নিজ দেশের সাথে অন্য দেশের তুলনা করতে কখন বুকে কাটা বিঁধে? নিঃসন্দেহে যখন দেশ অন্যদের চাইতে পিছিয়ে পড়তে থাকে। আর কখন ভালো লাগে? আবেগ অনুভূতিতে কখন মথিত হয় মন? নিঃসন্দেহে যখন উন্নতির অগ্রাভিযানে নিজের দেশ অন্য দেশ থেকে অগ্রসর হতে থাকে। জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ কিংবা ‘ এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,/ সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি’ গানগুলি গেয়ে আমরা আবেগে আপ্লুত হই এই কারণে যে, দেশ হবে মহামূল্যবান সোনার মতো কিংবা বিশ্বের সব দেশের মধ্যে রানী বলে।
Advertisement
বিশ্ব পরিমণ্ডলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো ও শ্রেষ্ঠত্বের গরিমার আপ্লুত হতে চায় দেশবাসী। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে দেশবাসী ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়তে পেরেছিল, এমন আকাঙ্খা ছিল বলেই। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, দেশকে যখন বলা হয় ‘ বটমলেস বাস্কেট’ বা ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বা ‘সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’, তখন দেশবাসী থাকে হতাশাগ্রস্থ ও উদ্যমহীন এবং জাতিসত্তা তথা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হয়ে পড়ে বিভক্ত ও বিধ্বস্ত। আর উন্নতি ও অগ্রগতির ধারায় যতই পড়তে থাকে, জাতিসত্তা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ততই সুদৃঢ় হতে থাকে।
প্রসঙ্গত আমাদের মতো দেশগুলো এক সময় তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে সুপরিচিত ছিল। কেননা ঠাণ্ডাযুদ্ধ যুগে (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন পর্যন্ত) বিশ্ব ছিল তিনভাগে বিভক্ত- আমেরিকার নেতৃত্বে ধনতান্ত্রিক বিশ্ব, সোভিয়েত রশিয়ার নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব এবং উন্নয়নশীল দেশগুলো নিয়ে তৃতীয় বিশ্ব। এখন এই ধরনের ভাগাভাগি নেই। এখন উন্নত দেশ, উন্নয়নশীল দেশ, স্বল্পোন্নত দেশ কিংবা উচ্চ আয়ের দেশ, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ, মধ্যম আয়ের দেশ, নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশ, নিন্ম আয়ের দেশ হিসেবে দেশগুলোকে চিহ্নিত করা হয়।
এখানে উল্লেখ্য যে, সার্বিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অব্যাহত উচ্চহারে প্রবৃদ্ধির স্বীকৃতি স্বরূপ আমাদের দেশকে বিশ্বব্যাংক ২০১৬ সালে নিন্ম মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০১৮ সালে জাতিসংঘ নিন্ম আয়ের দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দিয়েছে। এই সাথে মাথা পিছু আয় আমাদের বাড়ছে এবং গরীবী কমছে। জাতির পিতার জন্মশত বার্ষিকী ও স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী অনুষ্ঠান পালনকালে অর্থাৎ ২০২১ সালে আমাদের লক্ষ্য হলো মধ্যম অয়ের দেশ , ২০৩০ সালে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালে উন্নত দেশ হিসেবে দারিদ্র নির্মূল করে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো।
Advertisement
