দুর্নীতির বিরুদ্ধে তিনি জেহাদ ঘোষণা করেননি। তবে সর্তক বার্তা দিয়েছেন বার বার। উচ্চারণ করেছেন হুশিয়ারি।‘ দুর্নীতি করলে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই কথাটাকে অ্যাদ্দিন কথার কথা মনে করেছেন। রাজনৈতিক বক্তব্য বলে উড়িয়ে দিতে চেয়েছেন। অবশ্য তাদের দোষ দেয়া যায় না। কারণ, এই দেশে উর্দি পরে ক্ষমতায় এসে কতলোক কত রাজনৈতিক গিমিগ তৈরি করেছেন। আবার কতলোক উর্দি ছাড়া সংবিধানের দোহাই দিয়ে একটা ভজঘট সরকার গড়ে দুর্নীতির মূল উৎপাটনের কথা বলেছেন। দুর্নীতিবাজ হিসেবে অনেক লোককে জেলে পুরেছেন। বছর দুয়েক পার হতে না হতেই আবার যা তাই! যে কারণে সাধারণ মানুষের বিশ্বাসের মূলে ধাক্কা লাগে, আদৌ বাংলাদেশে দুর্নীতিবাজদের আইনের আওয়াতায় আনার সদিচ্ছা কী আরও আছে!
Advertisement
কিন্তু গেল এক সপ্তাহে যা দৃশ্যমান তাতে জনমানসে খানিকটা স্বস্তি এসেছে। তারা ফিরে পাচ্ছে তাদের বিশ্বাস। দুর্নীতি করে অবৈধ সম্পাদের পাহাড় গড়ে কিংবা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চাাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি কিংবা মানিলন্ডারিং করে এবার মনে হয় কেউ ছাড় পাবেন না। আপাত দৃষ্টিতে সেটা মনে করার অনেক কারণ আছে। সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সৌজন্যে। কারণ, তিনি দুর্নীতিবাজ, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে নিজের কঠোর মনোভাবের জানান দিয়েছেন। অ্যাকশান নিতে শুরু করেছেন। আর সেটা নিজের দলের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে।
বাহাত্তর পেরিয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী যেদিন তিয়াত্তরে পা রাখলেন সেদিন রাজধানী থেকে প্রত্যন্ত জনপদের মানুষের মনে অন্যরকম এক উচ্ছ্বাস। স্বস্তি আর আনন্দে প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে সাধারণ, মানুষ বলছেন; ‘এবার যদি কিছু হয়।’ আর এই কিছু মানে হাইব্রিড, নব্য আওয়ামী লীগারদের দৌরাত্ম্য, দাপাদাপি আর দাপট থেকে মুক্তি। মানুষ বিশ্বাস করছে এবার এত সহজে ছাড় দেবেন না শেখ হাসিনা। নিজের দলকে আর সুসংহত করতে, দলীয় ভিতকে শক্তিশালী করতে এই সব চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজদের দরকার নেই আওয়ামী লীগে। পেছনের দুর্দিন আর বৈরি সময়ের স্রোত ঠেলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনা, দেশকে তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর উন্নত দেশের দিকে নিয়ে যাওয়া, সবইতো একজনের সৌজন্যে। তিনি দলীয় প্রধান জননেত্রী শেখ হাসিনা। তাহলে এই ‘কাউয়া’-দের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে ‘মুজিব কোট’ পরার সুযোগ দেয়ার দরকার কী? আওয়ামী লীগ নামক দলটার নাম ব্যবহার করার সুযোগ পাবে কেন তারা?
এই স্বস্তির পাশাপাশি একটা শঙ্কাও থাকছে। এই সব লোককে বের করে এনে দুর্নীতিবাজ নন এই সার্টিফিকেট দেয়ার জন্য দলের ভেতরে কেউ কেউ ছকবাজিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন না তো! আত্মীয়তার সূত্র ধরে, অর্থের জোগান পেয়ে অনেক নেতা তৎপর হতেই পারেন। কারণ, কারো কারো তৎপরতা না থাকলে ফ্রিডম পার্টিও কুড়াল নিয়ে যারা আওয়ামী লীগ আর শেখ হাসিনাকে শেষ করতে চেয়েছিলেন এক সময় তাদের আশ্রয় আওয়ামী লীগে কীভাবে হয়? যারা একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামাল ঘটিয়ে গোটা আওয়ামী লীগকে নেতাশূন্য করে নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিলেন, সেই বিএনপি নেত্রীর ‘বডিগার্ড’ থেকে আওয়ামী লীগ এমপির বন্ধু হয়ে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন কীভাবে এরা!
