অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। ১৯৫৪ সালে কুষ্টিয়া শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি এবং জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান পদেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৮ সালে রাশিয়ার মস্কো ইনস্টিটিউট অব ন্যাশনাল ইকোনমি থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করেন। একই প্রতিষ্ঠান থেকে উন্নয়নের রাজনৈতিক-অর্থনীতি বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। তার ৬০০টির বেশি গবেষণাকর্ম এবং ২৪টি গবেষণাগ্রন্থ রয়েছে।
Advertisement
স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে জাগো নিউজের মুখোমুখি হন বাংলাদেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রসঙ্গ নিয়ে। দীর্ঘ আলোচনায় উন্নয়ন ও বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে আলোকপাত করেন। বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একধরনের সমাজতন্ত্র চেয়েছিলেন। তা না হলে কেন তিনি শোষিতের গণতন্ত্রের কথা বললেন?’ মতামত প্রকাশ করেন বর্তমান রাজনীতি, অর্থনীতি প্রসঙ্গেও। পাঁচ পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে দ্বিতীয়টি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ : আগের পর্বে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শন এবং ’৭৫ পরবর্তী সামরিক সরকারের শাসন বিশ্লেষণ করেছেন। ১৯৯১ সালের পর কী দেখলেন?
আবুল বারকাত : ১৯৯১ সালের পর রাজনীতির ধারা বদলে যায়। কিন্তু উল্টোপথেই থেকে যায় বাংলাদেশ। বলতে হবে, টানা ২১ বছর বাংলাদেশ উল্টো পথে চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরুদ্ধ ২১ বছর উল্টো পথে চলা বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে কিছু কিছু জায়গায় হাত দিতে শুরু করেন। ২০০১ সালে এসে ফের হোঁচট খেতে হলো। পরবর্তী আট বছর আবারও এলোমেলো হয়ে গেল। তার মানে, ১৯৭৫ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মোট ৩৪ বছরে আমাদের উল্টো পথেই হাঁটতে হয়েছে। আমরা সত্যিকার অর্থে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণের সময়ই পাইনি।
Advertisement
আপনি যদি উন্নয়নের তিনটি সময় ধরে বিশ্লেষণ করতে চান, তাহলে ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল, ১৯৭৬-২০০৮ এবং ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত আমলে নিতে পারেন। ১৯৭৫ এর আগে যে ভিত তৈরি করা হয়েছে, তা বহুবার ভাঙা হয়েছে। বলতে পারেন, বিগত ৪৮ বছরের মধ্যে ৩৪ বছরই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরুদ্ধ ভঙুরতার ইতিহাস। এ ভাঙা ভিতের ওপর দাঁড়িয়েই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত ১০ বছরের উন্নয়ন।
জাগো নিউজ : এ উন্নয়ন নিয়ে আপনি কি আশাবাদী?
আবুল বারকাত : বর্তমান উন্নয়ন আশাব্যঞ্জক বলা যেতে পারে। ছাত্রলীগ, যুবলীগ কী করছে সেটা নিয়ে আপনি হাজার প্রশ্ন তুলতে পারেন। সে আলোচনাও অসঙ্গত নয়। জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে ধারাবাহিকতা রয়েছে, তা অবশ্যই ইতিবাচক সূচক। সত্তর দশকের পুরো সময় ধরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩.৭ শতাংশ। আর গত ১০ বছরে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ৬.