সম্রাট, ক্যাসিনো, খালেদ, শামীম, লোকমান, অভিযানের হিড়িকে রংপুর-৩ উপনির্বাচন বাজার পায়নি। এতো বড় একটি জাতীয় নির্বাচন সত্বেও মিডিয়াগুলো একে তেমন ট্রিটমেন্ট দেয়নি। পত্রিকাগুলো রংপুরের নির্বাচনের খবরকে সিঙ্গেল বা ডাবল কলাম করেছে। কোনো কোনো পত্রিকা এ খবর নিয়ে গেছে ব্যাক পেজে। আর টিভিগুলো দিয়েছে একেবারে শটকার্ট খবর। পাঠক-দর্শক-শ্রোতা তথা বাজারদৃষ্টেই খবর বাজারজাত করে গণমাধ্যমগুলো। এ ক্ষেত্রেও আসলে তা-ই হয়েছে।
Advertisement
নির্বাচন নিয়ে মানুষের গরজ হারিয়ে গেছে কবেই। নির্বাচন গেছে নির্বাসনে। কারো কাছে ভোট-নির্বাচন এখন জাদুঘরের আইটেম। এর চেয়ে হালনাগাদ বা আপডেটের দিকে ঝোক বেশি। তা-ও আবার জুয়া, ক্যাসিনো, টাকা, দাপট, হিরোইজমের কাহিনী। সঙ্গে নারী থাকলে আকর্ষণ আরেকটু বেশি। অথচ বাংলাদেশের নয় বছরের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতি এরশাদের মৃত্যুতে শূন্য হওয়া আসনটি নিয়ে মানুষের একটুআধটু গরজ থাকলেও থাকতে পারতো। নানা কারণে সেটি হয়নি। এ নির্বাচনটির ফলাফল কি হবে তা মানুষ আগেই জেনেছে। কেউ কেন্দ্রে না গেলেও ভোট হবে, নির্বাচন হবে। সরকারি মহল এবং নির্বাচন কমিশন থেকেও বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। হয়েছেও তাই। সেইসঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হলো পরিবার কেন্দ্রিক রাজনীতির আরেকটি আনুষ্ঠানিকতা।
এরশাদপুত্র সাদ নির্বাচিত হয়েছেন না নির্বাচিত করা হয়েছে-সেটাও বুঝতেও কারো বাকি নেই। গরজ না থাকায় রংপুরে ভোটের এমন খরার রঙিন বায়োস্কোপের দর্শকও মেলেনি। গণমাধ্যমগুলোর কাছেও তা নিউজভ্যালু পায়নি। নির্বাচন কমিশনের হিসাবে সেখানে ভোট পড়েছে ২১ শতাংশের সামান্য কিছু বেশি। তাতে কিছু যায় আসে না। ন্যূনতম কত শতাংশ ভোট পড়তে হবে, সংবিধান বা নির্বাচনি আইনে সে বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। কাজেই ৪ লাখ ৪১ হাজার ভোটারের মধ্যে ৫৮ হাজার ৮০০ মানুষের ভোটে সাদ বা কারো জয়ে ভুল নেই। ৭৮/৭৯ শতাংশ ভোটারের ভোট না দেয়া বা প্রত্যাখ্যানে লজ্জারও বালাই নেই। কেউ ভোট না দিলেও বা একেবারে বিনাভোটে হলেই বা কি? অবশ্যই তিনি একজন মাননীয়। জাতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
মানুষ কেন ভোট দিল না, একটি দেশের নাগরিকরা কেন ভোট থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল- সেই প্রশ্ন বরং অবান্তরের পর্যায়ে। ষড়যন্ত্রমূলক প্রশ্ন বললেও কেউ বাধা দেবে না। রংপুরের ভোটের দিন ঢাকায় টিসিবির পেঁয়াজ কেনার লাইনে ছিল মানুষের কিলবিল। ভোটারদের এই কেন্দ্রবিমুখতা কাটাতে প্রার্থী বা নির্বাচন কমিশন থেকেও গরজ দেখা যায়নি। উল্টো আয়েস করেছেন সিইসিসহ নির্বাচন কমিশন কর্তারা। রংপুরে যখন ভোট চলছিল তখন পাশের লেকে মাছ শিকারে নেমেছিলেন ইসির কর্তারা। কী তামাশা! গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসনে ভোট কাস্টিং দেখানো হয়েছির ৫২ দশমিক ৩১ শতাংশ। তখন জাতীয় পার্টির এইচ এম এরশাদ পেয়েছিলেন ১ লাখ ৪২ হাজার এবং বিএনপির রিটা রহমান ৫৩ হাজার ভোট। কিন্তু এরশাদের মৃত্যুর পর এই শূন্য আসনে উপনির্বাচনে ভোটের হার নেমে এল অর্ধেকেরও নিচে।
