মতামত

মৃত্যুর পর জীবন থাকে না, থাকে জীবন-দর্শন

মৃত্যুর পরে তো আর জীবন হয় না। কিন্তু ক্রিকেটকে যিনি নতুন জীবন দিয়ে গেলেন তাঁর কিভাবে মৃত্যু  হয়! নশ্বর দেহ ছেড়ে তিনি চলে গেলেন। তবে ক্রিকেট গ্রহে তিনি ঠিকই বেঁচে রইলেন। ক্রিকেট নামক খেলাটা যখন ইংলিশ আর অস্ট্রেলিয়ানদের রক্ষণশীল মানসিকতা আঁকড়ে রেখে আভিজাত্যের ধ্বজা ওড়াতে গিয়ে  আর্থিকভাবে রুগ্ন হয়ে পড়েছিল, তখন তাকে বাঁচাতে নতুন চিন্তা যিনি ক্রিকেট প্রশাসনে ইনজেক্ট করেছিলেন, তিনি জগমোহন ডালমিয়া। ক্রিকেট বিশ্বে তাঁর কাছের মানুষদের কাছে তিনি ছিলেন- ‘প্রিয় জগুদা’। তাঁর মুত্যুর মধ্যে দিয়ে ভারতীয় ক্রিকেট প্রশাসনে ডালমিয়া অধ্যায়ের যেমন শেষ হলো, তেমনি শুরু হলো বিশ্ব ক্রিকেট নিয়ে আবার নতুন হিসেব নিকাশ। ডালমিয়াহীন ক্রিকেট বিশ্ব কি আবার শ্রীনিবাসন-জাইলস ক্লার্ক আর অ্যাডওয়ার্ড এই তিন মূর্তির হাত ধরে বৃহত্তর বিভাজনের দিকে এগিয়ে যাবে! যেখানে আর্থিক বিচারে তৈরি হবে ক্রিকেটের উন্নত আর অনন্নুত বিশ্ব!ডালমিয়ার মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শঙ্কার এই চোরাস্রোত বইতে শুরু করেছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট মহলেরও দু’একজনের সঙ্গে কথা বলে সেটা ভালোভাবেই টের পাওয়া গেছে। ডালমিয়ার মৃত্যুর পর ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি কে হচ্ছেন এই প্রশ্নটাও খুব আলোচিত ক্রিকেট সার্কিটে। উত্তরটা হয়তো জানা যাবে কয়েকদিন পর বিসিসিআইয়ের সাধারণ সভার পর। তবে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত নাম রাজিব শুক্লা।  গান্ধী পরিবারের ঘনিষ্ট এই কংগ্রেস নেতা অবশ্য এন শ্রীনিবাসনেরও ঘনিষ্ঠ। শুক্লা অথবা শ্রীনিবাসন ঘনিষ্ঠ কেউ যদি ভারতীয় বোর্ডের সর্বোচ্চ পদে বসেন, তাহলে প্রশাসনের রিমোটটা চলে যাবে সেই শ্রীনিবাসনের হাতেই। আর আইসিসি-র চেয়ারম্যানের পদে থাকা ঐ ভদ্রলোক বাংলাদেশ ক্রিকেটকে কোনচোখে দেখেন, সেটা নতুন করে  মনে করিয়ে দেয়ার প্রয়োজন পড়ছে না। শুধু একটা কথা বলা যায়; ডালমিয়া যদি হন বাংলাদেশ ক্রিকেটের অকৃত্রিম বন্ধু, তাহলে শ্রীনি ঠিক তার উল্টো।বাংলাদেশ ক্রিকেট কর্তাদের কূটনৈতিক তৎপরতাও শ্রীনি-কে ডালমিয়া সরণি-তে এসে বসানোর সম্ভাবনা ততোটাই যতোটা সম্ভাবনা  স্টুয়ার্ট বিনির অলরাউন্ডার হিসেবে কপিল দেবকে ছাড়িয়ে যাওয়া। ডালমিয়া তাঁর মৃত্যুর মাস ছ’য়েক আগে দেখেছেন শ্রীনি বাংলাদেশের সঙ্গে কি ধরনের আচরণ করেছেন। যা দেখে ডালমিয়া খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েই বলেছিলেন; ‘ ... আইসিসির প্রেসিডেন্ট কামাল ( আহম মুস্তাফা কামাল) এর সাথে আর যাই হোক ভদ্রজনোচিত আচরণ করা হয়নি।’ আচরণটা তো শুধু একজন ব্যক্তির সঙ্গে ছিল তা নয়, পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধির সঙ্গেই ছিল। শ্রীনি-র সেই অভব্য আচরণে আহত মুস্তাফা কামাল-কে তাই সম্মান জানিয়ে ডালমিয়া ইডেনে আইপিএল ফাইনালেও ডেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ব্যক্তিগত অতিথি হিসেবে। বাংলাদেশ ক্রিকেট কর্তাদের সঙ্গে ডালমিয়ার সম্পর্কটা কেমন ছিল সেটা নতুন করে বলার দরকার পড়বে না। সেই সম্পর্কের গভীরতা বোঝা যায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য যখন উপহার হিসেবে ভারতীয় দলের কাছে শাড়ী পাঠিয়ে দেন। সেই ডালমিয়ার অভাব ভারতীয় ক্রিকেট মহল কতোটা অনুভব করবে জানি না। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট যে করবে সেটা জোর দিয়ে বলা যায়।ক্রিকেটকে বাঁচাতে এবং ফুটবল, রাগবি, টেনিসের মতো খেলার সঙ্গে আর্থিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে থাকার জন্য বিশ্বায়নের শ্লোগানটা যিনি তুলেছিলেন, সেই ডালমিয়ার চলে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে হারিয়ে যেতে পারে তাঁর সেই স্বপ্নও। এশিয়ান ক্রিকেট শক্তিকে ডালমিয়া চেয়েছিলেন এক রাখতে। আর শ্রীনির হাত ধরে সেটা হয়েছে বিভাজিত। এশিয়ার ক্রিকেট উন্নয়নে যিনি গড়ে তুলেছিলেন এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিল সেই এসিসি-র বিলুপ্তি ঘটিয়েছেন শ্রীনি। সুতরাং এশিয়া থেকে আর কোনো দেশের টেস্ট প্লেয়িং কান্ট্রি হয়ে ওঠার স্বপ্ন অনেক দূরে চলে গেলো জগমোহন ডালমিয়ার পিছু নিয়ে! শ্রীনিবাসন যদি আরো বেশি জাঁকিয়ে বসার সুযোগ পান ভারতীয় ক্রিকেটে তাহলে বাকি বিশ্বের মনে পড়বে শুধু মহাত্মা গান্ধীর কথা। ‘ ক্ষুদ্র একটা দ্বীপ রাষ্ট্র ( ব্রিটেন) যা করছে বাণিজ্যের নামে ভারতের মতো বৃহৎ রাষ্ট্র যদি কোনোদিন সেটা করে তাহলে বাকি বিশ্বের জন্য অবশিষ্ট থাকবে শুধু দুঃখ।’ হ্যাঁ, ব্রিটিশরা যা করেছিল, সেই ব্রিটিশ আর ব্রিটিশ রানীকে কুর্নিশ করা অজি-দের সঙ্গে হাত মিলিয়ে শ্রীনিবাসন ক্রিকেট বাণিজ্যের ভাগবাটোয়ার যে পথ দিয়ে হাঁটছেন তাতে ক্রিকেট বিশ্বে আর্থিকভাবে দুর্বল দেশগুলোর অনেক বেশি মনে পড়তে পারে জগমোহন ডালমিয়ার কথা। ক্রিকেটকে বাঁচাতে অর্থের দরকার এটা যেমন তিনি বুঝেছিলেন, তেমনি চেয়েছিলেন সেই অর্থের ব্যবহারটা ক্রিকেট উন্নয়নেই হোক। কোনো বোর্ডের তহবিলকে স্ফীত করতে নয়। তাই গত সহস্রাব্দের শেষে আইসিসির সভাপতি হয়ে ক্রিকেটের অনুন্নত বিশ্বের দিকে চোখটা রেখেছিলেন তিনি ।ডালমিয়া চলে গেলেন। কিন্তু তাঁর ক্রিকেটের বিশ্বায়ন দর্শনও চলে গেলো কি না তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে ক্রিকেট-গ্লোবাল স্পোর্ট হয়ে উঠতে হলে ডালমিয়ার দর্শনকেই বেছে নিতে হবে। সেটা আজ না হোক কাল। আর তার মধ্যেই বেঁচে থাকবেন  ক্রিকেটের এক মহান সংগঠক জগমোহন ডালমিয়া।লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘ইনজুরি টাইম’ ‘এক্সট্রা টাইম’ ব্যাপক পাঠক প্রিয়তা পেয়েছে। তিনি কাজ করেছেন দেশের নেতৃস্থানীয় বিভিন্ন দৈনিকে, টেলিভিশন এবং দেশি-বিদেশি রেডিওতে।এইচআর/পিআর

Advertisement