Advertisement
বঙ্গবন্ধু যে দেশে মদ-জুয়া বন্ধ করেছিলেন, সেই দেশে মদ আর ক্যাসিনা চালিয়ে এরা কোটি কোটি টাকা পেলেন কীভাবে? বঙ্গবন্ধুর ছবি জাতীয় সংসদ থেকে নামিয়ে পা মাড়িয়েছিলেন যিনি, তিনি কীভাবে গণভবনে বঙ্গবন্ধু কন্যার সাথে দেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন? প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাদের ছবি তোলার সুযোগ পেয়েছিলেন! তাই শঙ্কা একটা থেকে যায়। প্রধানমন্ত্রীকে আবার না কেউ বলতে না শুরু করেন; আপনি হচ্ছেন উদার। আওয়ামী লীগ হচ্ছে উদারপন্থী দল। এই ভীষণ উদারপন্থীরা আবার প্রধানমন্ত্রীর এই কঠোর সিদ্ধান্তকে ‘রাজনৈতিক’ গিমিক তৈরি না করেন তাদের অতিকথন দিয়ে!
দলে সংস্কার করে আওয়ামী লীগ থেকে শেখ হাসিনাকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন অনেকে। তারা ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু সেই সংস্কারপন্থী মুখের চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু লোকের অনুপ্রেবশ ঘটানো হয়েছে আওয়ামী লীগে। যারা শেখ হাসিনার নাম বিক্রি করেই দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র অনেক চেতনার মূলে আঘাত করেছেন মুখোশ পরে। দেশের মানুষের কাছে তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন, দল আর নেত্রীর জন্য তারা শহীদ হয়ে যেতে পারেন! কিন্তু বোধবুদ্ধিতে এদেশের মানুষের এতোটা ঘাটতি পড়েনি, যে তারা বুঝতে পারবে না এরা কী করছে, আর কী করতে চায়। তাই গণতন্ত্র, উন্নয়ন এর বাজনা বাজানোর পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ডাণ্ডাবাজি এখন সময়ের দাবি। সেটা দল থেকেই শুরু করেছেন শেখ হাসিনা। অব্যাহত রাখাটাই এখন জরুরি।
শেখ হাসিনা যখন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছেন, তখন অনেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরাতে চাইছেন। বলছেন’ ক্ষমতাসীনার আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত! কিন্তু যে সব দুর্নীতিবাজদের ধরা হচ্ছে, তাদের ঠিকুজি দেখলে দেখা যাচ্ছে এরা এক সময় বিএনপিসহ অন্যান্য দলে দাপটের সাথে দুর্নীতি করে এসেছেন। বিএনপি তাদের বিরুদ্ধে আদৌ কী কোন ব্যবস্থা নিয়েছিল? যদি তাই হতো তাহলে তারেক রহমানকে মতিঝিলের ক্লাব পাড়া থেকে ঘোড়ার গাড়িতে চড়িয়ে যারা মোহামেডান ক্লাবের মত ঐতিহ্যবাহী ক্লাবকে গিলে খেয়েছেন, তারা আওয়ামী লীগের সময় আওয়ামী লীগারদের বন্ধু হয়ে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করার সুযোগ এবং সাহস কোনটাই পেতেন না। তাই প্রধানমন্ত্রীর একটা ভাল উদ্যোগকে অন্তত ভাল বলার সৎসাহস দেখালে তাতে জনগণের হারানো আস্থা তারাও কিছুটা ফিরে পেতে পারেন।
শেখ হাসিনা এবার নিজেই সংস্কারক। তার সংস্কার সাধনের রাস্তায় কেউ বাধা হয়ে দাঁড়াতে গেলে তারা নিজেরাই দল, রাজনীতির রাস্তা থেকে হড়কে যেতে পারেন। এটাও প্রমাণ করার দায়িত্ব শেখ হাসিনার। কারণ, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যামা অনেক অ-নে-ক গুণ বেড়ে গেছে। তার কাছে মানুষের চাওয়া এমন ঊর্ধ্বে থাকবেন না। আর সাধারণ মানুষের বিচার পাওয়ার দায়িত্ব রাষ্ট্রই নেবে। তার প্রথম পদক্ষেপটা আমরা দেখছি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে যেতে হবে আরও লম্বা পথ।
Advertisement
লেখক: এডিটর দীপ্ত টিভি। সিনিয়র জার্নালিস্ট ও কলামিস্ট।
এইচআর/পিআর