পরকালের শাস্তি সম্পর্কে ইয়াহুদি-খ্রিস্টানদের ভাবনা ছিল তারা আসমানি কিতাব পাওয়া জাতি। তাদের কাছেও আল্লাহর পক্ষ থেকে কিতাবের অংশ বিশেষ নাজিল হয়েছিল। কিন্তু তারা সে কিতাবের সব হুকুম আহকাম মেনে চলতো না। যার কারণে অবিশ্বাসীরা পরকালে পরিপূর্ণ কর্মফল থেকে বঞ্চিত হবে না!
Advertisement
তাদের এ বিশ্বাস ছিল যে, তারা আসমানি কিতাবের অনুসারী। তাদের আজাব বা শাস্তি হবে না। যদিও তাদের আজাব বা শাস্তি হয় তবে তা হবে সাময়িক। অথচ তাদের এ চিন্তা ছিল ভুল। যার জবাব আল্লাহ তাআলা আগের আয়াতগুলোতে তুলে ধরেছেন।
আবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইসলামের বিজয় সুসংবাদ দিলে মুনাফিকদের গায়ে জ্বালা বেড়ে যেতো। তারা কোনোভাবেই ইসলামের বিজয় লাভের কথা মেনে নিতে পারতো না। সে সময় বিশ্বনবি রোম, পারস্য এবং ইয়েমেন বিজয়ের সুসংবাদ দেন।
এতে মুনাফিকরা বলতে থাকে যে, ক্ষুধার্থ ও দুর্বল মুসলিম বাহিনী কিনা লড়বে এবং বিজয় লাভ করবে সমগ্র আরবের সেরা যেদ্ধাদের সম্মিলিত বাহিনর সঙ্গে- এ বলে মুসলমানদের উপহাস করতে থাকে। আল্লাহ তাআলা কুরআনে পাকে মুনাফিকদের উপহাস ও কথার জবাবে তার ক্ষমতা বর্ণনা তুলে ধরেন-
Advertisement
قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء وَتُعِزُّ مَن تَشَاء وَتُذِلُّ مَن تَشَاء بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ – تُولِجُ اللَّيْلَ فِي الْنَّهَارِ وَتُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَتُخْرِجُ الْحَيَّ مِنَ الْمَيِّتِ وَتُخْرِجُ الَمَيَّتَ مِنَ الْحَيِّ وَتَرْزُقُ مَن تَشَاء بِغَيْرِ حِسَابٍঅনুবাদ : (হে রাসুল! আপনি) বলুন! হে আল্লাহ! তুমিই সার্বভৌম শক্তির অধিকারী। তুমি যাকে ইচ্ছা রাজ্য দান কর এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নাও এবং যাকে ইচ্ছা সম্মান দান কর আর যাকে ইচ্ছা অপমানিত কর। তোমারই হাতে রয়েছে যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সর্ব বিষয়ে ক্ষমতাশীল। তুমি রাতকে দিনের ভেতরে প্রবেশ করাও এবং দিনকে রাতের ভেতরে প্রবেশ করাও। আর তুমিই জীবিতকে মৃতের ভেতর থেকে বের করে আন এবং মৃতকে জীবিতের ভেতর থেকে বের কর। আর তুমিই যাকে ইচ্ছা বে-হিসাব রিজিক দান কর।’ (সুরা আল-ইমরান : আয়াত ২৬-২৭)
আয়াত নাজিলের কারণসুরা আল-ইমরানের ২৬ ও ২৭ নং আয়াত নাজিল প্রসঙ্গে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বর্ণনা করেন এক ঘটনা। যা মদিনায় হিজরতের পর নাজিল হয়।
মদিনায় হিজরতের এক বছর পরই বদরের যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। এ যুদ্ধে অবিশ্বাসী মূর্তিপুজারীরা পরাজিত হয়। পরবর্তীতে মুসলিমদের উপর অবিশ্বাসীদের ওহুদের যুদ্ধের আক্রমণও ব্যর্থ হয়।মুসলিমদের সঙ্গে বদর ও ওহুদ যুদ্ধে সুবিধা করতে না পেরে মক্কার অবিশ্বাসী কুরাইশ ও ইয়াহুদি খ্রিস্টানরা সমগ্র আরবের পুরো ইসলাম বিরোধী শক্তিকে একত্রিত করে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে মদিনা আক্রমণ করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
পঞ্চম হিজরিতে এ মানসিকতায় ইসলাম বিদ্বেষীরা ঐক্যজোট গড়ে তোলে। তাদের সম্মিলিত সৈন্য বাহিনীর সংখ্যা দাড়ায় ১২ হাজার। পবিত্র কুরআনে এ যুদ্ধকে আহজাবের যুদ্ধ হিসেবে নামকরণ করা হয়। এ নামে একটি সুরাও নাজিল হয়। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল ইসলামকে চিরতরে শেষ করে দেয়া।
Advertisement
সমগ্র আরবের ইসলাম বিরোধী সম্মিলিত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রস্তুতিতে তিনি সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। হজরত সালমান ফারসি রাদিয়াল্লাহু আনহু চমৎকার এক পরামর্শ দেন। সে পরামর্শে মদিনার উপকণ্ঠে ইসলামের দুশমনদের আগমনের পথে পরিখা খননের সিদ্ধান্ত হয়। গভীর এবং প্রশস্ত পরিখা খনন শুরু হয়। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামসহ ৩ হাজার সাহাবি এ পরিখা খনন কাজে অংশগ্রহণ করলেন।
