বিশেষ প্রতিবেদন

শেখ হাসিনার অবদান দিল্লি ভুলে গেলে তা হবে বাস্তবতার অস্বীকার

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার কার্লটন বিশ্ববিদ্যালয়, অটোয়া ও অস্ট্রেলিয়ান ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাপানের ইয়োকোহামা সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কাজ করেছেন। অধ্যাপনা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং টেররিজম ইন সাউথ এশিয়া : বিয়ন্ড স্টাটিস্ট ডিসকোর্সেস’ নামক গ্রন্থের রচিয়তা তিনি।

Advertisement

তালেবানদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির প্রসঙ্গ নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজ’র। বলেন, ‘আফগানরা কী রকম মারমুখী, তা যুক্তরাষ্ট্র এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিদায়ে তালেবানরাই লাভবান হবে।’ কাশ্মীর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাকিস্তান কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধে যাবে না। কারণ এতে ভারত কাশ্মীরে একতরফা সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ পাবে। ‘কাশ্মীর ভারতের প্রায় হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল’ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে আসামের এনআরসি ও রোহিঙ্গা প্রসঙ্গও গুরুত্ব পায়। তিন পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে শেষটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।

জাগো নিউজ : আসামের এনআরসি কীভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন?

Advertisement

ইমতিয়াজ আহমেদ : এনআরসির বিষয়টি নিয়ে মোদি সরকার যেভাবে খেলতে চাইছে, তা ঠিক হয়ে উঠছে না। প্রথমে বলা হলো ৪১ লাখের কথা, পরে ১৯ লাখের হিসাব এলো। বাঙালি মুসলমানদের টার্গেট নিয়ে এটি করা। অথচ এ ১৯ লাখের মধ্যে ১১ লাখই হিন্দু সম্প্রদায়ের।

বিজেপি নিজেই সমস্যায় পড়ে গেছে এ হিসাব নিয়ে। বিজেপি নিজেই বলছে, বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে কোনো হিন্দু ভারতে গেলে তাদের নাগরিত্ব দেয়া হবে। তার মানে ১১ লাখ হিন্দুকে নাগরিকত্ব দিতে হচ্ছে। থাকছে মাত্র আট লাখ। ১২০ কোটি মানুষের দেশে আট লাখের হিসাব কষে বিজেপি খুব একটা সুবিধা নিতে পারছে না। একটি সমাবেশেও এখন এতসংখ্যক মানুষ সমাগত হয়।

এনআরসি নীতি অবলম্বন করে বিজেপি খুব একটা সুবিধা করতে পারছে না এ কারণে যে, সমালোচনাটাই বেশি হচ্ছে। ভারতের সিভিল সোসাইটি সরকারের নীতির সমালোচনা করছেন। অনেক রাজনৈতিক দল এর বিপক্ষে। আসামের মানুষ এটি মানবে কি-না, আদালতের রায়ের ব্যাপার আছে। এত কিছুর মধ্য দিয়ে বিজেপির চরিত্রটাই উন্মোচিত হচ্ছে।

জাগো নিউজ : এ বিষয়ে বাংলাদেশের গুরুত্ব দেয়ার কিছু আছে কি-না?

Advertisement

ইমতিয়াজ আহমেদ : এনআরসি ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সে দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসে তা-ই বলেছেন। এখন পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে যতগুলো বৈঠক হয়েছে, সেখানে এনআরসির বিষয়টি এজেন্ডা ছিল না। যে বিষয়টি এজেন্ডায় ছিল না, সেটিকে নিয়ে বাংলাদেশের মিডিয়ায় এত আলোচনার কিছু আছে বলে মনে করি না। এতে ভারত আরও সুযোগ পেতে পারে বলে মনে করি।

জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা উদাহরণ সামনে আছে। উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ থাকতেই পারে...

ইমতিয়াজ আহমেদ : আমি আপাতত উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ দেখছি না। তবে সতর্ক হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে বলে মনে করি।

কারণ, ভারতের মুসলমানরা কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হলে বাংলাদেশে মৌলবাদী শক্তি লাভবান হবে। ভারতবিরোধী মনোভাব আরও বেড়ে যাবে। এটি মোদি সরকারকেও বুঝতে হবে। কারণ মৌলবাদী শক্তি লাভবান হলে কারও-ই ভালো থাকার কথা নয়।

জাগো নিউজ : ভারতের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের সম্প্রীতি বাড়ছে অথচ মানুষের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব বাড়ছে- এমনটি অনেকেই মনে করেন। আপনার ধারণা কী?

