রাজনৈতিক নেতাদের জন্মদিন এখন সরবে পালিত হয়, আগে তা দেখা যেতো না। পরিবারের সদস্য, দলীয় সমর্থক সবাই মিলে নেতা বা নেত্রীর জন্মদিনে বেশ ঘনঘটা দেখা যায়। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার আজ জন্মদিন। ১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় তার জন্ম।
Advertisement
ঠিক জন্মদিনের লেখা এটি নয়। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে এসেছে। শেখ হাসিনা এ মুহূর্তে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অতীতের কথা উঠে আসে। উঠে আসে তার পিতা, বাঙালির জনকের কথা। বাংলার সমাজে সৌহার্দ্য আর সহমর্মিতার পাশাপাশি সংঘাতের ইতিহাসও দীর্ঘ। আমাদের বিভাজনের রাজনীতি আছে, আমাদের জাতীয়তাবাদের মধ্যে সঙ্কীর্ণ আঞ্চলিকতা, জাতিভেদ ও ক্ষমতার দ্বন্দ্ব আছে। তবুও বহুত্ববাদের ভিতরকার অভ্যন্তরীণ সংঘাতকে সরিয়ে সংহতি ও সমন্বয়ের এক বৃহৎ চিত্র এই সমাজে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু। আজ তার কন্যার হাতে জাতির নেতৃত্ব।
শেখ হাসিনা তার এক লেখায় বলেছেন, ‘পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। আমি এই আদর্শ নিয়ে জনগণের সেবক হিসেবে রাজনীতি করে যাচ্ছি’। এবং তিনি বলেছেন, তার চলার পথটি বরাবরই বন্ধুর। দেশকে মুক্তিযুদ্ধের ধারায় ফিরিয়ে আনতে তাকে ক্ষমতায় আসতে হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। কিন্তু পরবর্তী নির্বাচনে দেশকে আরো বেশি করে জাপটে ধরলো পাকিস্তানপ্রেমিরা, যেমনটা ঘটেছিল ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে। তারপর ২০০৮ এর নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এদেশের মানুষকে সাথে নিয়ে শেখ হাসিনার ক্রমাগত লড়াই। এই লড়াই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের, উদার আর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার। কিন্তু লড়াই আর স্বপ্নতো আরো থাকে, যে স্বপ্ন ছিল জাতির জনকেরও- বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়া যেন আত্মনির্ভর এক জাতির পরিচয় দিতে পারি আমরা।
তার শাসনামলে গত ১০ বছরের বেশি সময়ে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির স্থিতিশীলতা এসেছে, মানুষের মনে একটা উন্নয়ন স্পৃহা তৈরি হয়েছে। ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধিতে হতদরিদ্র কমেছে, দেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের স্বীকৃতি নিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হওয়ার পথে চলতে শুরু করেছে। মানুষের অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা। কিন্তু এ মুহূর্তে সবচেয়ে অনিরাপদ শেখ হাসিনা নিজে। যারা বাংলাদেশকে পেছনে দেখতে চায়, সাম্প্রদায়িক দেখতে চায়, জঙ্গি দেখতে চায় তারা সবাই একজোট তাকে হত্যা করতে চায়। কারণ শেখ হাসিনা মানে যুদ্ধাপরাধের বিচার, শেখ হাসিনা মানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় চলা দেশ, শেখ হাসিনা মানে উদার ও প্রগতির বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা মানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মাথা উঁচু করে চলা বাংলাদেশ।
Advertisement