৬ শতাংশ। এখন প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ। এটি অনেক উচ্চ হার। এমন প্রবৃদ্ধি যেকোনো দেশের অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় এনে দেয়। আমার মতে, এ প্রবৃদ্ধির হার ১৬ শতাংশে নেয়া সম্ভব। আমার হিসাবে প্রবৃদ্ধি আরও ৪ শতাংশ বাড়তে পারে যদি মেগা প্রকল্পগুলো ঠিকঠাক শেষ হয়। তার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে আরও ৪ শতাংশ যদি দুর্নীতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় নামিয়ে আনা যায়। তবে এসবের পাশাপাশি দুটা কাজ অবশ্যই করতে হবে। প্রথমত, শিল্পায়ন এবং দ্বিতীয়ত, বৈষম্য হ্রাস। তা হলেই দেখবেন, দেশকে আমরা যেখানে দেখতে চাই সেখানেই পৌঁছে যাবে। নেতৃত্বের বিষয়টি অবশ্যই এক্ষেত্রে প্রধান, আর তার সঙ্গে যুক্ত হতে হবে উন্নয়নের এ প্রক্রিয়ায় জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। প্রয়োজন দেশের মাটি থেকে উত্থিত উন্নয়ন দর্শন যাকে আমি বলি বঙ্গবন্ধুর উন্নয়ন দর্শন এবং তার সঙ্গে সুযোগ্য নেতৃত্ব।
জাগো নিউজ : এ প্রবৃদ্ধির বিপরীতে লুটপাটের আলোচনাও আসছে…
Advertisement
আবুল বারকাত : হ্যাঁ, আলোচনা হচ্ছে। আরও আলোচনা হওয়া দরকার। হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি না হলে প্রবৃদ্ধি আরও বাড়ত। দুর্নীতি দূর করতে পারলে শুধু যে প্রবৃদ্ধি আরও ৪ শতাংশ বাড়ত তা-ই নয়, একই সঙ্গে সমাজে নীতি-নৈতিকতার ভিতটাও শক্তিশালী হতো। এসব সম্ভাবনা নাকচ করার কোনো কারণ নেই।
দুর্নীতির প্রসঙ্গ অবশ্যই আলোচনার বিষয়। কিন্তু আমি আগে উন্নয়নের ইতিবাচক বিষয়টি আলোকপাত করতে চাইছি। উন্নয়নের আলোচনায় প্রবৃদ্ধির পর গুরুত্ব দিতে হয় জাতীয় মাথাপিছু আয়। ২০০৭-০৮ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৬৮৬ ডলার। এখন তা ১৯০৯ ডলার।
প্রশ্ন তুলেছেন, বৈষম্য নিয়ে। হ্যাঁ, উপরতলার মানুষের আয় বহুগুণ বেড়েছে। সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। এ সত্য অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে টেকসই উন্নয়নের জন্য বৈষম্য কমিয়ে আনতে বিশেষ তাগিদ দেয়াও হয়েছে। কারণ আয়বৈষম্য, ধনবৈষম্য- এসব না কমাতে পারলে জনকল্যাণ নিশ্চিত হবে না, আর তা না হলে সে উন্নয়নের ফল হতে পারে বিপজ্জনক।
বলা হয়, চার কারণে পৃথিবী ধ্বংস হতে পারে। প্রথমত, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে। দ্বিতীয়ত, বৈষম্যের কারণে। তৃতীয়ত, জলবায়ুর পরিবর্তন-সংশ্লিষ্ট কারণে। চতুর্থ কারণ হচ্ছে, বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসবাদ।
আলোচনা হচ্ছিল মাথাপিছু আয় নিয়ে। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে যাচ্ছি- এটি জাতিসংঘের স্বীকৃতি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আমরা ‘দিন বদলের সনদ’ শিরোনামে মূল স্বপ্ন দেখিয়েছি। রূপকল্প ২০২১-এ বলা হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে বা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র। ১৯৭৫ সালের পর এমন কথা আর জোর দিয়ে বলা যায়নি। ২০০৮ সালের নির্বাচন তো সুষ্ঠু হয়েছে। জনগণ দিন বদলের সনদ এমনভাবে গ্রহণ করল যে, আওয়ামী লীগ অবিস্মরণীয় রায় পেল। দিন বদলের অপেক্ষায় ছিল মানুষ। বিতর্কও ছিল। বঙ্গবন্ধুও মানুষের দিন বদল চেয়েছিলেন।
জাগো নিউজ : বঙ্গবন্ধু সমাজতন্ত্রের দিকে যাচ্ছিলেন, বলছিলেন। এখানকার সরকার…
আবুল বারকাত : উদার গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলা হয়েছে। প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক সমাজ ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। সমাজতন্ত্র শব্দ নিয়ে তেমন আর বলা হয় না। সম্ভবত সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে সমাজতন্ত্রের এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হওয়ার কারণে। অবশ্য এর অর্থ এ নয় যে তত্ত্ব হিসেবে সমাজতন্ত্র ভুল।
