মুমূর্ষু আবরারের কাছেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমান। আবরারের পাশে তিনি কী করছিলেন, জানতে চাইলে সে সময়ের পুরো পরিস্থিতির ব্যাখ্যা দেন তিনি।
Advertisement
বুধবার (৯ অক্টোবর) দুপুরে বুয়েটের শহীদ মিনারের পাশের রাস্তায় বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের মাঝে উপস্থিত হন বুয়েট শিক্ষক সমিতির সভাপতি এ কে এম মাসুদ। এ সময় মিজানুর রহমানও শিক্ষক সমিতির সঙ্গে এক হন। তিনি এসেই শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন। তাকে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা হলে তিনি তার ব্যাখ্যা দেন।
সেদিন রাতে কী ঘটেছিল মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চান শিক্ষার্থীরা। ওই ভিডিও ফুটেজে তার উপস্থিতির কারণও জানতে চান আন্দোলনকারীরা।
মিজানুর রহমান বলেন, রোববার রাত পৌনে ৩টার দিকে শেরেবাংলা হলের প্রাধ্যক্ষ এবং সহকারী প্রাধ্যক্ষ তার বাসায় যান। তারা এসে দরজা ধাক্কা দেন। দরজা খোলার পর তিনি দেখেন, দুজন সিঁড়ির ওপর বসে আছে।
Advertisement
ছাত্রকল্যাণ পরিচালক তাদের জিজ্ঞেস করেন, কী অবস্থা? উত্তরে সহকারী প্রাধ্যক্ষ জানান, হলে একটি মার্ডার (হত্যা) হয়েছে। মিজানুর রহমান বলেন, তখন তার পোশাক বাইরে বের হওয়ার উপযোগী না থাকায়, কাপড় বদলে আসার জন্য ভেতরে যান। এরপর প্রাধ্যক্ষ এবং সহকারী প্রাধ্যক্ষকে নিয়ে তিনি শেরেবাংলা হলে যান।
ছাত্রদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘যাদের ছবি তোমরা দেখাচ্ছ, তারা সবাই ওখানে ছিল। তাদের সঙ্গে আমিও ছিলাম। সাদা পাঞ্জাবি পরা লোকটি ডাক্তার। তোমরা যদি এ ছবির ব্যাখ্যা চাও, তাহলে বলছি। ডাক্তার আবরারের নাকে, বুকে হাত দিয়ে বলেন, ছেলেটা অনেকক্ষণ আগে মারা গেছে। এ সময় যারা উপস্থিত ছিল, তারা ডাক্তারকে চাপ দেয়, লাশ যেন এখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ডাক্তার জানিয়ে দেন, তার একার পক্ষে ডেডবডি (লাশ) নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।’
এ সময় উপস্থিত ছাত্ররা চিৎকার করে জানতে চান, কারা ডাক্তারকে লাশ সরিয়ে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল। মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমার কোনো দুর্বলতা থাকলে তো এখানে আসতাম না, আমি ব্যাখ্যা দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘ডাক্তার যখন বললেন আবরার মারা গেছে, তখন ছেলেরা আমাদের লাশ সরিয়ে নেয়ার জন্য প্রেশার দিচ্ছিল। আমি বললাম, এটা পুলিশ কেস, আমি লাশ সরাতে পারব না। এদের মধ্যে আমি শুধু রাসেলকে চিনি। ও চাপ দিচ্ছিল। বাকিরা কোনো কথা বলছিল না। আমি ভিসিকে ফোন করি। অনেক রাত হলেও তিনি ফোন ধরেন। তাকে বললাম, এই অবস্থা। উনি বললেন, পুলিশকে ফোন কর। পুলিশ যেভাবে বলবে, সেভাবে কাজ করতে হবে।’
Advertisement
ভিসির সঙ্গে কথা বলে মিজানুর রহমান উপস্থিত ছাত্রদের জানিয়ে দেন, এটা যেহেতু মার্ডার কেস, লাশ তিনি সরাতে পারবেন না। এরপর প্রধান সিকিউরিটি গার্ড আসেন। চকবাজার থানায় খবর দেয়া হয়। সেখান থেকে বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে আসেন। পুলিশের সঙ্গে একজন ডাক্তার ছিলেন। তারা লাশের সুরতহালের কাজ শুরু করেন।
মিজানুর রহমান বলেন, ‘আবরারের ট্রাউজারের একটা অংশ যখন ওঠানো হয়, তখনই বুঝতে পারি আবরারের গায়ে মারের দাগ আছে। সেই ছবি তোমরা দেখেছ। ছবিতে মারের দাগ স্পষ্ট ছিল। ডাক্তার তখন বলেন, শরীরের ওপরের অংশেও দাগ থাকতে পারে। কিন্তু ওই জায়গায় তা পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। কাজেই লাশটা তখন হলের ক্যান্টিনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করে দেখা হয়। সুরতহাল যারা তৈরি করছিলেন, তারা তখন লাশের ছবি নেন।’
তিনি বলেন, ‘সুরতহাল কমপ্লিট করার জন্য লাশের বিস্তারিত তথ্যের দরকার ছিল। বাবার নাম, বাড়ি কোথায় এসব লাগত। ওদের মধ্যেই কেউ একজন আবরারের ফোন এনে দেয়। আমি জানি না, ওরা কারা। সিকিউরিটি গার্ড আবরারের কললিস্ট থেকে বাবা-বা মার নাম দেখে ফোন করে। তখন তাদের নাম, বাড়ির ঠিকানা পাওয়া যায়। সুরতহাল তৈরি করার সময় হলের প্রাধ্যক্ষ, সহকারী প্রাধ্যক্ষ, ডাক্তারের সঙ্গে আমিও ছিলাম। আমাদের সামনে রেখে লাশের ছবি তোলা হয়। আমাদের সবার স্বাক্ষর নেয়া হয়। তখনো হয়তো পুলিশের কাজ শেষ হয়নি। কখন লাশ নিতে পারবে সে ব্যাপারে ওপর থেকে নির্দেশনা চাচ্ছিল তারা। কিছুক্ষণ পর পুলিশের গাড়িতে আরেকজন সিনিয়র কর্মকর্তা আসেন। পুলিশের গাড়িতে লাশ তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
জেপি/এএইচ/এমকেএইচ