কালো মুখ হনুমানের জীবনধারা আদিম যুগ থেকে মনুষ্য জীবনধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এদের আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, যৌন মিলন, সন্তান জন্মদান সবই মনুষ্য জীবনের কাছাকাছি। মুখপোড়া হনুমান, চশমাপরা হনুমান, কালো মুখ হনুমান আমাদের দেশে দেখা যায়।
Advertisement
যশোরের কেশবপুর ও মনিরামপুরে প্রায় ২০০ বছর ধরে বসবাস করছে কালো মুখ হনুমান। এ হনুমান সাধারণত লম্বায় ২৪ ইঞ্চি থেকে ৩০ ইঞ্চি এবং উচ্চতায় ১২ ইঞ্চি থেকে ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এদের গড় আয়ু ২০-২৫ বছর। শারীরিক ওজন ৫-২৫ কেজি। মুখের মতো হাত-পায়ের পাতা কালো। চলাফেরার সময় লেজ উঁচু করে চলে। গাছে বসলে লেজ ঝুলিয়ে দেয়। কলা, পেঁপে, আম, আমড়া, সফেদা, জাম্বুরা, মূলা, বেগুন ইত্যাদি ফল-মূল, শাক-সবজিসহ গাছের মুকুল, কচিপাতা, বাদাম এবং বিস্কুট এদের প্রিয় খাবার।
দেশের তিন প্রজাতির হনুমানের মধ্যে একমাত্র কালো মুখ হনুমান দিনের বেশির ভাগ সময় মাটিতে কাটায়। রাত ছাড়া তেমন একটা গাছে চড়ে না। সাধারণত সকাল ও বিকেলে খাদ্যের সন্ধানে বের হয়। দুপুরে বিশ্রাম নেয়। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামলেই নির্দিষ্ট গাছে চলে যায় এবং রাত যাপন করে। দিনের অনেকটা সময় একে অন্যের দেহ চুলকিয়ে সময় কাটায়। জানুয়ারি-মে প্রজননকাল। স্ত্রী ১৮০-২০০ দিন গর্ভধারণের পর একটি বা দুটি বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চারা ১৩ মাস পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করে। পুরুষ ৫-৬ ও নারী ৩-৪ বছরে বয়ঃপ্রাপ্ত হয়।
কালো মুখ হনুমান উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আছে যশোরের কেশবপুর ও মনিরামপুরে। দেশের অন্য কোথাও খুব একটা দেখা যায় না। দিন দিন হনুমানও বিপন্ন হচ্ছে। মূলত মানুষের অত্যাচার, আবাসস্থল ধ্বংস, খাদ্যের অভাব এর প্রধান কারণ।
Advertisement
মানুষের কাছাকাছি থাকায় যশোরের মনিরামপুর ও কেশবপুরের এই কালো মুখ হনুমানের বর্তমানে তেমন নেই খাবার, নেই আশ্রয়, নানা কারণে তারা হারাচ্ছে প্রজনন ক্ষমতা, যা তাদের টিকে থাকার জন্য হুমকি। প্রজনন আর গর্ভকালীন নিরাপত্তার জন্য নেই প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল।
এরা স্পর্শকাতর প্রাণি। এদেরও রয়েছে রাগ-অভিমান কিংবা অভিযোগ। সম্প্রতি একটি কালো মুখ হনুমানের বাচ্চাকে মানুষ মারধর করে। ফলে যশোরের কেশবপুর থানায় গিয়ে হাজির হয়ে সারাদেশে আলোচনার জন্ম দিয়েছে কালো মুখ হনুমান। সেই সাথে জানান দিয়েছে তাদের বুদ্ধিমত্তা। থানা যে সাহায্য কেন্দ্র তা কিভাবে বুঝল, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন প্রাণি বিশেষজ্ঞরা।
জগন্নাথ বিশ্ববদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মেহেদি হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘হনুমান এবং মানুষ একই বর্গের প্রাণি হওয়ায় মানুষের সাথে এর আচরণ এবং বুদ্ধিগত মিল আছে। দেশের কয়েকটি জায়গায় এর দেখা মেলে। তবে যশোরে বেশকিছু হনুমান বসবাস করছে। কিন্তু তাদের সংখ্যা দ্রুত কমে যাচ্ছে। আজ থেকে ৪ বছর আগে প্রায় ২৫০টি হনুমান সেখানে দেখেছিলাম। সম্প্রতি ওই এলাকায় গিয়ে ৮টি দলে ১৫০টির মতো হনুমান দেখেছি।’
কালো মুখ হনুমান কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে এ গবেষক বলেন, ‘উপজেলা প্রশাসনের মাধ্যমে যে খাবারের ব্যবস্থা সরকার করেছে, তা ঠিকমত দেওয়া হয় না। খাবারের অভাবে তারা প্রায়ই মানুষের ঘরে ঢুকে যায়। যে কারণে মানুষের অত্যাচারের শিকার হচ্ছে। দিনে এদিক দিয়ে যখন কোন ফলের বা কলার গাড়ি যায়, খাবারের আশায় হনুমান সে গাড়িতে উঠে পড়ে। পরে সে গাড়িতে করে দূরে কোথাও চলে যায়।’
Advertisement
ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার আদনান আজাদ আসিফ বলেন, ‘এরা মানুষের সাথে মিশতে মিশতে বা মানুষের কাছাকাছি থেকে অনেক কিছু আয়ত্ত করে ফেলেছে। এরা খুবই বুদ্ধিমান। মানুষের খুব কাছে থেকেই হয়তো এরা বুঝতে পেরেছে, পুলিশ মানুষের সমস্যার সমাধান করে এবং অপরাধীদের গ্রেফতার করে। যে কারণে এদের একটি বাচ্চাকে মারধর করায় এরা থানায় যায়। থানার ওসি যখন ইশারা দিয়ে বোঝালেন, তিনি বিষয়টা দেখবেন; তখন এরা থানা থেকে চলে আসে।’
বিরল প্রজাতির কালো মুখ হনুমান মানুষের অনীহার কারণে বিলুপ্তির পথে। এদের সংরক্ষণে গৃহীত হচ্ছে না তেমন সরকারি উদ্যোগ। প্রকট খাদ্যাভাব ও অভয়ারণ্যের অভাবে প্রজনন ক্ষমতা হ্রাসের কারণে কেশবপুরের হনুমানের সংখ্যা দিন দিন কমছে। সরকার থেকে তাদের জন্য প্রতিদিন যে খাবার বরাদ্দ রয়েছে, সেটাও ঠিকমত দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
কেশবপুর উপজেলা পরিষদের সীমানা দেয়াল, পশু হাসপাতাল, রামচন্দ্রপুর, বক্ষকাটি, বালিয়াডাঙ্গা, মধ্যকূল ও ভোগতী গ্রামে এদের বিচরণ বেশি। এরা সাধারণত একজন পুরুষ হনুমানের নেতৃত্বে দলবদ্ধভাবে চলাচল করে। প্রতিটি দলে ১০-১৫ থেকে ৩০-৪০টি হনুমান থাকে। এদের প্রতিটি সদস্য দলপতির নির্দেশ মেনে চলে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলপতি অন্য কোন পুরুষ সদস্যকে তার দলে সহ্য করে না। যদি কোন পুরুষ হনুমান দলে ঢুকে পড়ে দলপতি তা টের পেলে তাকে হত্যা করে। তাই প্রসূতি তার পুরুষ সন্তানটিকে নিয়ে দলপতির নাগালের বাইরে পালিয়ে বেরায়। যতদিন না সে দলপতির আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা অর্জন করে।
এসইউ/জেআইএম