জাতীয়

ভারতের কাছে থেকে কতটা পাচ্ছে বাংলাদেশ?

২০১২ সালের ১ আগস্ট থেকে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ রফতানি নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশ সরকার। ওই বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর ইলিশ ছাড়া অন্য সব মাছ রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

Advertisement

ইলিশ রফতানি বন্ধ ঘোষণার তিন বছর পর, ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সফরে আসেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় তিনি ভারতে ইলিশের অপ্রাপ্তির কথা তুলে ধরেন। এ কথার প্রতিক্রিয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিস্তা চুক্তির দিকে ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, ‘পানি আসলে মাছও যাবে।’

প্রায় সাত বছর বন্ধ থাকার পর শারদীয় শুভেচ্ছা হিসেবে এ বছর ভারতে পাঁচশ টন ইলিশ রফতানি করছে বাংলাদেশ। কিন্তু তিস্তার পানি আসেনি। বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তিটিরও কোনো খবর নেই।

চার দিনের সফরে ভারতে রয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সফরকালে তিনটি ইস্যু বাংলাদেশে নানাভাবে আলোচনায় আছে। এগুলো হলো- ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করায় বাংলাদেশের খুচরা বাজারে পেঁয়াজের দাম একশর বেশি হয়েছে, বিশেষ আদেশে ভারতে ইলিশ রফতানি হচ্ছে এবং ফারাক্কার সবগুলো গেট খুলে দেয়ায় আকস্মিক বন্যার কবলে বাংলাদেশ।

Advertisement

রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বেশিরভাগ কাঁচা বাজারগুলোতে এখন ইলিশ আর পেঁয়াজ নিয়ে আলোচনা। ঢাকার মাছ-বাজারে বিক্রেতা যেমন বলছেন, বাংলাদেশ ইলিশ রফতানি না করলে দেশে দাম হয়তো আরেকটু কমতো। অপরদিকে ভারত রফতানি বন্ধ করেছে বলেই বাংলাদেশে পেঁয়াজের দর লাগামহীনভাবে বেড়েছে।

ভারতের কিছু পণ্য ছাড়া বাংলাদেশে চলে না, সেটা যেমন অনেকে বোঝেন আবার দর কষাকষিতে ভারতকে ছাড় দেয়া হচ্ছে এ রকম ভাবনাও আছে সাধারণেরভ।

এক ক্রেতা পেঁয়াজ-বাজারে ক্ষোভ জানিয়ে বলছিলেন, ‘ইন্ডিয়ায় পূজা হচ্ছে, এখানে পূজা হচ্ছে না? ৫শ টন ইলিশ পাঠিয়ে দিয়েছে, পেঁয়াজ বন্ধ করে দিয়েছে। ওদিকে তিস্তা বন্ধ করে দিয়েছে, ফারাক্কা বৃষ্টির দিনে খুলে দিবে, যখন দরকার তখন বন্ধ করে দেবে এটাই তো হচ্ছে নেগোসিয়েশন!’

বাংলাদেশে কোন দল ক্ষমতায় রয়েছে, তার ওপরে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের মাত্রায় ভিন্নতা দেখা যায়। বাংলাদেশের পর পর দুটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনে জেতার পর, ভারত আওয়ামী লীগ সরকারকে তুলনাবিহীন কূটনৈতিক সমর্থন দিয়ে গেছে বলে ধারণা অনেকের।

Advertisement

অনেকেই বলছেন, দুটি নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক যেকোনো চাপ সৃষ্টির বিপরীতে ভারতের অবস্থান ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে। এর ফলে আওয়ামী লীগ দল হিসেবে উপকৃত হয়েছে, টানা ক্ষমতায় টিকে আছে কিন্তু দেশের স্বার্থে দর কষাকষিতে পিছিয়ে পড়েছে বাংলাদেশ।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক আমেনা মহসীন বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘যদি গণতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক চর্চা, সব দলগুলোকে নিয়েই বলছি, তারা যদি শক্তিশালীভাবে করতে না পারে তাহলে এ সমস্ত হস্তক্ষেপ আমরা দেখবো।’

