ফজলে নূর তাপস একজন সংসদ সদস্য। দেশ সম্পর্কে কথা বলার অধিকার রয়েছে তার। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মন্তব্য করে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছেন, ব্যর্থতার দায়ে তার চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যাওয়া উচিত। বেসিক ব্যাংকের মাধ্যমে ফিন্যান্সিয়াল সেক্টরে এবং ব্যাংকিং সেক্টরে যে দুর্নীতি হয়েছে তার মূলে ছিলেন ব্যাংকটির তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় উঠে আসে। পরবর্তীতে তদন্ত হলে শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া যায়। যে কারণে সরকার তাকে অপসারণ করে।
Advertisement
বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে অন্তত ৫৬ মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তাপস বলেন, ‘বেসিক ব্যাংকের মামলাগুলো শুধুমাত্র কর্মকর্তা এবং ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে। একটি মামলাতেও আবদুল হাই বাচ্চুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু করেছেন, সেই অভিযানের ধারাবাহিকতায় দুদককে এ বিষয়ে জবাবদিহিতার আওতায় আনা দরকার।’
অ্যান্টি করাপশন ডিপার্টমেন্টকে বিলুপ্ত করে দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন করা হয়েছিল দেশকে যে দুর্নীতি গ্রাস করে ফেলেছে তা থেকে উদ্ধার করার জন্য। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে তারা দুর্নীতি থেকে দেশকে উদ্ধার করা দূরে থাক নিজেরাই দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছে। একজন পরিচালককে সরানো হয়েছে পুলিশ অফিসারের তদন্তাধীন মামলায় ৪০ লাখ টাকা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে। পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানের অবৈধ সম্পদের তদন্ত করতে গিয়ে সেই পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন দুদকের পরিচালক খন্দকার এনামুল বাসির। পুলিশ অফিসার ওই পরিচালকের কথোপকথন পর্যন্ত টেপ করে রেখেছিল।
এক এগারোর পর থেকে দুদক খুব তৎপর। বহু বড় বড় দুর্নীতির মামলার তদন্ত করেছে কিন্তু তদন্তে কারো কোনো কিছুই হচ্ছেনা। তদন্তের হস্ত-পদ-স্কন্ধ-মাথা কিছুই নেই। সুতরাং দুর্নীতি দমন সংস্থাটির যদি এই অবস্থা হয় তবে ফজলে নূর তাপস জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাদের পদত্যাগ দাবি করতেই পারেন। কারণ তারা যে একটা অকার্যকর সংস্থা, রুই-কাতলা ফেলে চুনোপুটি ধরায় ওস্তাদ, গত কয়েক বছরের কর্মকাণ্ডে তা প্রমাণিত হয়েছে। মাঝখানে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে দুদুকের চুনোপুটি থেকে বড় কর্তারা। দুদকের চাকরি এখন সবচেয়ে আকর্ষনীয় হয়েছে।
Advertisement
এতদিন দেখেছি বড় বড় মামলার আসামিকে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। আমরা সাধারন মানুষ মনে করেছি কাজের কাজ কিছু হচ্ছে। বড় মন্ত্রী, নেতা, আমলা, ব্যবসায়ীকে দুদুক জিজ্ঞাসাবাদে ডাকছে। কিন্তু গত ১৫ অক্টোবর ২০১৯ মিডিয়ায় দেখলাম, শেখ ফজলে নূর তাপস দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের পদত্যাগ কেন চাইছেন তা বুঝতে পারছেন না দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত। তাপসের বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে দুদকের সচিব যেসব কথাবার্তা বলেছেন তাতে জাতি খুবই হতাশ হয়েছে।
খবরে দেখলাম, বেসিক ব্যাংকের বিপর্যয়ের যখন শুরু তখন ওই ব্যাংকের চেয়ারম্যান ছিলেন শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু। ২০০৯ সালে শেখ আবদুল হাই বাচ্চু চেয়ারম্যান হওয়ার পর ২০১৩ সালের মার্চ পর্যন্ত (চার বছর তিন মাসে) ব্যাংকটি ৬ হাজার ৬৭৩ কোটি টাকা ঋণ দেয়, যার প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকাই নিয়ম ভেঙে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুসন্ধানে ঋণ বিতরণে অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ার পর প্রথমে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী ফখরুল ইসলামকে অপসারণ করা হয়।
