ক্যাম্পাস

ছাত্র রাজনীতি নয়, নষ্ট রাজনীতি বন্ধের দাবি

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তারা ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে নন, তবে বুয়েটে যে নষ্ট রাজনীতি চলছে তা বন্ধ করতে হবে।

Advertisement

বৃহস্পতিবার বুয়েটের সামনের রাস্তায় অবস্থান নিয়ে শিক্ষার্থীরা এ কথা বলেন।

শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, আমরা দেখেছি, কিছুটা কনফিউশন (ধন্দ) সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আসলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের পক্ষে নই। দেশের ইতিহাসে ছাত্র রাজনীতির ভূমিকা ছিল এবং আমাদের দেশে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন আছে।

‘কিন্তু আজ বুয়েটে যে নষ্ট ছাত্র রাজনীতি চালু রয়েছে, যার জন্য আসলে আমরা বেঁচে থাকতে পারছি না, হলের প্রতিটি ছেলে-মেয়ে ত্রাসের মধ্যে থাকে, আমাদের এ আন্দোলন তাদের বিরুদ্ধে।’

Advertisement

শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘আমরা প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই, তিনি বিষয়টি একনলেজ (স্বীকার করে নেয়া) করেছেন। আমাদের এ আন্দোলন আসলে রাজনীতির বিরুদ্ধে নয়। বরং ক্যাম্পাসে সংঘটিত সংগঠনভিত্তিক যে রাজনীতি বিরাজ করছে শুধু আমাদের বুয়েট ক্যাম্পাসে, তার বিরুদ্ধে এবং সেটিকে বন্ধ করার জন্য।’

তারা বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রতিষ্ঠান যদি চায় সে ক্ষেত্রে এটি (ছাত্র রাজনীতি) বন্ধ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রের কোনো প্রভাব থাকবে না। শুধু যেটি প্রয়োজন প্রশাসনের সৎসাহস।’

‘তাই আমরা আশা করব, এমন একটি বক্তব্যের পর আর আমাদের প্রশাসন পিছিয়ে থাকবে না। ভিসি স্যার আমাদের থেকে দূরে থাকবেন না। ভিসি স্যার আসবেন এবং আমাদের প্রশ্নের উত্তর দেবেন।’

শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমরা শুনেছি, বলা হচ্ছে শিক্ষার্থীরা পুলিশের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল এবং আলামত আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়েছিল। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের আলামত আটকে রাখার চেষ্টা করা হয়নি। ঘটনাটি যখন ঘটে তখন পুলিশের একটি টিম সরাসরি হল থেকে সিসিটিভি ফুটেজ থানায় নিয়ে যায়। আমাদের শুধুমাত্র দাবি ছিল, হলে যেন সিসিটিভি ফুটেজের একটি কপি রাখা হয়।’

Advertisement

ভিসির সঙ্গে দুর্ব্যবহারের বিষয়ে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘ভিসি স্যারের সঙ্গে কোনো ধরনের দুর্ব্যবহার করা হয়নি। ভিসি স্যার আমাদের অভিভাবক। আমাদের কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় একজন ছেলে হিসেবে, একজন সন্তান হিসেবে তার ওপর ভিসি স্যারের দায়িত্ব রয়েছে। আমরা প্রশ্ন করেছি এবং আমাদের দাবিদাওয়াগুলো জানিয়েছি।’

শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘ভিসি স্যার পর্যাপ্ত কথা বলার সুযোগ পাননি, এটা আমরা স্বীকার করি। ভিসি স্যারের সঙ্গে আমাদের কোনো রাগারাগি নাই। স্যার আপনি আসেন, আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলব। ভিসি স্যারের প্রতি আমরা যদি কোনো দুর্ব্যবহার করে থাকি তার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি।’

প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর কারণেই বিষয়গুলো এত দ্রুত এবং স্বচ্ছভাবে হচ্ছে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রধানমন্ত্রীর জন্যই এটা হচ্ছে।’

ফেইবুকে মন্তব্যের জেরে গত রোববার রাতে শিবির সন্দেহে আবরারকে তার কক্ষ থেকে ডেকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে যায় বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে শুরু হয় মারধর। লাঠি ও ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে কয়েক ঘণ্টা ধরে পেটানোর পর আবরারের মৃত্যু হলে তার লাশ ফেলে রাখা হয় সিঁড়িতে।

বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাই যে মাতাল অবস্থায় আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তা উঠে এসেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এ ভার্তৃপ্রতীম সংগঠনের নিজস্ব তদন্তেও। বুয়েট ছাত্রলীগের ১১ জনকে ইতোমধ্যে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে মোট ১৫জনকে। রিমান্ডে আছেন বেশ কয়েকজন।

