মতামত

নৃশংসতার নেপথ্যে সিট ও ক্ষমতার মোহ

পুরান ঢাকার দর্জি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎকে প্রকাশ্য দিবালোকে চাপাতি দিয়ে যারা কুপিয়ে হত্যা করেছিল, তারা ছিল বয়সে তরুণ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এবার বুয়েটে আবরার ফাহাদ নামে যে শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে হত্যা করা হলো, তারাও বয়সে তরুণ এবং বুয়েটের ছাত্র। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কী করে এমন নৃশংস হতে পারে, কোন পরিস্থিতি বা কোন বিষয়গুলো তাদের এমন নৃশংস আচরণে উদ্বুদ্ধ করে এবং তার প্রক্রিয়াটাই বা কী?

Advertisement

ধরা যাক একজন শিক্ষার্থী মফস্বল শহরের কোনো একটি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে। ঢাকায় তার থাকার কোনো জায়গা নেই। মেসে থাকার মতো আর্থিক অবস্থাও নেই। ফলে আবাসিক হলই ভরসা। কিন্তু ফার্স্ট ইয়ারে বসে হলে সিট পাওয়া অসম্ভব। এর মূল কারণ আবাসিক হলে যে পরিমাণ সিট, চাহিদা তার কয়েক গুণ বেশি। ফলে তাকে তখন খুঁজতে হয় এলাকার পরিচিত কোনো বড় ভাই ক্যাম্পাসে আছেন কি না বা কোনো হলে পরিচিত কেউ থাকেন কি না।

এভাবে পরিচিতদের মাধ্যমে কোনো একটি হলের গণরুমে গিয়ে তাকে উঠতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণরুম মূলত ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের (যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে) অধীনে থাকা একধরনের উদ্বাস্তু শিবির। চার জন থাকার উপযোগী একটি রুমে থাকে ২৫ থেকে ৩০ জন। গাদাগাদি করে। মশা ও ছাড়পোকার কামড় খেয়ে। শান্তিতে একটানা ৬ ঘণ্টা ঘুমানোর কথা কল্পনাও করা যায় না। অস্বস্তি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকার ফলে নানারকম রোগব্যাধিতেও আক্রান্ত হতে হয় শিক্ষার্থীদের।

গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলে ৪টি, হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলে ১০টি, মাস্টার দা সূর্যসেন হলে ৬টি, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলে ৬টি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে ২টি, জগন্নাথ হলে ৩টি, পল্লিকবি জসীমউদদীন হলে ৫টি এবং শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে ৫টি গণরুম আছে।

Advertisement

কোনো কোনো হলে গণরুমও থাকে না। ফলে সেখানের সংকট আরও তীব্র। তখন সিট না পাওয়া শিক্ষার্থীদের থাকতে হয় হলের বারান্দা, ছাদ, মসজিদ, টিভি রুম এমনকি অনেকে সারা রাতা এখানে-ওখানে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাতে হয়। এর মধ্যে আছে কথিত গেস্টরুমে রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা তথা বড় ভাইদের নানারকম মানসিক ও শারীরিক পীড়ন। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠতে পড়তে এসে একজন মেধাবী তরুণকে যখন এ ধরনের অসম্মানজনক অভিজ্ঞতার ভেতরে দিয়ে যেতে হয়, তখন এটি তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও প্রভাব ফেলে।

প্রথম বর্ষ তো বটেই, অনেককে দ্বিতীয় তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত এই গণরুম নামক শরণার্থী শিবিরে থাকতে হয়। এরপর ভাগ্য ভালো হলে কিংবা প্রভাবশালী কারো সাথে খাতির থাকলে তার পক্ষে একটি সিট পাওয়া সম্ভব। কিন্তু সেই খাতির করা বা সিট পাওয়ার মতো নিজেকে বিশ্বস্ত এবং উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে গিয়েই মফস্বল শহরের দিনমজুর কিংবা ছোট চাকরি করা বাবার নিরীহ সন্তানদের এমন সব গ্রুপের সাথে এবং এমন সব ক্ষমতাবান লোকের সাথে গাটছড়া বাঁধতে হয়; যে, সেই বৃত্ত থেকে বের হওয়া সম্ভব হয় না।