যদিও দেখা যায়, বর্তমানের ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ও অস্থিতিশীল বিশ্বে আমাদের মতো দেশগুলোর তুলনায় আমরা দ্রুত সেই পথ ধরে অগ্রসর হচ্ছি, তবে নানা দিক থেকে সমস্যা সীমাবদ্ধতা থাকলেও উল্লিখিত দুই অনুষ্ঠান পালনের সামনে দাঁড়িয়ে জাতীয় গর্বের বিষয়টা আমাদের সামনে আনতেই হবে। কিন্তু আমরা সবাই কি সেই গর্ব অনুভব করছি? জাতির এই অগ্রযাত্রায় যদি আমরা জাতি হিসাবে সকলে আন্দোলিত হতে না পারি, তবে কি ইপ্সিত লক্ষাভিমুখে অগ্রসর হওয়ার পথকে কণ্টকমুক্ত করতে পারবো? একথায় বোধকরি সকলেই একমত হবেন যে, প্রথমত অর্থনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, অবৈধ ব্যবসা, কালো টাকা ইত্যাদি যদি নিয়ন্ত্রিত করা যায়; দ্বিতীয়ত পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রসহ মেগা প্রজেক্টগুলো যদি বাস্তবায়িত হয়, তবে আমাদের অর্থনীতিতে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়ে যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটবে। এই লক্ষেই কিন্তু শাসক দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘ জিরো টলারেন্স’ ও মেগা প্রজেক্ট শেষ ও নতুন গ্রহণ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ উদ্যোগে ‘ জিরো টলারেন্স’ নীতি কার্যকর হচ্ছে।
তিনি বলেছেন, ‘ছাত্রলীগ ধরেছি। যুব লীগ ধরা হবে। একে একে সব ধরা হবে।’ বাস্তবেই এক ধাক্কায় সব হওয়া সম্ভব না। অন্ধকার ও অবৈধ সব জঞ্জাল সরানো হচ্ছে উন্নয়নর অগ্রগতির লক্ষ্যে ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। আশার কথা, কাজ ধাপে ধাপে অগ্রসর হচ্ছে। এদিকে লক্ষ্য করার যাচ্ছে, মেগা প্রজেক্টগুলোর কাজ সময়মতো সব না হলেও এগিয়ে চলছে। অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেছেন, বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। তাই টাকার নয়ছয় হতেই পারে। বাস্তবে কখন মানুষ অকাট্য সত্যের মুখোমুখি হতে বা আত্মসমালোচনা করতে পারে? যখন কাজেরইতিবাচক ফলাফলে প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হয়।
সীমাবদ্ধতা- দুর্বলতা চিহ্নিত ও সংশোধিত হওয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত রে সঠিক ধারায় অর্থনীতি চলছে বলেই সেই আত্মবিশ্বাস এখন ক্রমে জাগ্রত হচ্ছে। যখন জিরো টলারেন্স নীতি কার্যকর হচ্ছে কিংবা মেগা প্রজেক্ট কার্যকর হয়ে অবকাঠামো উন্নয়নমুখী হচ্ছে, মানুষের গড় আয় ও আয়ু বাড়ছে এবং গরীবী কমছে; তখন এই আত্মবিশ্বাসটাকেই জাগ্রত করতে হবে। প্রসঙ্গত বলতেই হয়, সমাজের উচ্চস্তরে রাজনীতির পাল্টাপাল্টি ও টানাটানির জন্য এটা করা বেশ কঠিন। তাই কবি সুভাষ মুখোপধ্যায়ের ছন্দে বলতে হয়, আত্মবিশ্বাসটাকে ‘ খুঁচিয়ে গন গন করে তোলো। উঁচু থেকে যদি না হয় নিচু থেকে কর।’
এটা কার না জান যে, অর্থনীতিকে যদি ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হয় তবে যেমন সুষ্ঠু যথাযথ ও যুগোপযোগী পরিকল্পনার প্রয়োজন হয়, তেমনি উপযোগী রাজনৈতিক ব্যবস্থাও আবশ্যক। এই বিচারে রাজনীতি ও অর্থনীতি পরস্পর পরিপূরক। রাজনীতি অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয় আবার অর্থনীতি রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। জাতিসংঘ , বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন অর্থনৈতিক মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি আরো জোর দিয়ে বলেছে, প্রবৃদ্ধি ও মানব উন্নয়ন সূচকে ধারাবাহিক অগ্রগতির কারণে বাংলাদেশ ‘উন্নয়নের বিস্ময়’। বলা হচ্ছে, ‘দেশে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ থাকার কারণে আর্থিক চ্যালেঞ্জের মধ্যেও জোরালো প্রবৃদ্ধি ও বিপুল উন্নয়ন চাহিদার কল্যাণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আগের মতোই গতিশীল থাকবে।’
Advertisement