এদিকে, আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ‘কাউকে ছাড় দেব না, অন্যায়কারীর বিচার হবেই’ বলে গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে তিনি ঢাকাসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক হলে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করা হবে জানান। এছাড়া বুয়েট কর্তৃপক্ষ চাইলে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করতে পারে বলেও মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের জেরে বৃহস্পতিবার চতুর্থদিনের মতো আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। এদিন সকালে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে আল্টিমেটাম দেয়া হয়েছে- বুয়েটের ভিসি অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম যদি আগামীকাল ২টার মধ্যে তাদের সাথে দেখা না করেন তাহলে বুয়েটের সব ভবনে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হবে

সোমবার থেকে আন্দোলন চালিয়ে আসা শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে দাবি পূরণ না হলে তারা সকল প্রশাসনিক কার্যক্রম বন্ধ রাখতে বাধ্য হবে।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যে ১০ দফা দাবির কথা বলে আসছেন সেগুলো হলো-

১. আবরার ফাহাদের খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সিসিটিভি ফুটেজ ও জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে খুনিদের প্রত্যেকের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

২. বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সিসিটিভি ফুটেজ থেকে শনাক্তকৃত সবাইকে ১১ অক্টোবর বিকেল ৫টার মধ্যে আজীবন বহিষ্কার নিশ্চিত করতে হবে।

৩. মামলা চলাকালে সব খরচ এবং আবরারের পরিবারের সব ক্ষতিপূরণ বুয়েট প্রশাসনকে বহন করতে হবে। এ মর্মে অফিশিয়াল নোটিশ ১১ তারিখ বিকেল ৫টার মধ্যে দিতে হবে।

৪. দায়েরকৃত মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের অধীনে স্বল্পতম সময়ে নিষ্পত্তি করার জন্য বুয়েট প্রশাসনকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। বুয়েট প্রশাসনকে সক্রিয় থেকে সমস্ত প্রক্রিয়া নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে এবং নিয়মিত ছাত্রদের আপডেট করতে হবে।

৫. অবিলম্বে চার্জশিটের কপিসহ অফিশিয়াল নোটিশ দিতে হবে।

৬. বুয়েটে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে দীর্ঘদিন ধরে বুয়েটের হলে হলে ত্রাসের রাজনীতি কায়েম করে রাখা হয়েছে। জুনিয়র ব্যাচকে সব সময় ভয়ভীতি দেখিয়ে জোর করে রাজনৈতিক মিছিল মিটিংয়ে যুক্ত করা হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে কোনো সময় যে কোনো হল থেকে সাধারণ ছাত্রদের বিতাড়িত করা হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে হলে হলে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের এহেন কর্মকাণ্ডে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরা ক্ষুব্ধ। তাই আগামী সাত দিনের (১৫ অক্টোবর) মধ্যে বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন এবং এগুলোর কার্যক্রম স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।

৭. বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি কেন ৩০ ঘণ্টা অতিবাহিত হওয়ার পরও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হননি। তিনি ৩৮ ঘণ্টা পরে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরূপ আচরণ করেন এবং কোনা প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে স্থান ত্যাগ করেন। তাকে সশরীরে ক্যাম্পাসে এসে বুধবার (০৯/১০/১৯) দুপুর ২টার মধ্যে জবাবদিহি করতে হবে।

৮. আবাসিক হলগুলোতে র্যাগ এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের ওপর সব ধরনের শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন বন্ধ করতে হবে এবং এ ধরনের সন্ত্রাসে জড়িত সবার ছাত্রত্ব প্রশাসনকে বাতিল করতে হবে। একই সঙ্গে আহসানউল্লা হল এবং সোহরাওয়ার্দী হলের পূর্বের ঘটনাগুলোতে জড়িত সবার ছাত্রত্ব বাতিল করতে হবে ১১ অক্টোবর বিকেল ৫টার মধ্যে।

৯. আগে ঘটা এ ধরনের ঘটনা প্রকাশ এবং পরে ঘটা যে কোনো ঘটনা প্রকাশের জন্য একটা কমন প্লাটফর্ম (কোনো সাইট বা ফর্ম) থাকতে হবে এবং নিয়মিত প্রকাশিত ঘটনা রিভিউ করে দ্রুততম সময়ে বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বুয়েটের বিআইআইএস অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হবে এবং ১১ অক্টোবর বিকেল ৫টার মধ্যে অগ্রগতি দৃশ্যমান হতে হবে ও পরবর্তী এক মাসের মধ্যে কার্যক্রম পূর্ণরূপে শুরু করতে হবে। নিরাপত্তার স্বার্থে সবগুলো হলের প্রত্যেক ফ্লোরের সবগুলা উইংয়ের দুইপাশে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হবে।

১০. রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আবাসিক হল থেকে ছাত্ৰ উৎখাতের ব্যাপারে ছাত্রদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ায় শেরে বাংলা হলের প্রভোস্টকে ১১ অক্টোবর বিকেল ৫টার মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে।

এমএএস/এমএআর/এমকেএইচ