বরং তাকে মিছিলে যেতে হয়, দৌড়ানি খেতে হয়, প্রতিপক্ষের লোকজনের ওপর হামলার প্রয়োজন হলে ক্রিকেটের স্ট্যাম্প এমনকি ঘটনা বড় হলে হাতে রামদা কিংবা চাপাতিও তুলে নিতে হয়। অথচ সেই ছেলে হয়তো উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত কাউকে একটা চড়-থাপ্পড়ও দেয়নি। সেই শান্তশিষ্ট, নিরীহ ছেলেটি এবার চাপাতি হাতে দৌড়ায় এবং তারই কোনো সহপাঠীর শরীরে আঘাত করে।

এখানে প্রধানত দুটি বিষয় থাকে; ১. হলে সিট পাওয়ার জন্য প্রভাবশালী, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে তাকে চলতে ফিরতে হয় এবং ২. এভাবে চলাফেরা করতে করতে একসময় তার ভেতরে ক্ষমতার মোহ তৈরি হয়। সে নেতা হবার স্বপ্ন দেখে এবং দলের পদ-পদবি পেলে যে রাতারাতি ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়, সেই উদাহরণগুলো তার চোখের সামনে ঘুরতে থাকে। ফলে সে এই ক্ষমতার কেন্দ্রে যাওয়া বা পদধারী নেতা হওয়ার জন্য নিজেকে আরও বেশি যোগ্য ও দক্ষ প্রমাণে উঠেপড়ে লাগে। আর সেই দক্ষ ও যোগ্য প্রমাণের জন্য তার অ্যাকাডেমিক ক্যারিয়ারের চেয়ে পেশিশক্তিই যে বেশি কার্যকর, এ কথাও সে এতদিনে জেনে গেছে।

Advertisement

এখানে আরও একটি বিষয় কাজ করে, তা হলো এই যে, হলে থাকতে গিয়ে গণরুম ও গেস্টরুমের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের মধ্যে একধরনের প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা গড়ে ওঠে। কথিত বড় ভাইদের দ্বারা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ায় তারাও তাদের জুনিয়রদের ওপর ওই একই আচরণের মধ্যে দিয়ে প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করে কিংবা নির্যাতিত ও অসম্মানিত হওয়ার কারণে তাদের মনোজগতে যে পরিবর্তন ঘটে, সেটি তাদের ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে সহায়তা করে।

জরিপ চালালে দেখা যাবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যারা অস্ত্রবাজি করে, তাদের অধিকাংশই হলের ছাত্র। যারা বাইরে মেসে কিংবা বাসায় থাকে, তাদের খুব সামান্য অংশই রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়। কারণ তারা যতটা সম্ভব নিজের মতো করে থাকতে পারে। অ্যাকাডেমিক কাজ শেষে তারা সাধারণত বাসায় ফিরে যায়। এদের মধ্যেও কিছু সার্কেল গড়ে ওঠে। ফলে সেই সার্কেলের এক বা একাধিক ছাত্র কোনো সংগঠনে যুক্ত থাকলে তার প্রভাবে অন্যদেরও সেইসব সংগঠনের যুক্ত হবার সম্ভাবনা তৈরি হয়। কিন্তু সেখানে থাকে সঙ্গ এবং রাজনৈতিক বলয়ে থাকার মোহ।

প্রশ্ন হলো, বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন ও ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দল যেমন জামায়াতে ইসলামি তাদের কর্মীদের অস্ত্র পরিচালনার প্রশিক্ষণ দেয়। লাঠি, রামদা, চাপাতি থেকে শুরু করে আগ্নেয়াস্ত্র। বোমা তৈরির প্রশিক্ষণও দেয়া হয়। কিন্তু বিশ্বজিৎ ও আবরারকে যারা নৃশংসভাবে খুন করলো, তাদের কেউই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন বা জামায়াতের মতো ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দলের কর্মী নয়। তারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতে গড়া সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মী। সুতরাং তারা কী করে এমন নৃশংস হলো এবং এরকম নিপুণ হাতে চাপাতি কিংবা ক্রিকেটের স্ট্যাম্প চালিয়ে মানুষ হত্যার প্রশিক্ষণ তারা কোথা থেকে পেলো?

