পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের অংশ হিসেবে আজ ১৪ অক্টোবর দেশের আটটি উপজেলায় ভোটগ্রহণ হচ্ছে। যেসব উপজেলায় ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে সেগুলো হলো, শেরপুর সদর, নেত্রকোনার আটপাড়া, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর, বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ, ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর, নোয়াখালীর কবিরহাট ও চট্টগ্রামের সাতকানিয়া। পূজার ছুটিতে এবার সাতকানিয়া ছিলাম, কিন্তু পুরো একটা দিন কেটে যাওয়ার পরও আমি বুঝতে পারলাম না সেখানে নির্বাচন হচ্ছে যদি না স্থানীয়রা মনে করিয়ে দিতেন। কোথাও কোনো নির্বাচনী ক্যাম্প চোখে পড়েনি। অসাবধানী বাড়ির লোকজন শহরে বাসার ওপর থেকে ময়লা ফেললে বিদ্যুৎ এর তারে যেমন দু’একটা ঝুলে থাকে, পোস্টারের অবস্থাও তেমন। মাঝে মাঝে অবশ্য মাইকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল, ‘অমুক ভাইকে ভোট দেন।’ স্থানীয় দোকানি আবু তাহেরের কাছে জানতে চাইলাম প্রার্থীদের সম্পর্কে। তিনি জবাব দিলেন, ‘এতো এতো প্রার্থী কে যে কোন দল সাপোর্ট করে বোঝা মুশকিল।’
Advertisement
বুঝলাম আলাপে আগ্রহ কম। ভোট নিয়ে আগ্রহ দেখা গেলো না স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝেও। চায়ের দোকানেও উত্তাপ নেই। কেনো এমন হচ্ছে জানতে চেয়েছিলাম স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ডা. বিপ্লব পালিতের কাছে। তার বক্তব্যে পুরোপুরি বিষয়টা স্পষ্ট না হলেও যেটা বোঝা গেলো তা হচ্ছে, এখন হাইব্রিড আওয়ামী লীগ সবখানেই। প্রকৃতদের কদর কমেছে। তবে স্থানীয় অনেকের মতে, এখন ভোটারদের কদর নেই। সেটা অবশ্য বোঝা গেলো নানা জনের মন্তব্য থেকে। প্রার্থীরা সেই অর্থে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেনই না। জাস্ট দূর থেকে একটু দেখা দিয়ে যাওয়া।
আওয়ামী লীগ প্রার্থী ব্যবসায়ী এম এ মোতালেব এর সঙ্গে জনসংযোগে যোগ দিয়েছেন আবু সুফিয়ান, কুতুব উদ্দীনসহ অনেকে। জানতে চাইলাম ভোটের পরিস্থিতি। তাদের ভাষায়, ভোট শান্তিপূর্ণ হবে। পরদিন বিএনপি প্রার্থী আবদুল গাফফার চৌধুরীর বাড়িতে গেলাম। তিনি জনসংযোগে বেরিয়েছেন। কথা হলো তার ছেলে ব্যারিস্টার ওসমান চৌধুরীর সাথে। তিনি ভোটের যে পরিস্থিতি বর্ণণা করলেন, তাতে মনে হচ্ছে বিএনপিকে লড়তে হবে বিএনপির বিরুদ্ধেই। এখনো জোটের সবাই এক হয়ে কাজ করছেন বলে মনে হচ্ছে না। তবে সবচেয়ে যেটা আতঙ্কের সেটা হলো ভোট কারচুপি বা ভোটারদের ভোট দিতে না যাওয়ার আশঙ্কা। যদিও সাতকানিয়ার সবগুলো কেন্দ্রে ভোট হবে ইভিএমএ।
পুরো এলাকা একদিনে যতোটা সম্ভব ঘুরলাম। আওয়ামী লীগ, বিএনপি বা স্থানীয় অনেকের সাথে কথা বলে বুঝলাম, সাতকানিয়ার রাজনীতিতে জামায়াত এখনো একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। জামায়াত-শিবির চাইবে না বিএনপির কোনো বড় নেতা সৃষ্টি হোক। সেটা বিএনপি প্রার্থীর জন্য ভয়ের। সেই ভয়টা স্থানীয় এমপির জন্যও। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের একজন বড় নেতা মানেই সেটা জামায়াত ঘেঁষা বলে পরিচিত বর্তমান এমপি আবু রেজা নদভীর জন্যও চ্যলেঞ্জ। তবে সবকিছুর ঊর্ধ্বে হচ্ছে ভোটাররা। যারা ভোটকেন্দ্রে যেতে পারলে সবপ্রার্থীই মনে করেন তিনি জিতবেন। কিন্তু ভোটারদের যে ভোট নিয়ে তেমন আগ্রহ নেই।
Advertisement
গেলো মাসে নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে এক সভায় কর্মকর্তাদের উদ্দেশে সিইসি বলেছিলেন, ‘একসময় উপজেলা নির্বাচন অফিস ছিল না। জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের সম্বল ছিল একটি ব্যাগ, আর যাতায়াতের বাহন ছিল রিকশা। এখন সে অবস্থা নেই। আপনাদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। ক্ষমতাও দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। আমরা যদি নিজেরা শক্তিশালী না হই, তাহলে কী হবে?’ হ্যাঁ, দেশের অবস্থার উন্নতি হয়েছে এটা সত্য। রাস্তা পাকা। রিকশা বলতে গেলে উঠেই গেছে। ব্যটারি চালিত সব গাড়ি। কিন্তু মানুষের ভোটের অধিকার কোথায়? কেনো মানুষ ভোট দিতে যাচ্ছেন না। কেনো পত্রিকার পাতায় ছবি ছাপা হচ্ছে, ‘ছাগল আছে, ভোটার নেই’ শিরোনামে।
