খেলাধুলা

মাছ ধরা আর ভক্তদের আবদার মেটানো মোস্তাফিজের একদিন

ক্রিকেটের বিস্ময়বালক মোস্তাফিজ। ওয়ানডে ক্রিকেটে আকস্মিক আগমণ তার। হাইভোল্টেজ অভিষেক ম্যাচেই দেশকে জিতিয়ে জয় করলেন ১৬ কোটি বাংলাদেশির হৃদয়। মোস্তাফিজের সেই আগমণের পর থেকে এখনও তার প্রতি ভক্ত আর দর্শক-সমর্থকদের আগ্রহের কমতি নেই।

Advertisement

সাতক্ষীরার কালিগজ্ঞ উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের সেই মোস্তাফিজ এখন বাংলাদেশ দলের তারকা ক্রিকেটার। তবে ছেলেবেলার গাঁয়ের আনন্দঘন মুহূর্ত ও ভালোলাগার বিষয়গুলোকে আজও ভালোবাসেন। বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডাবাজি, খেলাধূলা করা ছাড়াও বড়শি-জাল দিয়ে মাছ ধরার প্রতি ভাললাগা ছিল মোস্তাফিজের ছোটবেলা থেকেই।

তাইতো জাগো নিউজের প্রতিনিধির বাড়ির পুকুরে বড়শিতে মাছ ধরতে নেমে পড়লেন। মাছও তুললেন ১২ কেজি ওজনের। গত ২৭ সেপ্টেম্বর (শুক্রবার) সকালে তেঁতুলিয়া গ্রামে মোস্তাফিজের বাড়িতে গিয়ে পুকুরে মাছ ধরার আমন্ত্রণ জানান জাগো নিউজের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আকরামুল ইসলাম।

পুকুরে মাছ ধরতে যাওয়ার জন্য সম্মত হন মোস্তাফিজ। তবে দিনক্ষণ ঠিক করতে পারেননি। জানিয়ে দেওয়া হয় দিনক্ষণ পরবর্তীতে ঠিক করবেন এবং জানিয়েও দিবেন। তবে মোস্তাফিজ শর্ত জুড়ে দেন, বিষয়টি কাউকে জানানো যাবে না।

Advertisement

পরবর্তীতে ৩০ সেপ্টেম্বর (সোমবার) তালায় পুকুরে মাছ ধরতে যাওয়ার সম্ভাব্য দিনক্ষণ জানালেও, সেদিন তিনি যাননি। পরদিন ১ অক্টোবর মঙ্গলবার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে জাগো নিউজের প্রতিনিধি আকরামুল ইসলাম ও তালা সদর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান এস এম নজরুল ইসলামের বাড়িতে হাজির হন মোস্তাফিজুর রহমান।

মোস্তাফিজ আসার আগে সকাল ৮টায় এসে পৌঁছান মোস্তাফিজের মেঝো ভাই মোকলেছুর রহমান পল্টুসহ আরও তিন সঙ্গী। এসেই পুকুরের চারপাশ ঘুরে বসার স্থান নির্ধারণ করেই সঙ্গীদের নিয়ে মাছ ধরার কার্যক্রম শুরু করেন। বড়শিসহ মাছ ধরার উপকরণ নিয়ে শুরু হয় মাছ ধরার তোড়জোড়। বড়শিও ফেলেন পল্টু। তবে মাছের দেখা মেলে না।

সাড়ে ৮টায় বড়শি ফেলে যখন মাছের দেখা নেই, তখন মন খারাপ হয়ে যায় সবার। নিজেদের মধ্যেই আলোচনা চলতে থাকে, পুকুরে বড় মাছ নেই। যদিও মোস্তাফিজ তখন বাড়িতে বসে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছিল, মাছের খবর কি? এ প্রান্ত থেকে জানানো হয়, বড়শিতে মাছ ধরছে না। খবর শুনে মন খারাপের হতে থাকে মোস্তাফিজসহ তার সঙ্গী-বন্ধুদেরও।

