ফিচার

কন্যাশিশুদের সুরক্ষায় কাজ করছেন নেয়ামত

‘আর নয় বাল্য বিয়ে, এগিয়ে যাও স্বপ্ন নিয়ে’- মূলমন্ত্রে কাজ করছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার ‘সেভ দ্য সিস্টার্স’ নামে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই মন্ত্র বুকে ধারণ করে কন্যাশিশুদের জন্য ‘সেফ গার্ড’ হিসেবে কাজ করে আসছে সংগঠনটি। তবে কোন মেয়ে নয়, সংগঠনটির উদ্যোক্তা নেয়ামত উল্লাহ্ একজন কলেজ পড়ুয়া যুবক। যার মূল লক্ষ্যই হলো সমাজ থেকে ইভটিজিং ও বাল্য বিবাহ রোধ করা। আর এ কাজটি তিনি করে আসছেন বিগত দুই বছর ধরে। কাজে কিছুটা সাফল্য এলেও শুধু মেয়েদের নিয়ে কাজ করায় নেতিবাচক মন্তব্য ভীষণভাবে মর্মাহত কারে তাকে। তবুও তিনি স্বপ্ন দেখেন, সমাজে কোন কন্যাশিশু বাল্যবিবাহ ও ইভটিজিংয়ের শিকার হবে না।

Advertisement

কর্মজীবী বাবা-মায়ের সন্তান নেয়ামত উল্লাহ্ নরসিংদী সরকারি কলেজের অনার্স চতুর্থ বর্ষের ছাত্র। দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনিই বড়। বাবা বোরহান উদ্দিন পেশায় ব্যবসায়ী আর মা সুফিয়া আক্তার একজন স্বাস্থ্যকর্মী। নিজের কোন বোন না থাকায় ছোটবেলা থেকেই কন্যাশিশুদের প্রতি মায়া কাজ করত। সেই মায়া থেকেই কন্যাশিশুদের জন্য কিছু করার আশা জাগে। মাত্র ১১ জনকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘সেভ দ্য সিস্টার্স’। সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে এই স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনটির বর্তমান সদস্য সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিনশ’। এর মধ্যে বেশিরভাগই স্কুল-কলেজ পড়ুয়া মেয়ে। গত দুই বছরে ১০-১৫টি কন্যাশিশুর বাল্যবিবাহ ঠেকিয়েছে নেয়ামতের ‘সেভ দ্য সিস্টার্স’।

নেয়ামত উল্লাহ্ নবীনগর উপজেলার রছুল্লাবাদ দাখিল মাদরাসা থেকে ২০১৩ সালে দাখিল এবং ২০১৫ সালে নবীনগর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। বর্তমানে নরসিংদী সরকারি কলেজে স্নাতক চতুর্থ বর্ষে অধ্যয়ন করছেন।

নেয়ামত বলেন, ‘আমদের গ্রামের অনেক কন্যাশিশুকে বাল্যবিবাহ ও বৈষম্যের শিকার হতে দেখেছি। তখন থেকেই তাদের জন্য কিছু একটা করার ভাবনা ছিল। ২০১৭ সালের শেষদিকে এক বন্ধুসহ এলাকার স্কুলের ১০ জন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ‘সেভ দ্য সিস্টার্স’ গড়ে তুলি। শুরুতে কালঘরা গ্রামের স্কুলগুলোতে কন্যাশিশুদের উপস্থিতির হার বাড়ানোর জন্য নিজেদের টাকায় প্রতি মাসে পুরস্কারের ব্যবস্থা করি। আমাদের আর্থিক সীমাবদ্ধতা থাকায় শুধু কালঘরা হাফিজুল্লাহ্ উচ্চ বিদ্যালয়েই এ পুরস্কার দেওয়া হয়। পঞ্চম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রতি শ্রেণিতে তিন জনকে আমরা এ পুরস্কার দিতাম। এতে উপস্থিতির হারও বাড়তে থাকে। এরপর এ কার্যক্রম শুরু করলাম কালঘরা দাখিল মাদরাসায়। কিন্তু শুধু মেয়েদের কেন পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, সেজন্য আমরা কিছু সমস্যার সম্মুখীন হই। গ্রামের মানুষ বিষয়টিকে নেতিবাচক হিসেবে নিচ্ছিল। তবুও আমরা পিছপা হইনি। আমার মা সবসময় আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে।’