এর জবাব খুব পরিষ্কার, তা হলো সব বড় রাজনৈতিক দলই মনে করে এবং বিশ্বাস করে যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলে সারা দেশের ছাত্র ও যুবসমাজ তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, যা প্রতিপক্ষ দমনে কিংবা প্রতিপক্ষের সঙ্গে মাঠের লড়াইয়ে তাকে বাড়তি সুবিধা দেবে। সুতরাং যখনই যে দল ক্ষমতায় থাকে তাদের ছাত্র সংগঠনই বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, বিশেষ করে আবাসিক হলে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ, সেখানেও হলের সিট বণ্টন ও অন্যান্য কর্মকাণ্ডে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের তৎপরতা চলে। শুধু তাই নয়, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ এমন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের ব্যাপারে শোনা যায়, তারা ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের নিজের লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করেন। তাছাড়া শিক্ষকরাও তাদের রাজনীতি টিকিয়ে রাখতে ছাত্রদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন।

এই যখন অবস্থা, তখন এটি স্বাভাবিক যে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো ক্যাডার তৈরি করবে এবং সেই ক্যাডাররা আবাসিক হলের সিট সংকটকে পুঁজি করে নিরীহ ছাত্রদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাদের দলে ভেড়াবে। এভাবে তারা নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে এবং মূল দলের অ্যাসাইনমেন্ট বাস্তবায়ন করে। কিন্তু আবাসিক হলে সিট সংকট না থাকলে এবং ছাত্ররা প্রথম বর্ষ থেকেই হলে সিট পেলে এবং শান্তি ও স্বস্তিতে পড়ালেখা করতে পারলে তারা কথিত বড় ভাই ও রাজনৈতিক নেতাদের পেছনে হাঁটতো না। তারা ক্ষমতার রাজনীতির ক্রীড়নকে পরিণত হত না।

সুতরাং বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির নামে দলীয় দাসত্ব এবং সন্ত্রাস বন্ধের যে দাবি উঠেছে, সেটি করতে গেলে প্রথমে আবাসিক হলের সিট সংকটের সমাধান করতে হবে। প্রতিটি হলেই বেশ কিছু রুম যেমন ক্ষমতাসীন দলের নেতারা দখল করে রাখেন, সেটি বন্ধ করতে হবে এবং গণরুম ও গেস্টরুমের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন হয়, সেগুলো বন্ধ করতে হবে। সিট বরাদ্দে সঠিক নীতিমালা থাকতে হবে এবং হলের সংখ্যা বাড়াতে হবে। এই সমস্যার সমাধান না করে ছাত্ররাজনীতি বা ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি বন্ধের দাবি মূল সমস্যাকে আড়াল করবে।

আরেকটি সমস্যা হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষমতা ও পয়সার মোহ ঢুকে গেছে। এই মোহ কাটানো না গেলে বুয়েট ইস্যুতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সাময়িক স্থিতিশীলতা বজায় থাকলেও নতুন ইস্যু আসার পরে ক্যাম্পাস তার পুরনো চেহারায়া ফিরে যাবে। এখন প্রশ্ন হলো, শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে এই ক্ষমতা ও পয়সার মোহ কীভাবে দূর হবে? এজন্য প্রযোজন নৈতিক শিক্ষা। কিন্তু সেই শিক্ষাটা কে দেবেন? এই দায়িত্ব যাদের সেই শিক্ষকরাই তো রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত এবং তারাও ভিসি, প্রক্টর ও প্রভোস্ট হন রাজনৈতিক বিবেচনায়।

সুতরাং শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ করাও জরুরি। কেননা, একজন শিক্ষক যখন নীল দল সাদা দলে বিভক্ত হয়ে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নেন, তখন তার নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হয় এবং তার পক্ষে শ্রেণিকক্ষে বস্তুনিষ্ঠভাবে পড়ানোর সম্ভব হয় না। সুতরাং ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির নামে দলীয় দাসত্ব বন্ধের পাশাপাশি শিক্ষকদের দাসত্ব বন্ধ করাও জরুরি। অর্থাৎ গাছের গোড়া ঠিক হলে ডালপালাও ঠিক হবে।

এর পাশাপাশি ক্যাম্পাসে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের ছাত্রত্ব বাতিল এবং তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় বিচারের মুখোমুখি করার মতো শাস্তিগুলো দৃশ্যমান করা গেলে অন্যদের মধ্যে ভয় ঢুকবে। ভয় ছাড়া মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখা কঠিন। যতই নীতি কথা বলা হোক না কেন, মানুষ যদি প্রচলিত আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে ভয় না করে, তাহলে তার অপরাধে জড়ানোর আশঙ্কা থেকেই যাবে।

লেখক : বার্তা সম্পাদক, চ্যানেল টোয়েন্টিফোর।

এইচআর/এমএস