ওদিকে, মাছ উঠছে না, হচ্ছে না, আর এখানে বড় মাছ নেই- এসব দোটানার মধ্য দিয়েই সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গ্রামের বাড়ি তেঁতুলিয়া থেকে জাগোনিউজের প্রতিনিধির বাড়ি তালার শিবপুর গ্রামের রওনা দেন মোস্তাফিজ। গাড়িতে বসেই মাছের খবর রাখছিলেন তিনি। মাছের কি হল, মাছ ধরছে কি না! তখনও মাছের দেখা নেই। দু’একটি ছোট ছোট মাছ বড়শিতে তুলছে মোস্তাফিজের মেঝো ভাই মোকলেসুর রহমান পল্টু।

Advertisement

একদিকে পুকুরে চলছে মাছ ধরার আয়োজন অন্যদিকে বাড়ির মধ্যে চলছে তারকা ক্রিকেটার মোস্তাফিজসহ তার সঙ্গীদের জন্য আপ্যায়নের আয়োজন। এসব যখন চলছিল, তখন সেখানে কি হচ্ছে, কে আসছে- কৌতুহল বশতঃ এসব জানতেই এসএম নজরুল ইসলামের বাড়িতে জড়ো হতে থাকে এলাকার বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ।

মোস্তাফিজের মেঝো ভাই পল্টুকে দেখে অনেকেই ভুল ধারণা করে বসে। তাদের ধারণা, এটাই কি মোস্তাফিজ! পরবর্তীতে তাদের ভুল ভাঙ্গে এটা মোস্তাফিজের ভাই। তখনই প্রচার হতে শুরু করে মোস্তাফিজ হয়তো এখানে আসবে। তখনও কেউ জানতো না মোস্তাফিজ সত্যি সত্যিই আসছে ওখানে।

সকাল সাড়ে ৮টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকেও মাছের দেখা মিলল না। মোস্তাফিজ তখনও পথে। বেলা পৌনে ১২টার সময় একটি ৫-৬ কেজি ওজনের পাঙ্গাস যখন ধরা পড়ে পল্টুর বড়শিতে তখনই আনন্দ ফিরতে শুরু করে সবার মাঝে, মুখে ফুটে ওঠে এক চিলতে হাসি।

বেলা ১২টায় মোস্তাফিজ যখন শিবপুর গ্রামে আকরামুল ইসলামদের বাড়িতে পৌঁছান, তখন কয়েক ’শ মানুষ ততক্ষণে সেখানে জড়ো হয়ে গেছে। মোস্তাফিজ পৌঁছাতেই তাকে ঘিরে ধরে ভক্ত-সমর্থকরা। তবে সেখানে পৌঁছেই মোস্তাফিজ সোজা চলে যান পুকুর পাড়ে। চেয়ারে বসে এবার তিনি পানিতে বড়শি ফেললেন। ওঁৎ পেতে থাকেন মাছের আশায়। এক জায়গায় মাছ ধরছে না, তো আরেক জায়গায় নিয়ে বড়শি ফেললেন। যেন ক্রিকেট মাঠে রাউন্ড দ্য উইকেটে গিয়ে বোলিং করার মত। কাঙ্খিত উইকেটটির মত যদি এখানেও কাঙ্খিত মাছটি ধরা পড়ে!

কয়েক মিনিটের মধ্যেই মোস্তাফিজের বড়শিতেই টান পড়ে। টান দেখেই বোঝা হয়ে গেছে, বড় কোনো উইকেটই (পড়ুন, বড় মাছ) হয়তো পা দিয়ে ফেলেছে মোস্তাফিজের ফাঁদে। মোস্তাফিজেরও বুঝতে বাকি থাকে না, বড় মাছ আটকা পড়েছে তার বড়শিতে। ধীরে ধীরে বড়শি তুলতে শুরু করেন তিনি।

