মতামত

মেধাবী অপরাধী!

বুয়েটে নৃশংসভাবে খুন হওয়া আবরার ফাহাদ মেধাবী ছিল। যারা খুন করেছে তারাও মেধাবী প্রজন্ম। কারণ বাংলাদেশের যে পড়ালেখার পদ্ধতি, তাতে একজন ছাত্র মেধাবী না হলে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করে না। প্রশ্ন উঠেছে মেধাবীরা এমন করে খুনি হয়ে উঠল কেন?

Advertisement

জানতে ইচ্ছা করে- মেধাবীরা অপরাধ করে না, খুন করে না, যতসব অপরাধ অমেধাবীরাই করে, এমন একটা সাধারণ ভাব না কেন আমাদের মাঝে জেগে উঠল? অপরাধ করতে, খুন করতে ঘুষ খেতে, টাকা, সম্পত্তি আত্মসাৎসহ যাবতীয় অপরাধ আসলে মেধারই কাজ।

ইংরেজি শব্দ ‘ট্যালেন্ট’-এর অনুবাদ যদি মেধাবী হয়, তাহলে আমরা আসলে কাদের মেধাবী বলব? এই ‘ট্যালেন্ট’ গুণগত এমন এক উৎকর্ষ, যা কি-না অনেকটা জন্মগত। বই পড়ে আর নম্বরের মাপকাঠিতে যে মেধা বিচার করা হয়, তার সাথে মেধার আসলে সেই অর্থে কোন যোগ নেই। ছাত্রজীবনে বহু বন্ধুকে দেখেছি যারা অনেক বিষযে খুবই পারদর্শী ছিল, কিন্তু তাদের পরীক্ষার ফল কখনও ভালো হয়নি।

এক মেধাবী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে, আরও ১৯ মেধাবীর জীবনও আসলে এক প্রকার সমাপ্তই হয়েছে। খুনের দায়ে আটক হয়েছে, ছাত্রত্ব চিরতরে যাওয়ার পথে, বিচারিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়ে যে ধরনের সাজা হবে, এতে করে এদের আর স্বাভাবিক জীবনে ফেরা হবে না। এদের পরিবারগুলোও বহু বছর ধরে একটা ট্রমার ভেতর দিয়ে যাবে, যেমন করে আবরারের পরিবারও যাবে।

Advertisement

অনেকেই বলবার চেষ্টা করেছেন, খুনের দায়ে গ্রেফতার হওয়া ছাত্রদের অভিভাবকরাও বলছেন, তাদের সন্তানরা সব ভালো ছিল, শান্ত স্বভাবের ছিল, বুয়েটে এসে ছাত্র রাজনীতি করতে গিয়ে তারা এমন ভয়ংকর অপরাধী হয়ে উঠেছে, যারা ঠান্ডা মাথায় ছয় ঘন্টা ধরে পিটিয়ে কাউকে খুন করেও স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে।

কিন্তু বিষয়টি কি ঠিক এমন? ছাত্র রাজনীতিই তাদের অপরাধী করেছে? নাকি সমাজ বা পরিবার থেকেই মানুষ অপরাধের উপাদান সংগ্রহ করে? সমাজের বৃহত্তর পরিসরে, এলাকা এলাকায়, পাড়ায়, পাড়ায়, জেলায়, জেলায় আমাদের যে দখল সংস্কৃতি, আধিপত্যবাদের মহড়াসহ সংঘাতের যেসব খবর পাই ক্যাম্পাসের সংঘাতের চরিত্র আসলে তারই মতো।

আজ সারাদেশে রাজনীতি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার যে চরিত্র, ক্যাম্পাস পরিস্থিতি তার থেকে আলাদা নয়। পরিবার থেকে, তার বেড়ে উঠার পরিবেশ থেকে, সমাজ থেকে একটি ছেলে বা মেয়ে যত বড় হয়, ততই সে শিখতে থাকে ক্ষমতার রাশটি যার হাতে থাকবে, তাকেই সবাই সমঝে চলবে। আর এই কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো রণক্ষেত্রে পরিণত হয়, সেখানে একটা ক্ষমতা কেন্দ্রিক নির্যাতক শ্রেণি গড়ে উঠে।

সমাজে টাকা উড়ছে। আমরা দেখলাম বড় কেউ নয়, ছোট নেতা, পাতি নেতা, পাড়ার নেতাদের বাড়িতে বাড়িতে যেন টাকশাল যেন আবিষ্কৃত হয়েছে। যুবলীগ নেতাতের ক্যাসিনো কান্ড হোক আর জি কে শামীমের ঠিকদারী সাম্রাজ্য, বা পুরোনো ঢাকা জুয়ারী ভাইদের যেসব কথা জনসমক্ষে এসেছে, ছাত্রদের অপরাধী বানানোর ক্ষেত্রে এই রাজনীতির ভুমিকা অনস্বীকার্য। ভালো ছেলেটি, শান্ত শিষ্ট মেধাবী ছেলেটি আগেই এসব দেখেছে, শিখেছে, ক্যাম্পাসে এসে সে কেবল বিকশিত হয়েছে।

Advertisement

সারাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির উৎসব হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে হবেনা কেন? আর মেধাবীরা সেই সুযোগ নিবেনা কেন? এখানেও সিট বাণিজ্য আছে, ক্যাম্পাসের আশপাশে কত কি বাণিজ্যিক স্থাপনা আছে যেখান থেকে চাঁদা আদায়ের সুযোগ আছে। এই যে নানা জায়গায় উড়ছে টাকা, সেই টাকায় অধিকার কায়েম করবার একমাত্র উপায় ক্যাম্পাসের রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। তাই আমরা যত কথাই বলি না কেন, আমাদের ক্যাম্পাসমূহ এই পথেই চলবে। বুয়েট আবরার হত্যার পর একটি সিদ্ধান্তে এসেছে, সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি বা শিক্ষক রাজনীতি থাকবে না। কারণ সমাজে যে রাজনৈতিক অপরাধের একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে তারই উপজাত সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই দখলের রাজনীতির দৌলতে ছাত্র-রাজনীতি মূলত অনৈতিকতা ও হিংসার পরিসর হয়ে উঠেছে। বুয়েট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় নয়, কিন্তু সেখানেও একটা সহিংসতার সংস্কৃতি আছে। হলে হলে টর্চার সেল, নিরীহ ছাত্রদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা, শিক্ষকদের সাথে অসদাচরণ করা— সার্বিকভাবে ক্ষমতার রাজনৈতিক চর্চায় ছাত্রসমাজের শৃঙ্খলাহীনতাকে ‘স্বাভাবিক’-এর স্বীকৃতি দিয়ে আসছি বহুদিন ধরে, আর এখন আফসোস করছি যে মেধাবীরা কেন খুনি হয়।

মেধার অপচয় ঘটবেই রাজনীতির মৌলিক পরিবর্তন না এলে। সেটা হবার নয়। আগেও বলেছি, আবারও বলছি শিক্ষাঙ্গন থেকে দেশের মুরুব্বী বাহিনীর রাজনীতিকে সরাতে না পারলে, মুরুব্বীরা নিজেরা সরে না গেলে, টাকার খেলাও কমবে না, ক্ষমতার মহড়াও থামবে না। বুয়েট একটি ঝুঁকি নিয়েছে, বাকিরা নিবেতো?

লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।

এইচআর/এমএস