বাস্তব পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণে এটা দৃঢ়ভাবে মনে হবে যে, বিশেষত এশিয়ার অন্যান্য দেশের চাইতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে ভারসাম্যমূলক বৈদেশিক সুসম্পর্ক থাকায় প্রায় একযুগ ধরে স্থিতিশীল অবস্থা বাজায় রয়েছে। ফলে সুদীর্ঘ সময়‘উন্নয়নের বিস্ময়’ হিসেবে বাংলাদেশের পক্ষে থাকা সম্ভবপর হচ্ছে। আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করার জন্যই উল্লিখিত দুটো কারণ নিয়ে সংক্ষেপে এশিয়ার অন্যান্য দেশ সম্পর্কে একটু আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে। যদি কোনো কোনো দেশের সাথে আমাদের অর্থনীতির আয়তন আর সেই সাথে উন্নতিতে রয়েছে বিশাল পার্থক্য।
রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে যতই বিতর্ক থাকুক না কেন, চীন হচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় অর্থনৈতিক শক্তি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকেও চীন ছিল ভারতের চাইতেও পিছিয়ে। একদলীয় এককেন্দ্রিক শাসন তথা বাক ব্যক্তি সংবাদপত্র দল সমাবেশ করার স্বাধীনতা না থাকা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ঘোষিত নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করা হচ্ছে চীনের বৈশিষ্ট্য। এটাই চীনকে আজ এমন অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত করেছে বলে ধারণা রয়েছে। কিছু দিন আগেও চীন ছিল প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির দিক থেকে সবার থেকে এগিয়ে, ১৯৮৪ সালে ঐতিহাসিক উচ্চতায় প্রবৃদ্ধি শতকরা ১৫.২ ভাগে পৌঁছেছিল। বর্তমান বছরগুলোতে তা ক্রমাগত নিচে নামছে। উল্লিখিত দুই কারণেই অর্থনীতির গতি সঞ্চারিত হয়েছিল। কিন্তু চীন বর্তমানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আন্তর্জতিক অঙ্গনে ভারসাম্য ধরে রাখতে সক্ষম হচ্ছেনা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আগে পরে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চীনের দহরমমহরম সম্পর্ক ছিল, এখন তা বাণিজ্যযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে। শুল্ক আরোপ হচ্ছে এর হাতিয়ার।
প্রসঙ্গত বিশ্বের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ২০১৮ সালে ৩.৯ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে কমে গিয়ে ৩.৭ শতাংশ হবে। বাণিজ্য নিয়ে অশ্চিশ্চয়তা, বৈশ্বিক অর্থনীতিক ব্যবস্থায় ঝুঁকির নাজুকতা, শেয়ার বিপর্যয় ও যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর মুদ্রানীতি বিভিন্ন দেশের সমষ্টিক অর্থনীতিকে অস্থির করে তুলছে। ইতোমধ্যে ২০১৫ থেকে ৮ বার সুদ হার বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক। ফলে বিভিন্ন মুদ্রার বিপরীতে ডলার শক্তিশালী হয়েছে। এতে চীনের মুদ্রা ইউয়ানের দাম কয়েক দিনের মধ্যে কমেছে ৯ শতাংশ।
এমন চলতে থাকলে আরো দাম হারাবে ইউয়ান। এতে বিশ্ববাজারে চীনা পণ্যের দাম বাড়বে এবং অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এই অবস্থায় চীন থেকে পুঁজি পাচার বড় এক সমস্যা। বিভিন্ন দেশে বড় বড় প্রজেক্ট থেকে ব্যয় আনুযায়ী আয় অর্জিত হচ্ছে না। চীনের প্রবৃদ্ধি ২০১৮ সালে হবে ৬.৬ এবং পরের বছর ৬.২ হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এদিকে চীন রাজনৈতিক সমস্যাগুলোরও সমাধান করতে পারছে না। হংকংকে চীন হজম করতে সক্ষম হচ্ছে না। চীনের স্বাধীনতার ৭০ বছর পূর্তি উৎসবকে সামনে রেখে গণআন্দোলন তুঙ্গে উঠলে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। উইঘোর নিয়ে আছে চীন চরম বিপাকে। স্বাধীন মত প্রকাশের বিন্দুমাত্র অবকাশ যে নেই তা বিগ দিনগুলোর দমনপীড়ন প্রমাণ করেছে। সন্ত্রাসের সমর্থক পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ভারত এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সাথে সীমান্তসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে উত্তেজনা লেগেই রয়েছে।