মাছটাকে একেবারে তীরে টেনে আনতেই নেট দিয়ে আটকানো হলো। পুকুর পাড়ে তুলে আনতেই সবার চোখ কপালে! সকাল থেকে যারা মাছ পাচ্ছি না বলে হা-হুতাশ করছিল, তারাও অবাক। ১-২ কেজি ওজনের নয়, রীতিমত ১২ কেজি ওজনের পাঙ্গাস পা দিয়েছে মোস্তাফিজের ফাঁদে। তার বড়শিতে আকটানো খাবার খেতে গিয়ে নিজেই আটকে গেলো মৎস মহাশয়। মুহূর্তেই আনন্দ ছড়িয়ে পড়লো সবার মাঝে। হই-হুল্লোড় করে উঠলো উপস্থিত জনতা।

মোস্তাফিজ যখন মাছ ধরায় ব্যস্ত, তখন এক কান, দুই কান করে তার আসার খবর ছড়িয়ে পড়লো পুরো গ্রামে। পাশেয়র কয়েক গ্রামেও। আর যায় কোথায়, এত কাছে প্রিয় তারকার উপস্থিতি। মানুষ তো আর ঘরে বসে থাকতে পারে না। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা ছুটে আসতে শুরু করে। প্রথমদিকে উপস্থিতি কয়েক ’শ মানুষ হলেও, অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই সেটা কয়েক হাজারে উন্নীত হয়। এসএম নজরুল ইসলামের বাড়িতে যেন আর তিল ধারণের ঠাঁই থাকে না। মানুষে মানুষে গিজগিজ করতে শুরু করে, মোস্তাফিজকে এক নজর দেখার আশায়। সম্ভব হলে একটি সেলফি তোলার আশায়।

এরই মধ্যে কেউবা মোস্তাফিজকে জড়িয়ে ধরে, কেউবা সেলফি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ভক্তদের আবদার মেটাতে গিয়ে মোস্তাফিজ আর মাছ ধরারই সুযোগ পাননি। এত বেশি ভক্তের উপস্থিতি বিপাকেই ফেলে দেয় তাকে। ফলে, উপায়ন্তর না দেখে বাড়ির ভেতর চলে যেতে বাধ্য হন তিনি। মানুষের কৌতুহল তাতেও থামে না। ঘরের চারপাশ ঘিরে ফেলে তারা। এপাশ দিয়ে-ওপাশ দিয়ে উঁকি মারতে থাকে, এক নজর দেখার আশায়।

মোস্তাফিজ তখন সবার উদ্দেশ্যে বলতে থাকেন, ‘আপনাদের সবার সঙ্গেই ছবি তুলবো। কেউ ব্যস্ত হবেন না। শান্ত থাকুন। তবুও সমর্থকরা শান্ত হয়নি। কে আগে ছবি আর সেলফি তুলতে পারে সে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন তারা। একটা সময়ে ভক্তদের চাপে মোস্তাফিজ তখন বাড়ির দ্বিতীয় তলায় উঠে পড়তে বাধ্য হন। সেখানে একে একে ছবি তুলবেন বলে জানান।

তবে সেখানেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। এরই মধ্যে তালা থানার সেকেন্ড অফিসার সেকেন্দার আলীর নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল হাজির হয়ে যায়। তারা আসার পর পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রনে আসে। কিন্তু কথায় আছে না- যে যায় লঙ্কায়, সে হয় রাবন! এত কাছে এত বড় তারকা। পুলিশও বাদ গেলো না ছবি তোলা কিংবা সেলফি তুলতে।

অন্যদিকে, মোস্তাফিজের মেঝো ভাই মোকলেছুর রহমান পল্টুসহ তার সঙ্গীরা তখনও পুকুরে মাছ ধরতে ব্যস্ত। মোস্তাফিজ ১২ কেজি ওজনের একটি পাঙ্গাস ধরে যেন ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। এরপর তার ভাই এবং বন্ধুদের বড়শিতে একে একে ৭টি পাঙ্গাস ও একটি বড় রুই মাছ ধরা পড়ে।

পুলিশের উপস্থিতিতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার পর মোস্তাফিজ ব্যস্ত হয়ে পড়ে ভক্তদের সঙ্গে গল্প আর আড্ডায়। যদিও আমন্ত্রণটা ছিল পারিবারিক। কিন্তু ভক্তদেরও হতাশ করলেন না তিনি।