স্থানীয় পর্যায়ের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের এই হাল কেন? প্রথম বিষয় হচ্ছে, এখন আর সেভাবে সব দল এই নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে যেভাবে হতো, তখন সকলে একরকম ভাবে অংশ নিতো। ফলে সেটা ছিল জমজমাট। এখন যেহেতু দলীয়ভাবে নির্বাচন সে কারণে নির্বাচন জমজমাট হবে সবদলের স্বর্তঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ হলে। আবার দলীয় পরিচয়ে নির্বাচন হওয়ায় প্রার্থীদের দলের প্রতি আনুগত্য বেশি থাকে। নির্বাচিত হওয়ার পরও তাদের কাজে সেটার প্রতিফলন ঘটে। ফলে সাধারণ মানুষ যারা তাঁকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছেন তাদের কখনো কখনো জন প্রতিনিধিদের কাছে কোনো কাজে যেতে হলে দলীয় পরিচয় বা কারো মাধ্যমে যেতে হয়। এ কারণে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। তবে গেলো জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ ব্যাপকভাবে কমেছে। তাই ১০ মার্চ থেকে শুরু হওয়া উপজেলা নির্বাচনগুলোতে ভোটারদের অনীহা দেখা গেছে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখন পর্যন্ত চারধাপে নির্বাচনে একই চিত্র দেখা গেছে। দিনভর নির্বাচনী কর্মকর্তারা বসে থাকেন। কিন্তু ভোটাররা তেমন আসেন না বললেই চলে। নিজেও কয়েকজন ভোটারের সাথে কথা বলেছি সাতকানিয়ার। তাদের মতে, ‘আমার একটা ভোট দিয়ে কী হবে? আমি না দিলেও ভোট অন্যজনে দিয়ে দেবে।’ খোদ নির্বাচন কমিশন থেকেই বলা হচ্ছিল, একতরফা নির্বাচনের কারণে ভোটাররা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এর মধ্যে ভোটারদের কেন্দ্রে আনার দায়িত্ব ইসির নয় বলেও মন্তব্য করেছিলেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা। এ ধরনের বক্তব্য প্রকাশ্যে না করাই উচিত। কারণ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব এমন একটা নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা যাতে ভোটাররা নিরাপদে ভোট কেন্দ্রে এসে ভোট দিতে পারেন। এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে ভোটারদের আস্থা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এখন মানুষ ভোটের প্রতি আস্থা হারিয়ে কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এটি গণতন্ত্রের জন্য বিপজ্জনক।
আমাদের গণতন্ত্রের ভিত এমনিতেই নড়বড়ে। এর মধ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা, নির্বাচনের প্রতি মানুষ আস্থা ও আগ্রহ হারিয়ে ফেললে সেটি ভবিষ্যত গণতন্ত্রের জন্য হুমকি। যেখানে নির্বাচনে প্রচুর ভোটারের সমাগম হয় এবং ভোটারদের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা থাকে, সেখানে গণতন্ত্র শক্ত ভিতের ওপর কার্যকর থাকে। সাতকানিয়ায় গিয়ে যেমনটি ভোটারদের ওপর আস্থার কথা বলছিলেন ইউপি সদস্য পলাশ সেন। তার মতে, মানুষ শেখ হাসিনার উন্নয়নকে ভোট দেবেন। আবার বিএনপি সমর্থক মোহাম্মদ ইলিয়াছ মনে করেন, মানুষ সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে রায় দেবেন। তবে সবদলই চায়, মানুষ ভোট কেন্দ্রে এসে ভোট দিক। এই যে আস্থা হারানোর অবস্থার উন্নতি করা কিন্তু শুধু নির্বাচন কমিশনের দায়িত্বই নয়। এই দায়িত্ব সব রাজনৈতিক দল, সরকার ও নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবার।
Advertisement
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।
এইচআর/পিআর