Advertisement

তিনি আরও বলেন, ‘স্কুলে উপস্থিতি বাড়ানোর পাশাপাশি মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কর্মসূচি হাতে নেই। প্রতি শুক্রবার রছুল্লাবাদ দাখিল মাদরাসা ও রছুল্লাবাদ ইউ এ খান উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করি। কয়েক দিন পর আবারও একই সমস্যায় পড়ি। কেন মেয়েদেরই প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, ছেলেদের কেন নয়? তবে মাদরাসা থেকে শিক্ষকরা ভালোই সাড়া দেন। কিন্তু ইউ এ খান স্কুলের প্রধান শিক্ষক আইনুল হক আমাদের বললেন, ‘তোমরা যে এটা করছো তোমাদের লাভ কী? তোমরা কি কোন সংস্থার কাছ থেকে টাকা পেয়েছো?’ আমরা বললাম, নিজেদের টাকায় কাজটি করছি। কিন্তু তার বাধার কারণে স্কুলটিতে আর প্রশিক্ষণ চালু রাখতে পারিনি। পরে স্কুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী রছুল্লাবাদ দাখিল মাদরাসায় প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে অংশ নেয়। কিন্তু সেখানেও বাধা সৃষ্টি করেন ওই প্রধান শিক্ষক। বিষয়টি আমরা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোকারম হোসেনকে জানাই। তিনি এ ব্যাপারে ওই শিক্ষককে বলে দেবেন বলে জানান। এরপর কিছুদিন স্কুলটিতে আমরা প্রশিক্ষণ দেই। কিন্তু আবারও স্কুলে প্রশিক্ষণ করালে প্রতিষ্ঠানকে টাকা দিতে হবে বলেন ওই প্রধান শিক্ষক। সেজন্য স্কুলটিতে আমরা প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দেই।

নেয়ামত বলেন, ‘আমাদের সংগঠনের মূল লক্ষ্যই ছিল সমাজ থেকে ইভটিজিং ও বাল্যবিবাহ রোধ করা। তাই আমরা সেই লক্ষ্যেই পরবর্তী কর্মসূচি হাতে নেই। প্রথমে আমরা গ্রামের বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে সচেতনতামূলক সভা-সেমিনার করে কন্যাশিশু এবং তাদের স্বজনদের বাল্যবিবাহের কুফল এবং সবাইকে ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য সচেতন করতে থাকি। এভাবে ইভটিজিং ও বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলছে। মূলত আমরা সংগঠনের সদস্যদের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ আয়োজনের খবরগুলো পেতাম। পরবর্তীতে উপজেলা প্রশাসন ও থানা পুলিশের মাধ্যমে বিয়ে বন্ধ করতাম আমরা। প্রশাসনের সহযোগিতায় এখন পর্যন্ত ১০-১৫টি বাল্যবিবাহ আমাদের সংগঠনের মাধ্যমে বন্ধ করেছি। অনেক ইভিটিজিংয়ের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি প্রশাসনের মাধ্যমে। এলাকার বিশিষ্টজনদেরও আমরা এ কাজে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি। আমাদের সংগঠনের কার্যক্রম এখন নবীনগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রামে ছড়িয়েছে।’

‘সেভ দ্য সিস্টার্স’র সদস্য কলেজছাত্রী মাহীয়া বেগম বলেন, ‘এক ছেলে আমার ছবি অশ্লীল ছবির সাথে যুক্ত করার ভয় দেখিয়ে ফেসবুকে উত্ত্যক্ত করত। বিষয়টি ‘সেভ দ্য সিস্টার্স’র মাধ্যমে পুলিশকে জানানোর পর তারা সমাধান করে দিয়েছে।’

সংগঠনটির আরেক সদস্য স্কুলছাত্রী জয়নব হাসান বলেন, ‘আমি ‘সেভ দ্য সিস্টার্স’র সাথে যুক্ত হওয়ার আগে একটি বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছিলাম। পরে সংগঠনটির কথা জানতে পেরে এর সঙ্গে যুক্ত হই। এই সংগঠন ইতোমধ্যে অনেকগুলো বাল্যবিবাহ বন্ধ করেছে। ইভটিজিংয়ের বিরুদ্ধেও এই সংগঠন সক্রিয় ভূমিকা রাখছে।’

Advertisement

নেয়ামত ও ‘সেভ দ্য সিস্টার্স’ সংগঠনের প্রতিটি সদস্য চান ইভটিজিং ও বাল্যবিবাহ বিরোধী তাদের এ আন্দোলনে সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। যেদিন দেশের কোন কন্যাশিশু আর বাল্যবিবাহ ও ইভটিজিংয়ের শিকার হবে না; সেদিনই নিজেদের স্বার্থক মনে করবে ‘সেভ দ্য সিস্টার্স’র সদস্যরা।

এসইউ/এমএস