আমরা বৈষম্য কমিয়ে আনার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে রূপকল্প ২০২১ ইশতেহার করেছিলাম। এজন্য আমরা বিভিন্ন নীতির কথাও বলছি। কীভাবে ধনীর ওপর আরও কর বাড়ানো যায় এবং গরিবের আয় বাড়ানো যায়, কীভাবে বৈষম্য কমানো যায়- তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা হয় আমাদের পক্ষ থেকে।
আমি যা অর্জন করতে চাই এবং সেটা কোন পথে করব, তা আমাকেই নির্ধারণ করতে হবে। পদ্মা সেতু দরকার। বিশ্বব্যাংক মুখ ফিরিয়ে নিল। কিন্তু আমাকে করতে হবে। হয়ে যাচ্ছে কিন্তু। বেশির ভাগ অর্থনীতিবিদ বলেননি, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু হতে পারে। ২০১২ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আয়োজনে জাতীয় সেমিনারে আমি বলেছি, নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু করা সম্ভব। কীভাবে অর্থের জোগান আসবে, তারও নানা তথ্য ও বিশ্লেষণ দিয়েছিলাম। অনেকেই আমাকে ভুল প্রমাণের চেষ্টা করেছেন। আমার ‘নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু’ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছিলেন অনেকে। এখন তারাই ভুল প্রমাণিত।
পদ্মা সেতুর ঘটনায় আমি বলেছিলাম, যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাঁধের প্রধান প্রকৌশলী একজন বাংলাদেশি। তিনি বুয়েট থেকে পাস করে গেছেন। বিশ্বব্যাংক এমন কী হয়েছে, তারা অর্থ না দিলে আমরা কাজই করতে পারব না! আমার প্রস্তাবে আমি স্পষ্ট বলেছিলাম, ‘বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতুর ঋণচুক্তি বাতিল : জাতির জন্য আশীর্বাদ।’
জাগো নিউজ : বিশ্বব্যাংকের অবস্থান এখন কীভাবে দেখছেন?
আবুল বারকাত : বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির কথা বলতে পারেনি। তারা দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের কথা বলে পদ্মা সেতুর ঋণ দেবার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। তখন বাংলাদেশের নির্বাচন ঘনিয়ে আসছিল। তারা চায়নি এ সরকারকে। ‘দুর্নীতির ষড়যন্ত্র’ বলতে কোনো বিষয় আলোচনায় আসতে পারে না। বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ কিন্তু পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।
আমি তখন বলেছিলাম, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ১৯৭২-১৯৭৩ সালের জায়গায় নেই। ২০১২ সালের অর্থনীতি এমন এক জায়গায়, যদি আমরা সঠিকভাবে নিজেদের সম্পদ ব্যবহার করতে পারি, তাহলে এমন চারটি পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব। আমি দেখিয়েছিলাম, দেশের বিভিন্ন উৎস থেকে বছরে ৯৮ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করা সম্ভব। আর পদ্মা সেতু বানাতে সময় লাগবে পাঁচ বছর। আমার এ কথা কিন্তু অনেকেই পাগলের প্রলাপ বলে আখ্যা দিয়েছেন। তবে অর্থনীতি সমিতির অনেকেই আমার তথ্যে উজ্জীবিত হয়েছেন।
এখন অনেক অর্থনীতিবিদই পদ্মা সেতু নিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। অথচ তারাই একদিন বিরোধিতা করেছিলেন। ইতিহাসে তা-ই ঘটে। সত্যের সন্ধানে সত্যই বেরিয়ে আসে এবং তার ভিত্তিতে পরের প্রজন্ম এগিয়ে যায়। সেটা বহুদিন পরে হলেও।
জাগো নিউজ : পদ্মা সেতুর কথা উল্লেখ করে হয়তো বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতার কথা বলছেন। এ সক্ষমতার জন্য কোন বিষয়টিকে গুরুত্ব দেবেন?
