কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়াবাড়িতে শেষ হলো বাউল-সাধুদের মিলনমেলা। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১২৯তম তিরোধান দিবস উপলক্ষে তিন দিনের আয়োজন হলেও বাউল ভক্তদের প্রথাগত নিয়মে পুণ্যসেবার মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার দুপুরে শেষ হয়েছে তিরোধান দিবসের আনুষ্ঠানিকতা। তবে মেলা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলেছে শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত।
Advertisement
দূর-দূরান্ত থেকে আসা বাউলরা নিজ নিজ আস্তানা ছেড়ে বিছানাপত্র গুছিয়ে ফিরে গেছেন অনেকেই। তবে যাওয়ার আগে আখড়াবাড়ির পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। গুরুভক্তি আর সিদ্ধ মন নিয়ে বিদায় নেয়ার সময় অনেক বাউল তাদের চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। গুরুকে বারবার প্রণাম ও নানা রকম ভক্তি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিদায় নেন শিষ্যরা।
বৃহস্পতিবার দুপুরে তারা মরা কালী গঙ্গায় গোসল সেরে মাছ-ভাত ও ত্রিব্যাঞ্জন দিয়ে (তিন ধরনের সবজি দিয়ে তৈরি তরকারি) পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। প্রায় ৫ হাজার বাউল ভক্ত দর্শনার্থীরা একসঙ্গে বসে ত্রিব্যাঞ্জন দিয়ে ‘আল্লা আলেক’ এর নাম করে পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। এই সেবার মধ্য দিয়ে শেষ হয় বাউলদের অষ্ট প্রহরের সাধু সংঘ।
মহির শাহ নামের এক লালন ভক্ত জানান, সাঁইয়ের জীবদ্দশায় শুধুমাত্র তার ভক্ত আর শিষ্যদের নিয়ে আড়াই দিনের উৎসব করতেন। সেই নিয়ম মেনেই বাউলরা ভাটায় আসেন, উজানে ফিরে যান যে যার আপন নিবাসে। প্রকৃত বাউলরা সরকারি অনুষ্ঠানের ব্যাপারে খোঁজ-খবরও রাখেন না। তাদের মঞ্চে ডাকলেও তারা আসন ছেড়ে উঠেন না। লালন আখড়ার আশপাশে ও একাডেমির নিচে যারা আসন গাড়েন তারা সাঁইকে ভক্তি আর আরাধনায় নিমগ্ন থাকেন। কখনও স্থান ত্যাগ করেন না।
Advertisement
এদিকে সাধক লালন ফকিরের জীবন ও কর্মের ওপর নিয়মিত আলোচনা সভার সমাপনী দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার লোকমান হোসেন মিয়া। পরে লালন মঞ্চে চলে রাতভর লালন সঙ্গীত।
উল্লেখ্য, ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর নির্মম অত্যাচারে গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন যখন বিষিয়ে উঠেছিল, ঠিক সেই সময়ই সত্যের পথ ধরে, মানুষ গুরুর দিক্ষা দিতেই বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের আবির্ভাব ঘটে কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেঁউড়িয়াতে। লালনের জন্মস্থান নিয়ে নানা জনের নানা মত থাকলেও আজো অজানাই রয়ে গেছে তার জন্ম রহস্য। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। আর্থিক অসংগতির কারণে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা লাভ করতে পারেননি। ছিলেন স্বশিক্ষায় শিক্ষিত।
যৌবনকালে পুণ্যলাভের জন্য তীর্থ ভ্রমণে বেরিয়ে তার যৌবনের রূপান্তর ও সাধন জীবনে প্রবেশের ঘটনা ঘটে বলে জানা যায়। তীর্থকালে তিনি বসন্ত রোগে আক্রান্ত হলে সঙ্গীরা তাকে প্রত্যাখ্যান করে। পরে মলম শাহের আশ্রয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার পর সাধক সিরাজ সাঁইয়ের সান্নিধ্যে তিনি ফকিরি লাভ করেন।
ভক্ত মলম শাহের দানকৃত ১৬ বিঘা জমিতে ১৮২৩ সালে আখড়া গড়ে ওঠে। প্রথমে সেখানে লালনের বসবাস ও সাধনার জন্য বড় খড়ের ঘর তৈরি করা হয়। সেই ঘরেই তার সাধন-ভজন বসতো। ছেঁউড়িয়ার আঁখড়া স্থাপনের পর থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি সেখানেই শিষ্যভক্তদের নিয়ে পরিবৃত থাকতেন।
Advertisement
ফকির লালন প্রায় এক হাজার গান রচনা করে গেছেন। ১৮৯০ সালের ১৭ অক্টোবর ভোরে এই মরমী বাউল সম্রাট দেহত্যাগ করেন এবং নিজের সাধন-ভজন ঘরের মধ্যেই তাকে সমাহিত করা হয়।
আল-মামুন সাগর/এমবিআর/এমএস