ভালো শিক্ষকের প্রাথমিক কাজ হলো শ্রেণীকক্ষে নিজের সর্বোচ্চটা ঢেলে দেয়া। সবার সক্ষমতা এক নয়। নিজেকে প্রতিনিয়ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নিজের বাকশক্তি ও সক্ষমতাকে পূর্ণভাবে বিকশিত করা, প্রমিত শুদ্ধ ভাষায় পাঠদান সম্পন্ন করা শিক্ষকের প্রাথমিক দায়িত্ব।
Advertisement
তথ্য প্রদানের ক্ষেত্রে সূত্র ব্যবহার করা এবং কোন মতেই ভুল কিংবা অনুমান নির্ভর কোন তথ্য পরিবেশন না করা। প্রসঙ্গক্রমে জীবন ঘনিষ্ঠ উদাহরণ দেয়া, কিন্তু সেটা করতে গিয়ে বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক গল্পের অবতারণা না করা। নিজের কৃতকর্ম, নিজের পরিবাবের মাহাত্ম্য উপস্থাপন, কোন ধরনের দলীয় এবং আঞ্চলিক পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ থেকে বিরত থাকা, সকল শিক্ষার্থীকে সমানভাবে বিবেচনা করা এবং সকলের সাথে চক্ষু-যোগাযোগ স্থাপন করা একজন ভালো শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য।
সকল ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সুন্দর, পরিমিত ও উষ্ণ ব্যবহার সুমুন্নত রাখা, ব্যক্তিগত ক্ষোভ, হতাশা, দুঃখ কোনভাবেই শ্রেণীকক্ষে সংক্রমিত না করা একজন শিক্ষকের জন্য বাধ্যতামূলক। ক্লাস নেয়ার পর ক্লাসের সার-সংক্ষেপ শেষে এসে বলে দেয়াটাও বেশ জরুরি। কেন বিষয়টা পড়া হলো, এই জ্ঞান কি ভাবে ভবিষ্যতে ব্যবহার করা যাবে- সে বিষয়ে একটা ধারণা দিতে পারলে ভালো।
তবে, শুধু ক্লাসরুমে ভালো পড়ানোই কোন ভালো শিক্ষকের একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। শিক্ষার্থীর সুপ্ত প্রতিভাকে খুঁজে বের করা, সেই প্রতিভাকে বিকশিত করার জন্য তাঁকে উৎসাহ দেয়া এবং তৈরি করাও একজন ভালো শিক্ষকের বৈশিষ্ট্য। পাঠ্যবইয়ের বাইরেও বিরাট পাঠের জগতকে পরিচয় করিয়ে দেয়া একজন শিক্ষকের অন্যতম প্রধান কাজ।
Advertisement
শিক্ষার্থীর চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীলতাকে লালন করাও শিক্ষকের আরেকটি বড় দায়িত্ব। শ্রেণীকক্ষে ও শ্রেণীকক্ষের বাইরে নিজের ব্যক্তিত্ব, রুচি, পোশাক-আশাক, পরিমিতিবোধ ও সহনশীল আচরণের মাধ্যমে নিজেকে শিক্ষার্থীদের কাছে আদর্শ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সচেষ্ট থাকাও শিক্ষকের কর্তব্য। কেননা শিক্ষকতা অন্য আর দশটা পেশার মতো নয়। এটা জীবনব্যাপী এক সাধনা আর ব্রত। এখানে একজন শিক্ষককে প্রতিনয়ত ছাত্র- ছাত্রীদের রোল মডেল হওয়ার জন্য কাজ করতে হয়। শিক্ষার্থীর সকল ধরনের বিকাশের জন্য নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হয়।
ছাত্র-ছাত্রীদের মনে কৌতূহল ও প্রশ্ন জাগিয়ে তোলাও একজন শিক্ষকের বড় দায়িত্ব। তার চেয়েও বড় কাজ হলো ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে স্বপ্ন তৈরি করা এবং তাদেরকে প্রতিনিয়ত উৎসাহ দিয়ে যাওয়া। উচ্চতর প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিজেদের প্রতিনিয়ত গবেষণায় নিয়োজিত রাখা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টির চেষ্টা করে যাওয়াও এক অবশ্য কর্তব্য। আর এত সব করতে হলে শিক্ষককেই জীবনভর সবচেয়ে নিষ্ঠাবান ছাত্র হতে হয়। যারা সে রকম ছাত্র হতে পারেন না, তাদের পক্ষে ভালো শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়। জ্ঞানের সবচেয়ে বড়ো বিষয় হলো জ্ঞান মানুষকে প্রতিনিয়ত এটাই স্মরণ করিয়ে দেয় যে সে আসলে কত কম জানে।
শিক্ষকের আরেকটা বড় বিষয় হলো শিক্ষার্থীদের প্রতি মমত্ববোধ। যেই শিক্ষকের শিক্ষার্থীদের প্রতি মমতা নেই, তিনি আদতে কোন শিক্ষক পদবাচ্য নন। একটা কথা মনে রাখা খুব জরুরি, একবার শিক্ষক মানে সারা জীবনেরই শিক্ষক। সারা জীবন ছাত্রের পাশে দাঁড়ানো, তার যে কোন বিপদ আপদে পাশে থাকা, সহানুভূতি দেখানো, তাদের পেশাগত জীবনের উৎকর্ষের জন্য কাজ করে যাওয়া একজন শিক্ষকের নৈতিক দায়িত্ব। সে রকম শিক্ষক যে আমাদের নেই, তা নয়। কিন্তু তাঁদের সংখ্যা খুবই নগণ্য। আমাদের সোনার বাংলাদেশের জন্য চাই আরও বহু বহু এমন সোনার শিক্ষক।
লেখক: অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
Advertisement
এইচআর/এমকেএইচ