এদিকে ভারতও পড়েছে নানামুখী সংকটে। কাশ্মির, গরুসহ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, এনআরসি প্রভৃতি নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে অস্থির এক রাজনৈতিক অবস্থা বিরাজ করছে। এদিকে রয়েছে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধের বিপদ, সাথে আছে চীন। অন্যদিকে অর্থনীতিতে মন্দা পরিলক্ষিত হচ্ছে। বলাই বাহুল্য যদি বাড়ে অর্থনৈতিক মন্দা, তবে তা রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরো বাড়িয়ে দিবে। আর পাকিস্তান! ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বজুড়ে পরিভ্রমণ করতে হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য সেখানে গাগলা ঘোড়ার মতো অস্থির।
সম্প্রতি ইমরান খান তুরস্কের কাছে ১ হাজার ২২ কোটি ডলার ঋণ মওকুফ ভিক্ষা চেয়েছে। দেশটির জিডিপি বৃদ্ধির শতকরা হারের দিক থেকে আছে ৪৪ নম্বরে। এই অবস্থায়ও ভারতের সাথে পারমাণবিক যুদ্ধের হুমকি দেওয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নামে গণতন্ত্র হলেও কামে সামরিক কর্তারা আছে ক্ষমতায়। দেশটি এক থাকবে নাকি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হবে, এই প্রশ্নের মুখোমুখি দেশটি ।
শ্রীলংকা এক সময় ছিল উপমহাদেশের দেশগুলোর চাইতে এগিয়ে। তামিল সমস্যা নিয়ে গৃহযুদ্ধ দেশটিরকে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দুই সংকটিই ফেলেছিল। সেই ফাঁড়া কাটিয়ে দেশটি যখন আবার উঠে দাঁড়াচ্ছিল, তখন উগ্র জঙ্গি হামলা পরিস্থিতিকে অস্থির করে তুলছে। দেশটিতে শতকরা ১০ ভাগ মুসলিম। এখন সেখানে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির দিক থেকে দেশটির অবস্থান ৬৬তম। হিমালয় অটল থাকলেও নেপালের রাজনীতি অস্থির। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারসাম্য বাজায় রাখতে হিমশিম খাচ্ছে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে রয়েছে ১০১ নম্বরে। মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের কথা আমাদের সকলেই জানা। এক সময়ে অর্থনীতিতে ‘এশিয়ান বাঘ’ হিসাবে স্বীকৃত পাঁচ দেশ সিংগাপুর, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং- এর তর্জন-গর্জন ১৯৯৭ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর এখন অনেকটাই স্তিমিত।
‘ প্রথম বিশ্বের দেশ হিসেবে সিঙ্গাপুর অবস্থান ধরে রাখলেও জুলাই ‘১৯ এক রিপোর্টে দেখলাম অর্থনীতিতে ধীরগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং এপ্রিল-জুন সময়কালে পূর্ববর্তী তিন মাসের তুলনায় জিডিপি শতকরা ৩.৪ ভাগে নেমে এসেছে। থাইল্যান্ডের জুন মাসের এক রিপোর্টের হেডিং হচ্ছে, ‘নো এন্ড ইন সাইট ফর থাইল্যান্ডস টার্বুলেন্ট পলেটিক্স’ অর্থাৎ রাজতৈনিক অস্থিরতা সেখানে বিরাজমান। জিডিপি ৩/৪ এর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। , যেখানে ২০১২ সালে তা ১৫.৫০-এ পৌঁছেছিল। হংকং-এর অস্থিরতার কথা সবার জানা। ক্ষুদ্র এ কলামে অন্য দুটি দেশ সম্পর্কে আর সেই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করা হচ্ছে না। তবে বলতেই হয়, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভিয়েতনাম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভারসাম্য বজায় রেখে জিডিপি ধারাবাহিকভাবে ৬/৭-এর মধ্যে রাখতে পারছে।