Advertisement
এ নিয়ে কোনো মহলে ভাব-উদ্বেগ না থাকলেও বাংলাদেশের জন্য বার্তা আছে। রয়েছে ভবিষ্যতে নির্বাচনী ব্যবস্থা আরো কোথায় গিয়ে গড়াতে পারে, সেই বিষয়ক আলামত। যার নমুনা মানুষ দেখেছে গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটির নির্বাচনেও। নির্বাচনি ব্যবস্থাকে খোঁড়া করে দেওয়ার ঠাণ্ডা কোনো আয়োজন চলছে কি-না, সেই জিজ্ঞাসাও থেকে যায়। নির্বাচনি ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আগ্রহ নষ্ট হওয়া গণতন্ত্রের জন্য কতো বড় অশনিসংকেত, বাংলাদেশ কি সেটা ভোগার পথে এগুচ্ছে? সেই তরিকার নির্বাচনের শিকার উত্তর কোরিয়ার জনগন। দেশটিতে পাঁচ বছর পর সংঘাতমুক্ত শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়। উত্তর কোরিয়ায় প্রত্যেক নাগরিককে শাসক কিম পরিবারের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়। আর এই ভোট সেটা আনুষ্ঠানিকভাবে করে দেখানোর একটি মাধ্যম। এই নির্বাচনে জয়ী হন সুপ্রিম পিপলস অ্যাসেম্বলির ৬৮৭ সদস্য।‘ঘাড় ধরে’ ভোট দেওয়ানো ওই নির্বাচনে ভোট কাস্টিং দেখানো হয় প্রায় শতভাগ।
কাকে ভোট দিতে হবে তা ঠিক করে দেয় উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীনরা। সেই ব্যালট নিয়ে প্রকাশ্যে বাক্সে ভর্তি করতে হয় ভোটারদের। একটি পেনসিল রাখা থাকে ভোটারদের জন্য। তিনি চাইলে কোনো প্রার্থীকে ক্রস চিহ্ন দিয়ে তার ভিন্ন মত প্রকাশ করতে পারেন। বাস্তবে এমনটি করার দুঃসাহস কেউ করেন না। জবরদস্তিমূলক ভোটের পর ভোট দিতে পারায় কেন্দ্রের সামনে নেচে গেয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে হয় ভোটারদের। সবাইকে নেচে গেয়ে শাসকদের প্রতি সন্তুষ্টির জানান দিতে হয়।
কোরিয়ায় তিনটি রাজনৈতিক দলও থাকলেও দু’টি নামকাওয়াস্তে। দৃশ্যমান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নেই তাদের। ক্ষমতাসীন একচ্ছত্র নেতা কিম জং-উনের নেতৃত্বাধীন ওয়ার্কার্স পার্টিই সর্বেসর্বা। জনগণের কথিত ভোটে নির্বাচিত পার্লামেন্টেরও কোনো ক্ষমতা নেই। তারা শুধু সুপ্রিম লিডারের পছন্দ করা আইনকানুন পাস করিয়ে নেন। একক নেতার ইচ্ছার প্রতিফলন করার জন্য এটি একটি রাবার স্ট্যাম্প সংসদ। একের পর এক বাংলাদেশে ভোটের যে উদাহরণ তৈরি হচ্ছে, তা বিবেকবানদের আহত করছে। ফেলছে নানা শঙ্কায়।
নৃতাত্ত্বিকদের গবেষণায় পাওয়া যায়, আদিম জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যেও বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। প্রাচীন গ্রিসীয় শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন হতো লটারির মাধ্যমে। আমেরিকার আদিবাসীদের অনেক গোত্রের লোকেরা নির্দিষ্ট কোনো পাত্রে শস্যকণা ছুঁড়ে গোত্রপতি নির্বাচন করত। প্রাচীন ভারতেও নির্বাচনের বিভিন্ন ধরন পাওয়া যায়। মোঘল শাসনবিধানে স্থানীয় প্রশাসন চালাতেন স্থানীয় মনোনীত ব্যক্তিরা। জেলা পর্যায়ে ফৌজদার ও