আকরামুল ইসলামের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে জাগোনিউজের পক্ষ থেকে মোস্তাফিজকে ফুলেল শুভেচ্ছা এবং তার হাতে সংবর্ধনা ক্রেট তুলে দেয়া হয়। মোস্তাফিজকে শুভেচ্ছা জানাতে ছুটে আসেন তালা উপজেলা নির্বাহী অফিসার ইকবাল হোসেন। তালা ক্রীড়া সংস্থার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানান, জেলা পরিষদের সদস্য মীর জাকির হোসেন, তালার ক্রীড়াবিদ হাবিবুর রহমান হাবিব, শ্যামনগর উপজেলার নকিপুর খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা আমিনুর রহমান বুলবুল।

দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয় বাড়ির দ্বিতীয় তলায়। মোস্তাফিজ এবং তার সঙ্গীরা যখন মধ্যাহ্নভোজে ব্যস্ত, তখনও নিচে কয়েক হাজার ভক্ত-সমর্থকের উপস্থিতি। তারা চিৎকার করে ডাকতে শুরু করেন, ‘মোস্তাফিজ ভাই নিচে আসেন।’ দ্রুত খাওয়া শেষ করতে করতে মোস্তাফিজ বলতে থাকেন, ‘আসছি। আপনারা থাকেন। সবার সঙ্গেই ছবি তুলবো।’

খাওয়া শেষেই মোস্তাফিজ চলে গেলেন ভক্তদের মাঝে। সবার সঙ্গে ছবি ও সেলফি তুললেন তিনি। প্রিয় তারকাকে এত কাছ থেকে দেখা, ছবি তোলা, সেলফি তোলা কিংবা ভিডিও করতে পেরে দারুণ খুশি ভক্ত-সমর্থকরা। সবাই পঞ্চমুখ মোস্তাফিজের প্রশংসায়।

এভাবেই কেটে গেলো পুরো একটি বেলা। দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছিল প্রায়। অবশেষে স্মরণীয় একটি দিন, অসাধারণ কিছু স্মৃতি পেছনে ফেলে বিকাল ৫টার দিকে তালার শিবপুর গ্রামের আকরামুল ইসলামের বাড়ি থেকে নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন মোস্তাফিজ। যাওয়ার সময় নিজের ও তার পরিবারের জন্য সবার কাছে দোয়া চাইলেন তিনি। তখনও রাস্তার দু’ধারে ছিল মোস্তাফিজের ভক্ত-সমর্থকদের ভিড়।

তালা সদরের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রেসক্লাব সভাপতি এস এম নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বর্তমানে ঢাকায় রয়েছি। অনেকটা স্বপ্নের মত আমার বাড়িতে এসেছে মোস্তাফিজ। সবার সঙ্গে মিশে আনন্দঘন সময় পার করেছে সে। আমি ও আমার পরিবার মোস্তাফিজ, তার ভাই পল্টু, বন্ধু হাফিজসহ তার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞ। বাড়িতে না থাকায় এই আনন্দঘন মুহূর্তগুলো আমি মিস করেছি।’

জাগো নিউজের সাতক্ষীরা প্রতিনিধি আকরামুল ইসলাম বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই মোস্তাফিজকে আমাদের বাড়িতে নেওয়ার ইচ্ছা ও আগ্রহ ছিল। বিভিন্ন সময় সংবাদের জন্য তার বাড়িতে ছুটে গেছি। মোস্তাফিজের পরিবারের সবাই আন্তরিক মানুষ। যে কারণে অনেকবার আমন্ত্রণ জানানোর সুযোগ পেয়েছি; কিন্তু সময় হয়ে উঠেনি। এবার ছুটিতে বাড়িতে এসে আমাদের বাড়িতে আসলেন। পুকুরে মাছ ধরলেন। এলাকাবাসী ও ভক্তদের সঙ্গে হৈ হুল্লোড় করে সময় কাটালেন। এটা আমাদের জন্য ছিল স্মরণীয় একটি দিন।’

আইএইচএস/এমকেএইচ