আবুল বারকাত : বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তির জায়গাটা মূলত অভ্যন্তরীণ। যার মধ্যে আছে মানবসম্পদ, ভৌত অবকাঠামো সম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ। এ প্রসঙ্গে পরে আসব। এটিই বাংলাদেশের শক্তি এবং তা প্রবল। আলোচনা হচ্ছিল, এগিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ নিয়ে। প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়ের কথা ব্যাখ্যা করেছি। এর পরের সূচক দারিদ্র্য। ৭০ দশকে বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ৭১ শতাংশ। ২০১৫ সালের দিকে তা নেমে এসে দাঁড়িয়েছে ২৪ শতাংশে। এখন হয়তো আরও কমে এসেছে। হিসাবে কিছু গরমিল থাকলেও এ এগিয়ে যাওয়ার কথা তো আপনি অস্বীকার করতে পারেন না। তবে দারিদ্র্যের পরিমাপ আর সূচক কী হওয়া উচিত, সেসব নিয়ে বিস্তর আলাপ-আলোচনা তর্ক-বিতর্ক হতে পারে।
এগিয়ে যাওয়া এ বাংলাদেশের জন্য আমি প্রধানত কৃষককেই ক্রেডিট দিতে চাই। ১৯৭২ সালে শস্য উৎপাদন ছিল এক কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। সেটি এখন চার কোটি মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেছে। এ সময়ে উৎপাদন বেড়েছে চারগুণ। মানুষ কিন্তু চারগুণ বাড়েনি, জনসংখ্যা বেড়েছে দ্বিগুণের কিছু বেশি।
জাগো নিউজ : কিন্তু উৎপাদনের বণ্টন নিয়ে ঘোর আপত্তিও আছে?
আবুল বারকাত : আমি উৎপাদনের ব্যাখ্যা দিচ্ছি। বণ্টন নিয়ে প্রশ্ন গুরুতর। যদি উৎপাদনের বণ্টন সুষ্ঠু হতো তাহলে দারিদ্র্য অনেক আগেই কমে যেত। অন্তত এত বৈষম্য থাকত না। সেক্ষেত্রে জনকল্যাণ যে পর্যায়ে উন্নতি হত যাকে আপনি সমাজতন্ত্রের সমার্থক বলতে পারতেন।
গত বছর আলুর উৎপাদন হয়েছে ৭০ লাখ মেট্রিক টন। দেশে আলুর চাহিদা রয়েছে ১৬ লাখ মেট্রিক টন। পৃথিবীর অনেক দেশেই আলু প্রধান খাবার। আমরা কিন্তু আলু রফতানি করে ব্যাপক আয় করতে পারি। সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে চতুর্থ। এটিকে সবুজ বিপ্লব বলা হয় এবং এ বিপ্লবের পেছনে রাষ্ট্র গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
বিএডিসি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অথচ বিএডিসির কার্যকারিতা নেই বলে একসময় তুলে দেয়ার চেষ্টা করা হলো। যারা এসব প্রতিষ্ঠান তুলে দেয়ার পক্ষে তারা মূলত সবকিছুই বেসরকারিকরণের পক্ষে। পারলে তারা সেনাবাহিনীকেও বেসরকারি করে দেয়ার পক্ষে। আপনি কী প্রাথমিক শিক্ষা ও প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবাকে বাজারের হাতে ছেড়ে দেবেন? বেসরকারিকরণ সর্ব রোগের ওষুধ হতে পারে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে ‘বাজার বিকৃতি’ বলে একটি কথা আছে। এখানে ব্যর্থ হলে রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে হয়। রাষ্ট্র গুদামে খাবার রাখে বাজার বিকৃতি থেকে মানুষকে রক্ষার স্বার্থে।
মাছের উৎপাদনেও বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয়। অথচ একসময় মিঠা পানির মাছ প্রায় ফুরিয়ে যাচ্ছিল। গত দুই দশকে কৃষক মাছ চাষে বিপ্লব ঘটিয়েছে। উন্নতি হয়েছে হাঁস-মুরগি-ডিম উৎপাদনে। বলতে পারেন, এ হলো শ্বেত-বিপ্লব। এখন আমরা বঙ্গোপসাগর-কেন্দ্রিক নীল-বিপ্লবের কথা ভাবতে শুরু করেছি।
জাগো নিউজ : এ অগ্রযাত্রায় আর কোন সূচক সামনে আনবেন?