শেখ হাসিনার সামনে তাই পথ হলো অবিচল ভাবে এগিয়ে চলা। তিনি সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা জানেন। তিনি এদেশের তারুণ্যের স্বপ্ন বোঝেন। একটা বড় প্রশ্ন আছে। শেখ হাসিনা যা চান, তা কি বুঝতে পারে তার দল? একদিকে শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন, যার মাধ্যমে এক নতুন রাষ্ট্রীয় পরিচয় পাবে এ দেশের মানুষ। অন্যদিকে তার দল সেই পরিচয়কে বড় করে তুলতে কতটা বৃহত্তর পরিসরের রাজনীতি করছে? আধিপত্য তৈরির মহড়া যদি চলতে থাকে তবে দল এগোতে পারে না, সেটা কি বোঝে যুবলীগের মতো সংগঠন?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনে চ্যালেঞ্জ বহুমুখী। সততা, নিষ্ঠা, রাজনৈতিক দৃঢ়তা; গণতন্ত্র, শান্তি, সম্প্রীতি ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের রূপকার তিনি, মানবকল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ তিনি, আবার দলনেত্রী তিনি। শাসন ক্ষমতায় পরপর তৃতীয়বার এসে তাই এবার শেখ হাসিনার নজর নিজের দলের দিকে। দলের ভেতর থাকা দুর্বৃত্তদের তিনি উৎখাত করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন। বহুবার বলেছেন, ‘বাবার মতো আমাকে যদি জীবন উৎসর্গ করতে হয়, আমি তা করতে প্রস্তুত।’ সাধারণ মানুষের আস্থা ও ভরসার কেন্দ্রবিন্দু শেখ হাসিনা ধৈর্য ও সাহসের যেন প্রতিমূর্তি।
শেখ হাসিনা ভাইবোনদের মধ্যে সবার বড়। তাই বড় স্বপ্ন তার সবসময়। এখন উন্নয়নের যেসব কাজ হচ্ছে, এদেশ এমন করে কখনো এমনভাবে দেখেনি। নিজস্ব অর্থে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের যে লড়াই তিনি শুরু করেছেন, তা আরেকবার তার পিতাকে আলোচনার সামনে নিয়ে আসে। বাঙালির সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল স্বাধীন সার্বভৌম দেশ পাবে। শেখ হাসিনার পিতা আমাদের সেই বড় স্বপ্ন বাস্তবায়ন করেছেন। আর এখনকার স্বপ্ন উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। সেই স্বপ্নের পথে আমাদের নিয়ে হাঁটছেন শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং অর্থনীতি, দুইয়ের সাফল্যই নির্ভর করছে রাষ্ট্রীয় সুশাসনের ওপর। কেন্দ্র আর প্রান্তের মধ্যে সুযোগ, সুবিধা আর আর্থিক অসাম্যর শিকড় বহু যুগ ধরে বিস্তৃত। বিস্তৃত আছে মানুষে মানুষে ব্যাপক বৈষম্য। উন্নত শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে আছি আমরা। এ সময়ে যদি বৈষম্য বাড়তে থাকে, তা হলে কিন্তু রাজনৈতিক শৃঙ্খলাও আঘাতপ্রাপ্ত হবে। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করবে। তবে ভরসা আছে। এ দেশে প্রগতিশীল শক্তির একটা নিজস্ব চাপ রয়েছে। চাপ আছে শান্তি আর স্থিতিশীলতা বজায় রাখারও। এই অন্তর্নিহিত শক্তি আমাদের সবচেয়ে বড় ভরসা আর সেই ভরসা তৈরি করেছেন শেখ হাসিনা। বন্ধুরপথ, চারদিকে অবিশ্বাসের ছায়া, কিন্তু এ সবকিছু অতিক্রম করে দেশকে ভালোবাসে ঝুঁকি নিয়ে দেশের উন্নয়নের কথা ভাবে, এমন নেতা রাজনীতিতে কোনো যুগেই বেশি ছিল না, এখনো নেই। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে, অর্থনীতির রূপকার হিসেবে, বাস্তববাদী দেশ চালক হিসেবে শেখ হাসিনা কতটা সফল, তা নিয়ে তর্ক নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু তিনি যে আক্ষরিক অর্থেই বাঙালির মাঝে এক অন্য মানুষ সে বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
Advertisement
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/এমকেএইচ