অপরাপর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগ করতেন সম্রাট নিজে। অন্য কর্মকর্তাদের নির্বাচিত করত জনগণ। আর গ্রামের লোকেরা নির্বাচিত করত তাদের মোকাদ্দমপ্রধান, গ্রামপ্রধান, পাটোয়ারী বা কর আদায়কারী। গ্রাম মোকাদ্দমদের পরামর্শক্রমে নির্বাচিত হতেন পরগণা কাজী ও থানাদার। ১৭৯৩ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে প্রচলিত গ্রাম পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল স্থানীয় প্রশাসনের নির্বাচনধর্মী বৈশিষ্ট্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
Advertisement
১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিস এই ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন। বিভিন্ন তথ্য ও ঘটনার প্রেক্ষিত বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলা অঞ্চলের মানুষ নির্বাচনমুখী। এটা তাদের কাছে উৎসবের মত। ঔপনিবেশিক শাসকরা সেটা বুঝেই গ্রামপ্রধান, পঞ্চায়েত, পাটোয়ারী, আমীন, মুনসেফ, থানাদার, কাজী ধরনের পদ তৈরি করে। সেগুলো করা হত কোনো না কোনো নির্বাচনী ব্যবস্থায়ই। সময়ে সময়ে তা বিতর্কিতও হয়েছে কারচুপি, জালিয়াতি পক্ষপাতিত্বের কারণে। নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা, ভোট কেনা ইত্যাদির ব্যাপারও ছিল। কিন্তু ঘুরে-ফিরে আবার নির্বাচনেই আসতে হয়েছে।
আধুনিক নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সূচনা ত্রয়োদশ শতকে ইংল্যান্ডে। গোপন ব্যালট পদ্ধতির প্রবর্তন ১৮৭২ সালে। আর সর্বজনীন ভোটাধিকারের বিধান চালু হয় ১৯২৮ সালে। বিশ্বে নির্বাচনের ইতিহাসে প্রাচীন অবস্থানে গ্রিস ও রোম। গোটা মধ্যযুগে রোমান সম্রাট ও পোপের মতো শাসক বাছাইও হতো এ রকম নির্বাচনী ব্যবস্থায়। প্রাচীন ভারতে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রজারা বাছাই করতেন রাজাদের। উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের সংস্কৃতিতে প্রভাবশালী গোষ্ঠী ছিল পুরুষরাই। নির্বাচকমণ্ডলীতেও প্রাধান্য থাকত তাদেরই। যুক্তরাজ্য ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলোতে শুরুর দিকের নির্বাচনে জমিদার বা শাসক শ্রেণির পুরুষদের প্রাধান্য ছিল। ১৯২০ সাল পর্যন্ত অবশ্য পশ্চিম ইউরোপের সমস্ত দেশ এবং উত্তর আমেরিকার গণতন্ত্রে সর্বজনীনভাবেই পুরুষ ভোটাধিকার চালু ছিল।
খারাপ নির্বাচনের দোষ বা ভালো নির্বাচনের গুণ নির্বাচনের নয়, পদ্ধতির। আরো খোলাসা করে বললে, এর আয়োজকদের। নির্বাচনের কর্তৃপক্ষ, ভোট দেয়া, নেয়া, গণনায় সম্পৃক্তরা সময়ে সময়ে একে কলঙ্কিত করেছেন। নির্বাচনকে বিনাভোটে পর্যন্ত এনে ঠেকানো হয়েছে। নির্বাচনকে একটা সুযোগ বা মওকা হিসেবে নেয়ার লোকের অভাব হয়নি কখনো। এরা আড়ালে থেকে কলঙ্কিত করেছে নির্বাচনকে। কিন্তু অঘটনের জন্য দায়ী করে নির্বাচনকেই নির্বাসনে পাঠানো সম্ভব হয়নি। জনমত নির্ণয়ে প্রচলিত ভোট পদ্ধতি নিয়ে নানা কথা থাকলেও বিশ্বে এখন পর্যন্ত এর বিকল্প আবিস্কার হয়নি।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/জেআইএম