আবুল বারকাত : রফতানি আয় বাংলাদেশের অর্থনীতি-কে বেগবান করেছে। রফতানি আয় এখন ৪২ বিলিয়ন ডলার। তবে এখানে দুর্বল দিক হচ্ছে, আমরা কেবল বস্ত্র ও তৈরি পোশাক রফতানি করে এ আয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি। কোনো কারণে এ খাতে সংকট দেখা দিলে অর্থনীতির বড় ক্ষতি হবে। বিকল্প গ্রহণ করতে পারিনি। আমাদের দরকার রফতানি খাত বহুধাকরণ, বহুমুখীকরণ।
প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স বাংলাদেশের ভাগ্য খুলে দিয়েছে। বলা হচ্ছে, ১৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসছে বছরে। আমি তো মনে করি, ২৫ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেছে। কারণ ১০ বিলিয়ন ডলার হয়ত বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের বাইরে আসে। তবে একে কালো টাকা বলা যাবে না।
রেমিট্যান্সের বেশির ভাগ টাকাই গ্রামে যায়। ফলে গ্রামের উন্নয়নে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ-রেমিট্যান্স বড় ভূমিকা রাখছে বলে আমি মনে করি।
স্বাস্থ্য নিরাপত্তায় বাংলাদেশ বহু এগিয়েছে। এর প্রধানতম প্রমাণ হচ্ছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। মজার কথা হচ্ছে, নারীদের গড় আয়ু এখন পুরুষদের চেয়ে বেশি। আর গড় আয়ুষ্কাল এখন ৭২ বছর।
যদিও স্বাস্থ্য খাতের বেসরকারিকরণটা আমার কাছে মহাবিপদের মতো ঠেকছে। এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। প্রতিটি জেলা হাসপাতালে ক্যানসার, কিডনির রোগ, হৃদরোগের চিকিৎসা হবে না কেন? এ জায়গায় সরকারকে ভাবতে হবে। সহজে হবে, আমি তা মনে করি না। কারণ স্বাস্থ্য খাতে বেসরকারিকরণের বিস্তার এখন ব্যাপক এবং বলতে পারেন নিয়ন্ত্রণহীন। বঙ্গবন্ধু সমবায়ের কথা যখন বলেছিলেন, তখন নিজ দলের লোকরাও বিরোধিতা করেছিলেন। বিরোধিতা এখনও হবে। তবুও লাগাম টানতেই হবে। সমন্বয় দরকার। ডেঙ্গুর সময় কিন্তু কিছুটা সমন্বয় আমরা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু ৩০ হাজার টাকার ওপেন হার্ট সার্জারির জন্য কোনো বেসরকারি ক্লিনিক যদি চার লাখ টাকা আদায় করে, তাহলে অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এটি করলে সেবার মান নিয়ে প্রতিযোগিতাও বাড়বে। আর মানুষকে চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে গিয়ে নিঃস্ব হতে হবে না।
শিক্ষাতেও নারীর অগ্রগতি ব্যাপক। বিশেষ করে প্রাথমিক স্তরে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেশি। উপবৃত্তি দেয়ার সুবাদে মাধ্যমিক স্তরে মেয়েদের কম বয়সে বিয়ের হার কমে গেছে। উচ্চশিক্ষায় নারী ও পুরুষের ব্যবধানটা এখনও আছে। সেটা কমানো সম্ভব।
সামাজিক উন্নয়নে আশার কথা হলো নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ। যদিও কিছু কিছু আইনের কারণে নারীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। যেমন- মুসলমানদের উত্তরাধিকার আইন। হিন্দুদের বেলায় তো উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পদে নারীর মালিকানাই নেই। এ বিষয়গুলোতে হাত দিতে হবে। আইনমন্ত্রী বলেছেন, আস্তে-ধীরে হবে। নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে ভাবছে সরকার, এটি আশার সৃষ্টি করেছে। যদিও পিতৃতান্ত্রিক সমাজে কঠিন হবে সম্পদে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এটি করতে না পারলে সমতাভিত্তিক সমাজ সৃষ্টি হবে না।
সামাজিক নিরাপত্তায় সরকার বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। বহু প্রকল্পের মাধ্যমে এ সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। যদিও এ সংক্রান্ত বরাদ্দ অনেক দেশের চাইতে অনেক কম। জাপানে সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ হয় বাজেটের ২২ শতাংশ। ভারতেও আমাদের চেয়ে বেশি। আমরা ২ শতাংশেও যেতে পারিনি। সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ অবশ্যই বাড়াতে হবে।
অবকাঠামো উন্নয়নকেও আপনি যেকোনো সময় থেকে আলাদা করে মূল্যায়ন করতে পারেন। গ্রামের রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে শহরের ফ্লাইওভার, বহু লেনের সড়ক, পদ্মা সেতু, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মতো বিষয়গুলো আপনার দৃষ্টি কাড়বেই।
এএসএস/এএইচ/এমএআর/জেআইএম