এই অবস্থায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের তর্জন গর্জন বিশেষভাবে এশিয়ার অর্থনৈতিক অঙ্গনে ক্রমেই বাড়ছে। জিডিপির আকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ বৃহৎ অর্থনীতির দেশের তালিকায় ৪১তম অবস্থানে উঠে এসেছে। পূর্বাভাষে বলা হচ্ছে,২০২৩ সালে ৩৬ তম, ২০২৮ সালে ২৭তম এবং ২০৩৩ সালে ২৪তম অর্থাৎ ২০১৮ থেকে ২০৩৩ সালে দেশটির ১৯ধাপ অগ্রগতি হবে। বাংলাদেশ নিয়ে এইসব যখন অনুমিত; তখন বিশ্ব অর্থনীতিতে কালো মেঘের আভাস, বিশ্ব মহামন্দার দ্বারপ্রান্তে, ১৯৯৭ সালের মতো আবারও এশিয়ান ক্রাইসিস আসছে ইত্যাদি ভবিষ্যদ্বাণী করা হচ্ছে।
এই অবস্থায় বিবেচ্য বিষয় হলো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের দেশ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী কিংবা বিগত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শতকরা ১০ভাগ জিডিপি বৃদ্ধি অর্জন করার যে লক্ষ্য জাতি সামনে রেখেছে, তা কামিয়াব হবে কি না? কলামটা লেখার বিষয়ে যখন চিন্তা করছি তখন খবর পাওয়া গেল, বিশ্বব্যাংকের সহজে ব্যবসা করার সূচক বা ‘ইজি ডুইং বিজনেস’-এর উন্নতির তালিকায় ২০টি দেশের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ। অন্যান্য সব সূচকও রয়েছে অগ্রগতির মধ্যে। তবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে বেকারী ও বৈষম্য। ব্যবসা কৃষি শিল্প সবকিছুতে যদি একচেটিয়াদের প্রাধান্য থাকে তবে বৈষম্য কেবল বাড়া নয়, কখনও কখনও তা বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। যেমন বর্তমানে পেঁয়াজের বাজার হয়ে উঠেছে গাগলা ঘোড়ার মতো।
সুবিধাবাদী অর্থবানেরা একদিকে সরকারকে চাপে ফেলে অর্থনৈতিক সুযোগ সুবিধা আদায় করে নিচ্ছে আর অন্যদিকে যখন তখন সুযোগ বুঝে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছে বা ইতোমধ্যে বেতন বাড়লেও ‘ঘাম শুকানোর আগে’ শ্রমজীবীদের ন্যায্য মজুরি দিচ্ছে না। ‘দুখি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই ছিল আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম লক্ষ্য। কালো অর্থনীতি দমনের সাথে সাথে এ ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করা সময়ের দাবি। আর অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতি অব্যাহত থাকলে কর্মসংস্থানও বাড়বে। এসব ক্ষেত্রে উদ্যোগ নিয়ে সরকারী ব্যবস্থাকে আরো জোরদার করার প্রয়োজন রয়েছে। দেশ ও জনগণের স্বার্থে সচেতনতা ও সমাবেশও একান্ত প্রয়োজন এবং তা করতে রাজনৈতিক ফায়দা উদ্দেশ্যে নয়। একই সাথে অর্থনীতির সাথে রাজনীতিকে অগ্রসর করার জন্য আমাদের জাতীয় পছন্দ সংসদীয় গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠানিক রূপ প্রদানের লক্ষ্যে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে যথাযথ করার দরকার। বলাই বাহুল্য সম্ভাবনা যত বাড়ে, সমস্যা তত সামনে আসে, চ্যালেঞ্জ তত বড় হয়। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের শুরু করা তর্জন গর্জন যথাসম্ভব সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেওয়ার চ্যলেঞ্জ এখন মোকাবিলা করা ভিন্ন কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট।
এইচআর/এমকেএইচ