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের আলোচনায় দেনা-পাওনার হিসেব কষেন অনেকেই। দুই দেশের মধ্যে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ থেকে ভারতের রফতানি আয় তুলনামূলক বহুগুণ বেশি। তবে ২০১৯ সালেই প্রথমবার ভারত থেকে বাংলাদেশের রফতানি আয় বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এ প্রবৃদ্ধি প্রায় ৪৩ শতাংশ। যদিও ভারত থেকে আমদানি হয় এর থেকে প্রায় আটগুণ বেশি।

বাংলাদেশের প্রাপ্তির তালিকায় ভারতে পণ্য রফতানিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পায় বাংলাদেশ, কিন্তু সেখানেও নানা বাধা রয়েছে।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য সম্ভাবনার অর্ধেকের মতো কাজে লাগানো যাচ্ছে। শুল্কমুক্ত বাজার সুবিধা, লাইন অব ক্রেডিট এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও অনেকটা এগিয়েছে বাংলাদেশ, কিন্তু একটা বিষয় মনে রাখতে হবে প্রতিশ্রুতি আর তার বাস্তবায়নের মধ্যে একটা সমন্বয় সাধন করতে হবে। সেদিক থেকে আমাদেরও প্রচেষ্টা এবং সক্ষমতাটা বাড়াতে হবে। নেগোসিয়েশনের জন্য যতটা সক্ষমতা প্রয়োজন সেখানে আমাদের একটা ঘাটতি আছে বলে আমি মনে করি।’

এদিকে প্রাপ্তির খাতায় বাংলাদেশ ভারত স্থল-সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন, বাংলাদেশিদের জন্য ভারতীয় ভিসা জটিলতা অনেকটা নিরসন হয়েছে এবং বেড়েছে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ। সড়ক, রেল, নৌ এবং আকাশপথে এখন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে দু’দেশের মধ্যে এখনও বেশকিছু ইস্যু অমীমাংসিত রয়ে গেছে। আর এই অমীমাংসিত ইস্যুগুলোতেই বাংলাদেশের অপ্রাপ্তি।

এসব অপ্রাপ্তির মধ্যে প্রথমেই আসে বহুল আলোচিত তিস্তা চুক্তির বিষয়টি। তিস্তা নিয়ে এখনও কোনো সুরাহা হয়নি। এছাড়া প্রতিশ্রুতির পরেও সীমান্তে হত্যা বন্ধ হয়নি। গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা না পাওয়া ছাড়াও আছে অভিন্ন নদনদী থেকেও পানির সুষম বণ্টনের প্রশ্ন।

আমেনা মহসীন বলেন, ‘ভারত মোটামুটি আমাদের কাছ থেকে যা চেয়েছিল বাংলাদেশ সবগুলোই পূর্ণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের চাওয়াগুলো বাংলাদেশ পাচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, ভারত নিজস্ব স্বার্থ দেখেই চলছে এবং তাদের জাতীয় স্বার্থে তারা যেটা মনে করছে তারা তাই করছে। তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও তারা সেভাবে কার্ড প্লে করছে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও তারা সেভাবেই আছে।’

জাতীয় নাগরিক পঞ্জি (এনআরসি), রোহিঙ্গা সংকট আর পানি বণ্টনের মতো ইস্যুকে সামনে রেখে নতুন মেয়াদে শেখ হাসিনা এবং মোদি সরকারের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে দিল্লিতে। এই পটভূমিতে আসন্ন বৈঠক থেকে প্রাপ্তি কী হয়, তার দিকেই বাংলাদেশের মানুষ তাকিয়ে আছে।

সূত্র : বিবিসি বাংলা

এমএসএইচ/এমএস