পরিখা খননকালে এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। পরিখা খননের সময় এক বিরাট পাথরের খণ্ড পাওয়া যায়। যা কেউ সরাতে পারছিল না। তখন প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে ওই বিশাল পাথরে আঘাত শুরু করেন এবং আঘাতে আঘাতে পাথরটি খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলেন। প্রতিটি আঘাতেই পাথর থেকে আগুনের ফুলকি ও আলো বের হয়। তিনি তাতে বিশেষ আশ্চর্যজনক বিষয়ের ইঙ্গিত পান।
বিশ্বনবির দেখা সে আশ্চর্যজনক বিষয়প্রথম আঘাতের পর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, এ আগুনের ফুলকি ও আলোতে আমাকে পারস্য সম্রাজ্যের রাজ প্রাসাদ দেখানো হয়েছে।অতঃপর তিনি সে পাথর খণ্ডে দ্বিতীয় আঘাত করলে পুনরায় সেরূপ আগুনের ফুলকি ও আলো বের হয়। তখন তিনি ইরশাদ করেন, ‘এ আলোতে আমাকে রোজ সম্রাজ্যের লাল রংয়ের দালানগুলো দেখানো হয়েছে।অতঃপর বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবার আঘাত করলে আগুনের ফুলকি ও আলো বের হয়। তাতে তিনি ইরশাদ করেন, আমাকে এ আলোতে এবার ইয়ামেনের রাজধানী ‘সানআ’ শহরের উঁচু উঁচু দালান কোঠা দেখানো হয়েছে।অতঃপর প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও ইরশাদ করেন-‘নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা আমাকে পৃথিবীর প্রাচ্য এবং প্রতীচ্যের স্থানসমূহ দেখিয়েছেন। অদূর ভবিষ্যতে আমার উম্মতের ক্ষমতা সে সব এলাকায় বিস্তার লাভ করবে, যা আমাকে দেখানো হয়েছে।’
এ কথা শোনার পর ইসলামের দুশমনরা মুসলমানদের কটাক্ষ করে বলতে লাগলো যে, মদিনাতেই যাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা, যারা আত্ম রক্ষার প্রয়োজনে দিন-রাত পরিখা খননে ব্যস্ত। যারা ক্ষুধার্ত, তারা এ অবস্থায় রোম, পারশ্য এবং ইয়ামেন বিজয়ের স্বপ্ন দেখছে; এর চেয়ে বিস্ময়কর কথা আর কি হতে পারে!
ইসলামের দুশমনদের এ উপহাস ও টিটকারীর জবাবে আল্লাহ তাআলা আলোচ্য আয়াত নাজিল করেছেন। প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে আল্লাহ তাআলা ঘোষণ করেছেন-‘(হে রাসুল! আপনি) জানিয়ে দিন যে, ক্ষমতার একচ্ছত্র মালিকানা একমাত্র আল্লাহর। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে এ ক্ষমতা দান করেন। আর যাকে ইচ্ছা তাকে এ ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এক আল্লাহর নিয়ন্ত্রণাধীন। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে সম্মানিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা অপমানিত করেন।তাই আজ যারা ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পরিখা খননে ব্যস্ত, যারা আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সংগ্রামরত; আল্লাহর মর্জি হলে অতিসত্বর তিনি তাদেরকে পারস্য, ইয়ামেন এবং রোমের অধিপতি করতে পারেন।
উল্লেখ্য যে, এ আয়াত নাজিলের কয়েক বছরের মধ্যেই বিশ্বনবি ঘোষিত সেসব দেশ মুসলমানের হস্তগত হয। আর এভাবেই কুরআনুল কারিমের ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়। কেননা তিনিই সর্বাধিক কল্যাণের অধিকারী। তিনিই সব কিছুর ওপর ক্ষমতাবান।
আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তার কুদরত ও ক্ষমতার প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা বিশ্বাস রাখার তাওফিক দান করুন। ইসলামের সব বিষয়ের ওপর অটল ও অবিচল থাকার তাওফিক দান করুন। কুরআনের শিক্ষা গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এমএমএস/জেআইএম