ইমতিয়াজ আহমেদ : এ বাস্তবতা অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পর্ব অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ যে ভূমিকা রাখছে, তা ভারতের বোঝার কথা। উলফা তথা বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বাংলাদেশে আর আশ্রয় পায় না। এ প্রশ্নই ভারতের বোঝা উচিত, নিজের প্রয়োজনেই বাংলাদেশ-কে অধিক গুরুত্ব দেয়া দরকার।

উত্তর-পূর্ব ভারতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার যে অবদান, তা দিল্লি ভুলে গেলে বাস্তবতার অস্বীকার করা হবে। অথচ, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে প্রায় উদাসীন। এ কারণেই ভারতবিরোধী মনোভাব প্রকাশ পাচ্ছে।

জাগো নিউজ : উত্তর-পর্ব ভারতের শান্তি কি স্থায়ী বলা যায়?

ইমতিয়াজ আহমেদ : সেটা হয়তো পরের পর্যবেক্ষণ। কিন্তু গত ১০ বছরে বাংলাদেশ সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠায় বড় ভূমিকা রেখেছে। অনুপ চেটিয়ার মতো উলফা নেতাকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ। উলফা নেতারা বাংলাদেশে আর আশ্রয় পাচ্ছে না। এ প্রশ্নে দিল্লি কেন উদাসীন, তা বুঝতে পারি না। মনে রাখতে হবে, ভারত-কে আমাদের প্রয়োজন বটে, কিন্তু তার চেয়ে বড় প্রয়োজন ভারতের বাংলাদেশ-কে।

জাগো নিউজ : এমন প্রয়োজন কি বাংলাদেশ তুলে ধরতে পারছে?

ইমতিয়াজ আহমেদ : প্রশ্ন আমারও। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে তো ভারতের সাহায্যের দরকার নেই। বাংলাদেশের সীমানাতেও কোনো অস্থিরতা নেই। রোহিঙ্গা ইস্যু মিয়ানমারের একতরফাভাবে তৈরি করা। বাংলাদেশের দরকার উন্নয়ন। উন্নয়ন প্রশ্নে আজ এ দেশ তো কাল অন্যকোনো দেশের প্রয়োজন।

জাগো নিউজ : কিন্তু ভারত-কে তো বাংলাদেশের সরকারগুলো সবসময় সবকিছু সঁপে দেয় বলে মনে করা হয়?

ইমতিয়াজ আহমেদ : এ অভিযোগে কিছুটা মিথ (লোকগল্প) তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়। এ গল্প ভারতও তৈরি করে। তারাও মজা পায়।

জাগো নিউজ : শুধুই গল্প…

ইমতিয়াজ আহমেদ : সম্পর্কের মাঝে অনেক গল্পই তৈরি হয়। আমি মনে করি, বাংলাদেশ সরকারগুলো তার নিজের প্রয়োজনেই ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায়।

জাগো নিউজ : কিন্তু গত দুটি জাতীয় নির্বাচনে বাংলাদেশে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে কি-না?

ইমতিয়াজ আহমেদ : এ নিয়ে বিতর্ক আছে। আমি ভারত-কে দেখার আগে বাংলাদেশের ভেতরের বিষয়ে গুরুত্ব দেব। বাংলাদেশে কিছু শক্তি আছে, যারা সরকারের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে। মিডিয়া, নিরাপত্তা সংস্থা, ব্যবসায়ী সংগঠন, সুশীল সমাজসহ এ ধরনের শক্তির ওপর ক্ষমতায় যাওয়া আর থাকা অনেকটা নির্ভর করে। বাইরের শক্তি হয়তো সমর্থন দেখানোর চেষ্টা করে।

