবং ঢাকা টু টোকিও ফ্লাইট। ২০০৭ সালে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা কমিয়ে আনা হয়। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সবচেয়ে বড় সাফল্য বোয়িংয়ের অত্যাধুনিক ১০টি উড়োজাহাজ বিমানবহরে যুক্ত হওয়া। যদিও সুষ্ঠু বাণিজ্যিক পরিকল্পনা না থাকায় বড় কোনো রুটে চলতে পারছে না দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে সক্ষম অত্যাধুনিক ড্রিমলাইনারগুলো।
অন্যদিকে, ১৯৯৫ সালে বেসরকারি খাতের তিনটি সংস্থা উড়োজাহাজ পরিচালনার অনুমতি পায়। তারা হলো- ‘অ্যারো বেঙ্গল, এয়ার পারাবত ও জিএমজি। অ্যারো বেঙ্গল ও এয়ার পারাবত বেশিদিন ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালাতে ব্যর্থ হলেও জিএমজি দীর্ঘ প্রায় ১৪ বছর মোটামুটি সফলভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে। ২০১২ সালে জিএমজিও তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ ও বেস্ট এয়ার ২০০৭ সালে এবং পরবর্তীতে রয়েল বেঙ্গল এয়ারওয়েজ বাংলাদেশের আকাশে তাদের ডানা মেলে। রয়েল বেঙ্গল ও বেস্ট এয়ার তাদের কার্যক্রম শুরুর কিছুদিনের মধ্যেই হঠাৎ বন্ধ করে দেয়। ইউনাইটেড অনেকটা সফলতার সঙ্গে প্রায় আট বছর দেশের সবকটি ও বিদেশের প্রায় ৭-৮টি গন্তব্যে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম হয়। পরবর্তীতে ক্রমবর্ধমান দেনার দায় এবং চলতি মূলধন সংকটের কারণে ২০১৬ সালে তাদের ফ্লাইট কার্যক্রমও বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৪ সালের ১৭ জুলাই দুটি ড্যাশ ৮- কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ দিয়ে ইউএস-বাংলা ঢাকা থেকে যশোরে উদ্বোধনী ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। নতুন যুক্ত হওয়া এটিআর ৭২-৬০০ সহ বর্তমানে ইউএস-বাংলার বিমানবহরে মোট ১১টি উড়োজাহাজ রয়েছে। এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, তিনটি ড্যাশ ৮- কিউ ৪০০ ও চারটি এটিআর ৭২- ৬০০।
বেসরকারি বিমান সংস্থার মালিক কর্তৃপক্ষের দাবি, বেসরকারি সংস্থাগুলোকে প্রয়োজনীয় সরকারি সুযোগ-সুবিধা দেয়া গেলে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে এ খাত আরও বেশি অবদান রাখতে পারবে।
দেশের স্বনামধন্য হাবিব গ্রুপের মালিকানাধীন বেসরকারি এয়ারলাইন্স রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। প্রতিষ্ঠাকাল ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর। রিজেন্ট এয়ারওয়েজের বহরে মোট উড়োজাহাজের সংখ্যা চারটি। এর সবগুলোই বোয়িং-৭৩৭। বর্তমানে এয়ারলাইন্সটি ছয়টি গন্তব্যে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।
রিজেন্ট এয়ারওয়েজের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা আশিষ রায় চৌধুরী জাগো নিউজকে আরও বলেন, ‘দেশের এভিয়েশন সেক্টর সম্প্রসারিত হচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বিশ্বের অন্যসব এয়ারলাইন্সের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশের এয়ারলাইন্সগুলো সেবার মান ঠিক রাখতে পারছে না। কারণ আর্থিকভাবে সেভাবে লাভের মুখ না দেখা।’
এ বিষয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বাংলাদেশের এভিয়েশন খাতকে যথাযথ মানে উন্নীত করতে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা জরুরি। বাজারে টিকে থাকতে এটার কোনো বিকল্প নাই।’
আরএম/এমএআর/জেআইএম