২০১৪ সালের ২৯ মে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দিতে অর্থ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এরপর ৪ জুলাই অর্থমন্ত্রীর বাসায় গিয়ে পদত্যাগপত্র দেন শেখ আবদুল হাই বাচ্চু। পরে বেসিক ব্যাংকের অনিয়ম নিয়ে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১৫ সালে সর্বমোট ৫৬টি মামলা করে দুদক। কিন্তু পরিচালনা পর্ষদের কাউকেই মামলাগুলোতে অভিযুক্ত করা হয়নি।
আসামিদের মধ্যে বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা ২৬ জন। বাকি ১৩০ জন আসামি ঋণ নেওয়া ৫৪টি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ও সার্ভে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। ব্যাংকটির তৎকালীন পর্ষদের ১৩ জন সদস্যের মধ্যে সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই দায় সেরেছে দুদক।
Advertisement
এই টাকা ব্যাংক থেকে লুট হয়নি। ঋণের বরাবরে এ টাকা ব্যাংক থেকে বের হয়েছে। বস্তায় বস্তায় এ টাকা দেওয়া হতো। ব্যাংকের চেয়ারম্যান, পরিচালনা পর্ষদ ঋণের বরাবরে টাকা লুটের এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। অথচ দুদকের সচিব দেলোয়ার বখত বলেছেন, সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুর সম্পৃক্ততা প্রমাণ করা নাকি যাচ্ছে না। প্রমাণ পেলে নাকি চার্জশিট দাখিল করার নির্দেশ দেবেন। প্রমাণ পাওয়ার জন্য দুদকের উচিত বাচ্চুকে র্যাবের হাতে তুলে দেওয়া। ‘ডিম থ্যারাপি’ দিলে নিশ্চয়ই প্রমাণ পাওয়া যাবে।
অথচ দেশের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ব্যাংক ক্ষতির সম্মুখীন হলে পরিচালনায় যারা থাকেন তারা দায়ী হতে বাধ্য। তিনি বলেছেন, সবার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি আবদুল হাইয়ের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন।
শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর নামের আগে শেখ পদবী রয়েছে। তাতে সাধারণ মানুষ মনে করে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চু শেখ পরিবারের কোনো আত্মীয় হবে। যে কারণে গ্রেফতার হচ্ছেন না। অথচ আমরা খবর নিয়ে জেনেছি- আব্দুল হাই বাচ্চু শেখ পরিবারের কোনো আত্মীয় নয়। শুধু তার শেখ পদবীর কারণে শেখ পরিবার কলংকিত হচ্ছে। শেখ তাপসের বিবৃতির পর আমরা নিশ্চিত হলাম যে শেখ পরিবারের কারণে নয়, দুদক তার অদক্ষতার কারণে শেখ আব্দুল হাই বাচ্চুসহ সংশ্লিষ্ট লোকদের গ্রেফতার করছে না।
দুর্নীতি দমন কমিশন বাংলাদেশের আজকের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বেশি তৎপর সংস্থা হওয়ার কথা। অথচ সেই অনুপাতে তারা কিছুই করছে না। আবার দুদক এমন একটা সংস্থা যার কর্মকর্তা হলে ক্যাসিনোর চেয়েও বেশি টাকা রোজগার করা যায়। তাদেরকে যদি সেই রোগে পেয়ে বসে তাহলে তো জাতির সর্বনাশ হবে। দুদকের সচিব বলেছেন, অর্থের উৎস, অর্থ কোন জায়গায় ব্যবহার হয়েছে, কোথায় সম্পদ হিসেবে কনভার্ট হয়েছে- সেগুলো নিষ্পত্তি শেষে তাকে আইনের আওতায় আনলে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে। তাকে চার্জশিট ভুক্ত করা হবে।
দুদক সচিব যে কথা বলেছেন তা সত্য। চার্জশিট দিতে সুনির্দিষ্ট, সুস্পষ্ট অভিযোগ থাকতে হবে। কিন্তু তথ্য-উপাত্ত পেতে হলে তো শেখ আবদুল হাই বাচ্চু সহ পরিচালনা পরিষদের সদস্যদেরকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে আনতে হবে। তারপর হয়তো তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাবে। অন্যথায় কোনো কিছুই পাওয়া যাবেনা। দুদককে নিরীহ গোবেচারা হলে চলবে না।
সচিব বলেছেন সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কোথায় ব্যয় করা হয়েছে সেটি দুদক কর্মকর্তারা বের করতে পারছেন না। এজন্য বলছি যে রিমান্ডে নিয়ে থ্যারাপি দিলে সব বের হয়ে আসবে। বেসিক ব্যাংকের সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হওয়ার পর ব্যাংকটি বেঁচে থাকার কথা নয়। লিকুইডেশন-এ যাওয়ার কথা। শুধু রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে টাকা সরবরাহ করে ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। দুদকের উচিত রাষ্ট্রীয় টাকা তুলে আনার সর্বাত্মক চেষ্টা করা। তাপসের সুরে আমরাও বলবো, অপারগতায় তাদের চলে যাওয়া উচিত।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।anisalamgir@gmail.com
এইচআর/জেআইএম