সরকারের বিরুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ যদি রাস্তায় নামতো, আন্দোলন তীব্র হতো, তখন আপনি বাইরের শক্তিগুলোর অবস্থান নিয়ে সঠিক পর্যবেক্ষণ করতে পারতেন। আমরা তা দেখতে পাইনি। আওয়ামী লীগের বাইরে আরও অনেকে ক্ষমতায় ছিল। ভারত চাইলেই তাদের সরিয়ে দিতে পারেনি। এ কারণে আমি মনে করি, ভেতরের শক্তির ওপরই সব নির্ভর করে না। বর্তমান সরকার যে কোনো উপায়ে সেই শক্তিগুলো-কে একত্রিত করে নিজের পক্ষে আনতে সক্ষম হয়েছে। তাই বলে আমি ‘সিআইএ, ‘আইএসআই’, ‘র’- এর ভূমিকা যে কিছুই নেই, তা বলছি না। তবে তাদের ভূমিকা নির্ভর করে অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর ওপর।

যদি শেখ হাসিনার সরকার-কে একতরফাভাবেই ভারত সমর্থন করতো, তাহলে তো রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকার কথা ছিল তাদের। কিন্তু আমরা সেটি দেখতে পাইনি।

জাগো নিউজ : রোহিঙ্গা সংকট কোথায় যাচ্ছে?

ইমতিয়াজ আহমেদ : দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মধ্য দিয়ে সরকার হয়তো সমাধানের পথ খুঁজছিল। পারেনি। এখন হয়তো বুঝতে পারছে, আন্তর্জাতিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই।

রোহিঙ্গা সংকট আগের মতো নয়। একটি গণহত্যার মধ্য দিয়ে তাদের রাষ্ট্রহীন করা হয়েছে। চাইলেই তাদের পাঠিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তারা স্বীকৃতি নিয়েই যেতে চাইবে। যারা হত্যা করেছে, তারাই যদি ডেকে পাঠায়, তাহলে তো হবে না। মিয়ানমারের বন্ধু ভারত, চীন, জাপানের মতো রাষ্ট্রকে বাগে আনতে হবে।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশ সরকার সেটি করতে পারবে কি?

ইমতিয়াজ আহমেদ : অবশ্যই করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী সিরিয়াস বলে মনে হচ্ছে। এবার জাতিসংঘের অধিবেশনে বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপিত হবে বলে বিশ্বাস করি। জাতিসংঘ ইতোমধ্যে মিয়ানমারে গণহত্যাকারীদের তালিকা বড় করছে। এতে চাপ আরও বাড়বে বলে মনে করি।

আন্তর্জাতিকীকরণ করতে পারলে সবাই মিয়ানমার সম্পর্কে অবগত হতে পারবে। সেখানে বিনিয়োগ করতে যাবেন যারা, তারাও ভাববেন। বিনিয়োগের ওপর নজর বাড়াতে হবে। চীন ইতোমধ্যে জড়িত হয়েছে। তারা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আগ্রহী এখন। এ আগ্রহ সবারই বাড়াতে হবে।

জাগো নিউজ : বাংলাদেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে রোহিঙ্গা ইস্যুটি অনেকেই বড় করে দেখছেন। আপনি কীভাবে দেখছেন?

ইমতিয়াজ আহমেদ : ভুটানের জনসংখ্যার সমান মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। ভুটান তৈরি হয়েছে সাত হাজার বছরে। আর তিন মাসে তৈরি হলো রোহিঙ্গা শিবির। অথচ তাদের কোনো রাজা নেই, নীতি নেই।

এরপরও আমি মনে করি, বাংলাদেশ যেভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটি প্রশংসার দাবি রাখেই বটে। কারণ বাংলাদেশের অর্থনীতির যে অবস্থা তাতে এতসংখ্যক মানুষকে জায়গা দেয়া নজিরবিহীন।

মানবিক দিক বিবেচনা করেই রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের চেষ্টা শুরু থেকেই করে আসছে বাংলাদেশ। ধর্মীয় পরিচয়ও গুরুত্ব পেয়েছে বাংলাদেশের মানুষের কাছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আমাদের আছে বলেই আমরা মানবিক হওয়ায় আরও সচেষ্ট থেকেছি। বাংলাদেশ বিচক্ষণতার মধ্য দিয়ে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করছে।

অক্টোবরে ভারত সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোহিঙ্গা ইস্যুতে স্পষ্ট কথা বলবেন বলে মনে করি। আমি হতাশ নই, রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে। রোহিঙ্গা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ারও কোনো কারণ নেই আপাতত। সম্প্রতি রোহিঙ্গা শিবিরে যে সমাবেশ হয়েছে, সেখানেও বাংলাদেশের মানুষ ও সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়েছে।

এএসএস/এমএআর/এমএস